হক, আজহারুল
হক, আজহারুল (১৯৪০-১৯৭১) চিকিৎসক, শহীদ বুদ্ধিজীবী। আজহারুল হকের পৈত্রিক নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থানার রাধানগর গ্রামে। ১৯৪০ সালের ২ মার্চ ঢাকায় তাঁর জন্ম। পিতা মোঃ জহুরুল হক তখন ছিলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের জেলার। তাঁর মাতা ফাতেমা খাতুন। ১৯৪৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর আজহারুল হক প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর ভাইয়ের কর্মস্থল নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেটে। তিনি ১৯৬৩ সালে সিলেট মেডিক্যাল স্কুল থেকে এলএমএফ ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন। এক বছর ইন্টার্নশীপ শেষে আজহারুল হক ১৯৬৯ সালের ২৬ জুন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সহকারি সার্জন পদে যোগদান করেন।
নিবেদিত প্রাণ তরুণ চিকিৎসক আজহারুল হক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে অসামান্য অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই তিনি ঢাকার হাতিরপুলে সাঈদা ফার্মেসি সংলগ্ন তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে এবং প্রায়শ বাইরে গিয়ে গোপনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং তাদের সহায়তা করার বিষয়টি একসময় আলবদর বাহিনীর সদস্যদের গোচরীভূত হলে তাঁর হাতিরপুলের চেম্বারের ঠিকানায় পত্রযোগে তাঁকে হুমকি দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের কোনো এক সময় তাঁকে পুলিশ সদর দফতরে ডেকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সপক্ষে তাঁর কার্যক্রমের জন্য কঠোরভাবে শাসানো হয়। তখন থেকে তিনি তাঁর চেম্বারে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা বন্ধ করে হাতিরপুল ও এর পার্শ্ববর্তী বস্তি এলাকায় গোপনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। কখনো বা তিনি গভীর রাতে অবাঙালি (বিহারী) অধ্যুষিত এলাকা মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে গিয়েও গোপনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। কোনো ভয়ভীতি বা হুমকিই আজহারুল হককে তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।
এ দুঃসাহসিক কাজের জন্য যেকোন পরিস্থিতি বা বিপদের ঝুঁকি নেয়ার মানসিক প্রস্ত্ততি তাঁর ছিল। বিপদের সেই চরম ক্ষণটি তাঁর এলো নভেম্বর মাসে। তখন আজহারুল হক হাতিরপুল এলাকায় ২২ নং ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের হাকিম হাউসে সপরিবারে বসবাস করতেন। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বরের পূর্ব রাতে শহরে কার্ফু্য জারি করা হয় এবং সকাল বেলা আল-বদর বাহিনীর সশস্ত্র কর্মিরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুল ও সেন্ট্রাল রোড ঘেরাও করে রাখে। কার্ফু্যর মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার কোনো উপায় না দেখে আজহারুল হক হাকিম হাউসের মালিক খান বাহাদুর আব্দুল হাকিমের বাসায় গিয়ে হাসপাতালে টেলিফোন করেন অ্যাম্বুলেন্স পাঠাবার জন্য। বাড়ির প্রধান ফটকে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য যখন তিনি অপেক্ষা করছিলেন ঠিক তখনই একই ভবনের বাসিন্দা তাঁর সহকর্মী ডাঃ এ.বি.এম হুমায়ুন কবির দ্রুত নিচে নেমে আসেন এবং গেটে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। কিন্তু এদিকে আল-বদর কর্মিরা হাসপাতাল থেকে প্রেরিত অ্যাম্বুলেন্স ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢুকতে দেয়নি। এরই মধ্যে বদর বাহিনীর কয়েকজন সশস্ত্র কর্মী ফটকের সামনে ইউনিফর্ম পরিহিত দুজন চিকিৎসককে দেখে তাদের দিকে এগিয়ে আসে এবং জেরা করতে থাকে। তাদের কথাবার্তায় প্রতীয়মান হয় যে, তারা আজহারুল হককেই খুঁজছিল, এবং যখন তাকে শনাক্ত করা গেল তখন একজন বদর-কর্মী রাইফেল দিয়ে তাঁর ডানহাতে সজোরে আঘাত করে। এরপর তারা রাইফেল উঁচিয়ে তাদের দুজনকে হাতিরপুলের দিকে তাড়া করে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের একটি জিপে করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে।
পর দিন ১৬ নভেম্বর চোখ ও হাত পা বাঁধা অবস্থায় আজহারুল হক ও হুমায়ুন কবিরের মৃতদেহ মতিঝিলে নটরডেম কলেজের নিকটস্থ কালভার্টের পূর্বপ্রান্তে পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃতদেহের অবস্থা দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, কঠোর নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। ডাঃ আজহারুল হককে আজিমপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়। প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী আজহারুল হক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও সাহিত্য চর্চায় অনুরাগী ছিলেন। তাঁর ভাইবোনদের ছাড়াও ডাঃ আজহারুল হক রেখে গেছেন তাঁর স্ত্রী সৈয়দা সালমা হককে। তাঁর স্ত্রী তখন ছিলেন সন্তান সম্ভবা। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। পরে তার নামকরণ হয় আশরাফুল হক (নিশান)।
জাতির জন্য তাঁর আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ ১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আজহারুল হকের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]