স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা

স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা ১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার কমিশন কর্তৃক প্রবর্তিত ব্যবস্থা। ১৯১৯ সালের চেমস্ফোর্ড রিপোর্ট কর্তৃক এবং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন দ্বারা এই ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়। ১৯০৯ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় সংস্থাসমূহ এবং আইন পরিষদের সকল নির্বাচন স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নির্বাচনসমূহও স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের সংবিধান (১৯৫৬) এই ব্যবস্থা রহিত করে এবং এই ব্যবস্থার পরিবর্তে হিন্দুদের জন্য বিশেষ কিছু সংখ্যালঘু রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রেখে সর্বজনীন যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।

ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারতের দুটি বৃহত্তম সম্প্রদায় হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক মনোভাবের ফলে সৃষ্ট একটি বিশেষ সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা থেকে স্বতন্ত্র নির্বাচনের এই ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত জয়ের সময় থেকেই ঔপনিবেশিক পরিবেশের অধীনে দুই সম্প্রদায়ের উন্নয়ন বরাবরই অত্যন্ত অসম গতিতে এগোচ্ছিল। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এবং এরূপ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট সুযোগসমূহ লাভ করার সুবিধা থাকায় রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দুরা নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী ঔপনিবেশিক সরকারের সঙ্গে ক্ষমতায় অংশগ্রহণ সহ রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছিল। ১৮৮৫ সালে রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা এবং অপরাপর সংঘসমূহ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রায় এককভাবে হিন্দুদের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সকল ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী আদর্শের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে। উত্তর ভারতীয় মুসলিম নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান মনে করতেন যে, কংগ্রেসে যোগদান করা ভারতীয় মুসলমানদের পশ্চাৎপদ অবস্থার কোন সমাধান নয়। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং তাদের উন্নয়নের জন্য তিনি একটি ধারণা ব্যক্ত করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ভারতীয় মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, ব্রিটিশের বিশ্বস্ত হতে হবে এবং কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। এ মতবাদকেই তাঁর অনুসারিরা আলীগড় আন্দোলন নামে অভিহিত করে।

ভাইসরয় লর্ড মিন্টো যখন ভারতে দায়িত্বশীল সরকার প্রবর্তনের জন্য তাঁর আগ্রহের কথা ঘোষণা করেন, তখন আগা খানের নেতৃত্বে মুসলমানদের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সাথে সিমলায় সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলমানরা রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার জন্য যতদিন না যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রসর হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত স্বতন্ত্র নির্বাচনের ভিত্তিতে হিন্দুদের সঙ্গে সমান অবস্থানে থেকে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের স্বার্থ রক্ষা করার দাবি তুলে ধরেন। ভাইসরয়ের কাছে এ দাবি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় এবং তিনি তাদের এ প্রস্তাবের প্রতি তাঁর সমর্থনের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। অবশেষে মর্লি-মিন্টো রিফর্মস (১৯০৯) মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থার আয়োজন করে।

কংগ্রেস কর্তৃক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বাভাবিক বিকাশকে বিঘ্নিত করার জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করাকে ঔপনিবেশিক চাতুরি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই ব্যবস্থা বাতিল করার জন্য কংগ্রেসের আন্দোলন কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনে নি। ইতোমধ্যে ১৯১২ সাল থেকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট একটি নতুন রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করে। বঙ্গভঙ্গ রদকরণ (১৯১২) মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে এবং কংগ্রেসের বিক্ষোভের রাজনীতিতে যোগ দিতে তাদের বাধ্য করে। মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য কংগ্রেস কৌশল পরিবর্তন করে এবং অবশেষে ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌতে মুসলিম লীগের সাথে একটি অস্থায়ী চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থাকে স্বীকার করে নেয়। সেমতে ১৯২৯ সালের ভারত শাসন আইনে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করাকে কংগ্রেস বিরোধিতা করে নি, যদিও অন্যান্য কিছু কারণে সংগঠনটি সংবিধান প্রত্যাখ্যান করেছিল।

১৯১৯ সালের সংবিধানের কার্য-পদ্ধতি অনুসন্ধান করা এবং সাংবিধানিক সংস্কার সম্বন্ধে পরামর্শ প্রদানের জন্য নিয়োগকৃত সাইমন কমিশন (১৯২৭) কেবল স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা সংরক্ষণের সুপারিশই করেনি, অধিকন্তু তা অন্যান্য অনুন্নত সম্প্রদায় এবং বর্ণসমূহের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করারও সুপারিশ করে। এরূপে ১৯৩৫ সালের সংবিধান মুসলমানদের জন্য এবং তফশিলী সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। বঙ্গীয় আইন পরিষদের মোট ২৫০টি আসনের মধ্যে ১১৭টি আসন মুসলমানদের জন্য এবং অবশিষ্ট আসনগুলোর ২০% তফশিলী সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষণ করে। তদনুসারে ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্প্রসারিত স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থার ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ এবং কৃষক প্রজা পার্টি যৌথভাবে সরকার গঠন করতে পেরেছিল। সন্দেহাতীতভাবে এই ব্যবস্থা দুই সম্প্রদায়ের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয় এবং পরিণামে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের ঘোষণা সম্বলিত লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০) অনুমোদিত হয়। ফলে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধানে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা রহিত করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]