সেভেন সয়েল ট্র্যাক্ট
সেভেন সয়েল ট্র্যাক্ট (Seven Soil Tracts) বাংলাদেশের মৃত্তিকার অত্যন্ত সরল ও সাধারণীকৃত শ্রেণিবিন্যাস সিস্টেম। এ শ্রেণিবিন্যাসটি মৃত্তিকাবিজ্ঞানী নয় এমন মানুষও সহজেই বুঝতে পারে। যদিও প্রাকৃতিক নয় তবুও এটিই ছিল বাংলাদেশের মৃত্তিকার প্রথম টেকনিক্যাল শ্রেণিবিন্যাস। ১৯৫৬ সালে এম. আমিরুল ইসলাম ও ওহেদুল ইসলাম বাংলাদেশের মৃত্তিকার শ্রেণিবিন্যাসের একটি ভাল পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং প্রকৃত অর্থে এ সময় বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পর্কিত তথ্যের সত্যিই অভাব ছিল। ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা এবং উৎস বস্ত্তর ভূতাত্ত্বিক উৎপত্তি এ শ্রেণিবিন্যাসে গুরুত্ব পেয়েছিল। তৎসত্ত্বেও, উপকূল মৃত্তিকার ক্ষেত্রে রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিবেচনা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মৃত্তিকার পুষ্টি উপাদান অবস্থার মূল্যায়ন করাই ছিল এ শ্রেণিবিন্যাসের প্রধান লক্ষ্য। শ্রেণিবিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত সাতটি শ্রেণীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা প্রদান করা হলো: (১) মধুপুর অঞ্চল বা লাল মৃত্তিকা অঞ্চল, (২) বরেন্দ্র অঞ্চল, (৩) তিস্তা পলি, (৪) ব্রহ্মপুত্র পলল, (৫) গাঙ্গেয় পলল, (৬) উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চল এবং (৭) পাহাড় অঞ্চল।
মধুপুর অঞ্চল বা লাল মৃত্তিকা অঞ্চল এ অঞ্চলটি ভূতপূর্ব বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলা এবং চট্টগ্রাম, কুমিলা ও সিলেট জেলার কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা নিয়ে গঠিত। এ অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। অঞ্চলটি মধুপুর এলাকার লাল ল্যাটারাইটীয় মৃত্তিকার প্রতিনিধিত্ব করে। অঞ্চলটি পাবন তলের উপরে অবস্থিত উঁচুভূমি, যা স্থানীয়ভাবে ‘বাইদ’ নামে পরিচিত অসংখ্য ছোট ও বড় আকারের খাদ (depression) দ্বারা বিভক্ত। এই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত মৃত্তিকা এঁটেল গ্রথনসম্পন্ন এবং মৃত্তিকাতে অধিক পরিমাণে আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম আছে, যা অধিক সংযুতিসম্পন্ন। পৃষ্ঠমৃত্তিকার পি.এইচ মানের পরিসর ৫.৫ থেকে ৬.০। ধনাত্মক আয়ন বিনিময় ক্ষমতা কম এবং মৃত্তিকা অধিক পরিমাণে ফসফেট বন্ধনে সক্ষম। মৃত্তিকাগুলোতে জৈব পদার্থ, নাইট্রোজেন, ফসফেট ও ক্যালসিয়ামের (lime) অভাব রয়েছে।
সারণি সেভেন সয়েল ট্র্যাক্ট-এর সঙ্গে ভূ-প্রাকৃতিক একক ও জেনারেল সয়েল টাইপস-এর সহসম্পর্ক।
সয়েল ট্র্যাক্ট | ভূ-প্রাকৃতিক একক | জেনারেল সয়েল টাইপ |
১. মধুপুর অঞ্চল | মধুপুর গড় | লাল-বাদামি সোপান মৃত্তিকা |
২. বরেন্দ্র অঞ্চল | বরেন্দ্রভূমি গভীর লাল-বাদামি সোপান মৃত্তিকা | ধূসর সোপান মৃত্তিকা |
৩. গাঙ্গেয় পলল | গঙ্গা নদী পললভূমি আড়িয়াল বিলগোপালগঞ্জ-খুলনা পিট অববাহিকা | চুনযুক্ত গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকাএসিড-অববাহিকা এঁটেলপিট |
গঙ্গা কটাল পললভূমি | ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, অলবণাক্ত ফেইজ | |
