সেলবর্সী, ফজলুল হক
সেলবর্সী, ফজলুল হক (১৮৯৩-১৯৬৮) সাংবাদিক, লেখক, বিপ্লবী রাজনীতিক। সুনামগঞ্জ জেলার ধরমপাশা উপজেলার সেলবরস গ্রামে ১৮৯৩ সালে তাঁর জন্ম। স্থানীয় সিংধা মাইনর স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। শৈশবে পিতামাতাকে হারিয়ে ফজলুল হক অসহায় হয়ে পড়েন এবং তাঁর পড়াশুনা ব্যাহত হয়। সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী হাইস্কুলে ১৯১৫ সালে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ফজলুল হক কলকাতায় চলে যান। সেখানে ১৯১৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি রিপন কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু অচিরেই তিনি কলেজ ত্যাগ করে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন।
ফজলুল হক ১৯১৭ সালের কোনো একসময় সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায় যোগ দেন। পরে তিনি সম্পাদক হিসেবে দৈনিক নবযুগ (১৯১৯-১৯২২), সাপ্তাহিক মোহাম্মদী (১৯২৪-১৯২৯), সাপ্তাহিক আল-মুসলিম (১৯২৯-১৯৩৪) ও সাপ্তাহিক যুগভেরী (১৯৩৪-১৯৩৫) পত্রিকায় কাজ করেন। ফজলুল হক ১৯৩৫ সালে দৈনিক তাকবির পত্রিকার সম্পাদক পদে যোগ দেন। কিন্তু সরকার বিরোধী ভূমিকার কারণে পত্রিকাটি অচিরেই রাজরোষে পতিত হয় এবং সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে তিনি দৈনিক সোলতান, মুসলিম, নয়াবাংলা ও আল-এসলাম পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ফজলুল হক ঢাকায় চলে আসেন এবং দীর্ঘকাল দৈনিক সংবাদ ও নেজামে ইসলাম পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন।
ফজলুল হক ছাত্রজীবন থেকেই বিপ্লবী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ এবং আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুসলিম মতবাদের উদ্গাতা সাইয়্যিদ জামালুদ্দিন আফগানীর (১৮৩৯-১৮৯৭) প্যান-ইসলামিজম মতাদর্শের কট্টর অনুসারী ছিলেন ফজলুল হক। তিনি বালাকোটের ইসমাইল শহীদ, আনোয়ার পাশা এবং মিশরের জগলুল পাশার বিপ্লবী ও জঙ্গী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হন। কলকাতায় তিনি আনোয়ার ছাত্র সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি নিজেই ছিলেন এ সমিতির সভাপতি। কলকাতায় ছাত্রাবস্থায়ই ফজলুল হক ১৯১৬ সালে জেহাদ পার্টি নামে একটি গোপন বিপ্লবী দল গঠন করেন। তিনি খিদিরপুরের ষোলহাজারী মসজিদে এই দলের যুব কর্মীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। জেহাদ পার্টি গঠনের প্রথম পর্যায়েই তিনি প্রায় ৬৫০ জন যুবকর্মীর একটি দল গড়ে তোলেন।
সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের পাশাপাশি ফজলুল হক সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং পরে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য কয়েকবার তিনি গ্রেফতার হন। তিনি ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের অপরাধে ১৯২১ সালে তাঁর নামে পর পর তিনটি গ্রেফতারি পরওয়ানা জারী করা হয়। কয়েকমাস আত্মগোপনে থেকে তিনি তাঁর গোপন কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু পরে মওলানা আবুল কালাম আজাদের প্রণোদনায় তিনি ১৯২২ সালে বাংলা ত্যাগ করে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার নিরাপদ স্থল হিসেবে আফগানিস্তানে চলে যান। পরে একসময় আফগানিস্তান থেকে পেশোয়ার যাওয়ার পথে পেশোয়ার সীমান্তে তিনি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। পেশোয়ার সেনানিবাসে একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তাঁকে ৪৮ দিন অবরুদ্ধ রাখা হয়। পরে আদালতে বিচারের জন্য তাঁকে সিলেটে আনা হয়। রাজদ্রোহের অপরাধে তাঁকে তিন বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। ১৯২৪ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে ফজলুল হকের বহুসংখ্যক নিবন্ধ ও রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর বেশসংখ্যক রাজনৈতিক নিবন্ধ দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর বৈপ্লবিক রচনাবলির অধিকাংশই প্রকাশিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের ধূমকেতু পত্রিকায়। ছাত্রাবস্থায় তাঁর রচিত কবিতা সেন্ট হেলেনা, ওকবা এবং আল্লামা ইকবালের তারানা-ই-মিলীর কাব্যানুবাদ সুধীমহলে ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেছে। তাঁর রচিত দুটি গ্রন্থ আনোয়ার পাশা এবং শহীদে আযম অপ্রকাশিত রয়েছে।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন ফজলুল হক সেলবর্সী। কবি নজরুলের বিপ্লবী মানস গঠনে তাঁর প্রভাব ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফজলুল হকের আদর্শ জাতীয়-বীর আনোয়ার পাশা ও জগলুল পাশা কবি নজরুলের কবিতায় বীরত্বের প্রতীকরূপে চিত্রিত হয়েছেন। নজরুল তাঁর এক কবিতায় ‘জগলুল মম ফজলুল হক’ পংক্তির মাধ্যমে স্পষ্টতই ফজলুল হককে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ-পুরুষ মিশরের জগলুল পাশার স্থলাভিষিক্ত করেছেন।
সুনামগঞ্জ সাহিত্য মজলিশ ১৯৬৭ সালের ২৬ এপ্রিল সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরী হলে ফজলুল হক সেলবর্সীকে এক সাড়ম্বর গণসংবর্ধনা দান করে।
আজীবন অকৃতদার ফজলুল হক সেলবর্সী ১৯৬৮ সালের ৮ নভেম্বর নিজ গ্রাম সেলবরসে তাঁর মৃত্যু হয়। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]