সৈয়দ, আবদুল মান্নান
সৈয়দ, আবদুল মান্নান (১৯৪৩-২০১০) কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাহিত্য-সমালোচক। ১৯৪৩ সালের ৩ আগস্ট পশ্চিম বঙ্গের চবিবশ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ এ এম বদরুদ্দোজা এবং মা আনোয়ারা মজিদ।
১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৩ সালে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সিলেট এম সি কলেজে প্রভাষক পদে চাকরির মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজে কিছু সময় এবং জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘ সময় অধ্যাপনা করে জীবন অতিবাহিত করেন, ১৯৯৮ সালে উক্ত কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে তিনি বাংলাদেশ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রথম স্কলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার-এ স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করেন। তিনি ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। মাসিক সাহিত্য পত্রিকা শিল্পতরু-তে তিনি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ ১৯৬০ সাল থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন এবং পাঁচ দশক ধরে লেখা অব্যহত রাখেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। তাঁর কবিতায় কখনো মৃত্যুচেতনা, কখনো রোমান্টিকতা, কখনো সুররিয়ালিজম, প্রতীকধর্মী আবার কখনো এ্যাবসার্ডধর্মী ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। একজন নিরীক্ষাধর্মী গবেষক হিসেবে আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর লেখার বিষয় ও রচনা রীতিতে পুনঃপুন পরিবর্তন আনয়নে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি কবিতায় প্রায়ই চাঁদ, সূর্য, আকাশ ও মেঘকে চিত্রকল্পের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া আবদুল মান্নান সৈয়দ ছন্দ বিষয়ে বেশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। প্রবোধচন্দ্র সেন ও শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন তাঁর ছন্দবিষয়ক শিক্ষক।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সাহিত্য সমালোচক ও সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ ও নজরুল সাহিত্যের অন্যতম গবেষক ছিলেন। তাছাড়া তিনি ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বেগম রোকেয়া, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক-সম্পাদককে নিয়ে গবেষণা করেছেন।
কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-গবেষণা, কাব্যনাটক, স্মৃতিকথাসহ তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা দেড় শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: কবিতা জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫), কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২), পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২), পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩), মাছ সিরিজ (১৯৮৪), নির্বাচিত কবিতা (২০০২); ছোটগল্প সত্যের মতো বদমাশ (১৯৬৮), চলো যাই পরোক্ষে (১৯৭৩), মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা (১৯৭৭); উপন্যাস পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী (১৯৭৪),অ-তে অজগর (১৯৮২), গভীর গভীরতর অসুখ (১৯৮৩), ক্ষুধা প্রেম আগুন (১৯৪৪), শ্রাবস্তীর দিনরাত্রি (১৯৯৮); প্রবন্ধমূলক গবেষণা জীবনানন্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪). নজরুর ইসলাম: কবি ও কবিতা, করতলে মহাদেশ (১৯৭৯), ছন্দ (১৯৮৫), রবীন্দ্রনাথ (২০০১), আবদুল গনি হাজারী (১৯৮৯), সৈয়দ মুর্তজা আলী (১৯৯০), প্রবোধচন্দ্র সেন ((১৯৯৪); নাটক/কাব্যনাটক চাকা (১৯৮৫),নাট্যগুচ্ছ (১৯৯১), কবি ও অন্যেরা (১৯৯৬); অনুবাদ কবিতা মাতাল মানচিত্র (১৯৭০); সম্পাদনা গ্রন্থ ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭৫), সমালোচনা সমগ্র: জীবনানন্দ দাশ (১৯৮৩), বাংলাদেশের কবিতা (যৌথ, ১৯৮৮), সমর সেনের নির্বাচিত কবিতা ((১৯৮৯), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী রচনাবলী (প্রথম খন্ড-১৯৯০, ২য় খন্ড-১৯৯২), মাইকেল মধুসূদন দত্ত: শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯২); শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ: বেগম রোকেয়া (২০০২)।
সাহিত্যে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮১ সালে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার; ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র কর্তৃক ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার; ১৯৯৮ সালে নজরুল পুরস্কার (চুরুলিয়া, বর্ধমান, পশ্চিম বাংলা); ২০০১ সালে নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক নজরুল পদক; ২০০০ সালে তালিম হোসেন পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কার এবং ২০০২ সালে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। [শামীমা আক্তার]