(অলবণাক্ত অংশ) | ||
৪. তিস্তা পলি | পুরাতন হিমালয় পর্বত | কালো তরাই মৃত্তিকা |
পাদদেশীয় সমভূমি | চুনহীন বাদামি পললভূমি ও ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | |
তিস্তা পললভূমি | ধূসর পললভূমি এবং চুনহীন বাদামি পললভূমি মৃত্তিকা | |
চুনহীন গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | ||
চুনহীন পলল | ||
করতোয়া-বাঙ্গালী পললভূমি | চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা (লবণহীন ফেইজ) | |
চুনহীন পলল | ||
৫. ব্রহ্মপুত্র পলল | যমুনা পললভূমি | চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, অলবণাক্ত ফেইজ |
চুনহীন পলল | ||
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পললভূমি | চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | |
চুনহীন গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | ||
চুনহীন বাদামি পললভূমি মৃত্তিকা | ||
সিলেট অববাহিকা | এসিড অববাহিকা এঁটেল | |
পূর্বাঞ্চলীয় সুরমা-কুশিয়ারা | চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | |
পললভূমি | এসিড অববাহিকা মৃত্তিকা | |
মধ্য মেঘনা পললভূমি | চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, অলবণাক্ত ফেইজ | |
পুরাতন মেঘনা মোহনাজ | চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | |
পললভূমি | চুনহীন গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | |
নতুন মেঘনা মোহনাজ | চুনযুক্ত পলল | |
পললভূমি (উত্তর অংশ) | ||
চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি | ধূসর পাদদেশীয় মৃত্তিকা | |
ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | ||
উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় | ধূসর পাদদেশীয় মৃত্তিকা | |
পাদদেশীয় সমভূমি | ||
৬. উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চল | নতুন মেঘনা মোহনাজ পললভূমি | চুনহীন/চুনযুক্ত পলল, লবণাক্ত ফেইজ |
গঙ্গা কটাল পললভূমি (লবণাক্ত অংশ) | ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা, লবণাক্ত ফেইজ | |
সুন্দরবন | এসিড সালফেট মৃত্তিকা | |
চট্টগ্রাম উপকূলীয় সমভূমি (অংশ) | ধূসর পাদদেশীয় মৃত্তিকা | |
চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকা | ||
৭.পাহাড় অঞ্চল | উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় | বাদামি পাহাড়ি মৃত্তিকা |
বরেন্দ্র অঞ্চল এ অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত ভূতপূর্ব বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর ও বগুড়া জেলার প্রায় ১৩,০০০ বর্গ কিমি এলাকা। এ অঞ্চলটি একটি পুরাতন পাললিক স্তরসমষ্টিতে অন্তর্ভুক্ত, যা সাধারণত ফ্যাকাশে লালচে বাদামি রঙের সংহত মৃণ্ময় (agrillaceous) স্তর দিয়ে গঠিত এবং এসব বস্ত্ত প্রায়ই অবক্ষয়ের ফলে হলুদাভ রঙে পরিণত হয়। সমগ্র মৃত্তিকা জুড়ে চুনের গুটি এবং কূর্মান্ডক (pisolitic) লৌহময় অনুস্তরণজাত পিন্ড দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে মৃত্তিকা চুনসমৃদ্ধ। মৃত্তিকার পি.এইচ পরিসর ৬.০ থেকে ৭.৫ এর মধ্যে। মৃত্তিকাতে নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের অভাব রয়েছে।
তিস্তা পলি ভূতপূর্ব বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ অঞ্চলটি গঠিত। এই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত এলাকার পরিমাণ প্রায় ১৬,০০০ বর্গ কিমি। মৃত্তিকার গ্রথন প্রধানত বেলে দোঅাঁশ। পৃষ্ঠমৃত্তিকার পি.এইচ মানের পরিসর ৫.৫ থেকে ৬.৫। মৃত্তিকাগুলো সাধারণত উর্বর এবং পটাশ ও ফসফেট সমৃদ্ধ।
ব্রহ্মপুত্র পলল এই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত এলাকা ভূতপূর্ব বৃহত্তর কুমিলা, নোয়াখালী ও পাহাড়ী এলাকা ব্যতীত সিলেট জেলা এবং ভূতপূর্ব ময়মনসিংহ, ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলার অংশবিশেষ। এর আওতাধীন এলাকা ৪০,০০০ বর্গ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রাধান্য বিস্তারকারী মৃত্তিকা গ্রথন হলো বেলে দোঅাঁশ। মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য এসিডীয় এবং পি.এইচ মানের বিস্তার ৫.৫ থেকে ৬.৮। মৃত্তিকাগুলো প্রকৃতিগতভাবেই উর্বর এবং প্রতিবছর বন্যার পানিবাহিত নবীন পলি যুক্ত হয়ে এইসব মৃত্তিকার উর্বরতা শক্তি রক্ষিত হয় বা বৃদ্ধি পায়।
গাঙ্গেয় পলল এই পললে অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলো হলো ভূতপূর্ব বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা এবং রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ। প্রায় ২৭,০০০ বর্গ কিমি নিয়ে এ অঞ্চলটি গঠিত। এটি গাঙ্গেয় সমভূমির নদীজাত (riverine) ভূমির প্রতিনিধিত্ব করে। মৃত্তিকার গ্রথন এঁটেল দোঅাঁশ থেকে বেলে দোঅাঁশের মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শন করে। মৃত্তিকার পি.এইচ মানের পরিসর ৭.০ থেকে ৮.৫। মৃত্তিকাগুলো মাঝারি মানের উর্বরতাসম্পন্ন এবং এসব মৃত্তিকাতে ক্যালসিয়াম কার্বনেট বিদ্যমান এবং ফসফেট ও পটাশিয়ামের পরিমাণও বেশি।
উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চল ভূতপূর্ব বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত। এই এলাকায় অন্তর্ভুক্ত ভূমির পরিমাণ প্রায় ২০,০০০ বর্গ কিমি। এটি উপকূলীয় বলয় বরাবর এবং মোহনাজ দ্বীপমালার সমতল নিচু এলাকার প্রতিনিধিত্ব করে। মৃত্তিকাগুলো লবণাক্ত এবং পি.এইচ মান নিরপেক্ষ থেকে মৃদু ক্ষারীয়। মৃত্তিকাগুলোতে পটাশ ও ফসফেটের পরিমাণ বেশি। এই অঞ্চলেই সুন্দরবন অবস্থিত।
পাহাড় অঞ্চল এই অঞ্চলটি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ভূতপূর্ব বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড় নিয়ে গঠিত। পাহাড় অঞ্চলে প্রায় ১৫,০০০ বর্গ কিমি এলাকা অন্তর্ভুক্ত। মৃত্তিকাগুলো শক্ত লাল এঁটেল ও সেইসঙ্গে একই রঙের মিহি বালির মিশ্রণ দিয়ে গঠিত এবং মৃত্তিকাতে বিদ্যমান গুটিগুলোতে অধিক পরিমাণে সেসকুইঅক্সাইড (sesquioxides) থাকে। মৃত্তিকাগুলো মধ্যম থেকে তীব্র এসিডীয়। মৃত্তিকাগুলো অধিক ক্ষালিত এবং স্বাভাবিক উর্বরতা মাত্রা কম। পাহাড়গুলো সাধারণত প্রাকৃতিক ও আবাদি বনবৃক্ষের অধীনে অবস্থিত। স্থানান্তর প্রথায় চাষও কোন কোন এলাকায় করা হয়।
সেভেন সয়েল ট্র্যাক্ট এবং এর পরবর্তীকালে সম্প্রসারিত ভূ-প্রাকৃতিক একক ও উপ-একক এবং জেনারেল সয়েল টাইপস-এর মধ্যে সহসম্পর্ক সারণিতে প্রদান করা হলো। [মোঃ সিরাজুল ইসলাম]