সুভাষিতরত্নকোষ

সুভাষিতরত্নকোষ বৌদ্ধ পন্ডিত বিদ্যাকর সংকলিত সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ। এগারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আনুমানিক ১১৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যাকর বাংলায় অবস্থান করেন। তিনি ১১০০ খ্রিস্টাব্দের অল্প কিছু পূর্বে সহস্রাধিক শ্লোক সম্বলিত এ সংকলনের প্রথম সংস্করণ প্রস্ত্তত করেন। মধ্য তিববতের নগোর (Ngor) মঠ হতে প্রথম সংস্করণের তালপাতার পান্ডুলিপিটি আবিষ্কৃত হয়। বিদ্যাকর কর্তৃক সুভাষিতরত্নকোষের ১৭৩৮ শ্লোক সম্বলিত দ্বিতীয় সংস্করণের সংকলন সম্পন্ন হয় অনতিক্রান্ত ১১৩০ খ্রিস্টাব্দে। নেপালের রাজগুরু পন্ডিত হেমরাজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ হতে এই বর্ধিত সংস্করণের কাগজের পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে। ডি.ডি কোশাম্বী তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, তালপাতার পান্ডুলিপির অংশবিশেষ হতে ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ শিরোনামে ১৯১২ সালে এফ.ডব্লিউ থমাস কর্তৃক প্রকাশিত সংস্কৃত শ্লোক সম্বলিত সংকলন সুভাষিতরত্নকোষের দ্বিতীয় সংস্করণের প্রতিনিধিত্ব করছে।

সুভাষিতরত্নকোষের সংকলক বিদ্যাকর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। ডি.ডি কোশাম্বীর গবেষণা সূত্রে জানা যায় যে, তিনি ছিলেন বরেন্দ্রে অবস্থিত জগদ্দল মহাবিহারের একজন ভিক্ষু। সুভাষিতরত্নকোষ কাব্যগ্রন্থ সংকলনের জন্য তিনি উল্লিখিত বিহারের গ্রন্থাগারে রক্ষিত পান্ডুলিপিসমূহ ব্যবহার করেন। বিদ্যাকর কর্তৃক উদ্ধৃত বেশ কিছু শ্লোকের বর্ণনা থেকে জগদ্দল বিহারের গ্রন্থাগার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শ্লোকগুলির বিন্যাস থেকে মনে হয় যে, বিদ্যাকর এক দীর্ঘ সময় ধরে কাব্যগ্রন্থটি সংকলন করেন। এটি ছিল সম্ভবত তাঁর সারা জীবনের লব্ধ ফসল। সম্ভবত বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধধর্মের পতন এবং উত্তর ও পশ্চিম বাংলায় মুসলমানদের অভিযান ও দখলের সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু ভিক্ষু সুভাষিতরত্নকোষ-এর পান্ডুলিপিসহ আরও বেশ কিছু পান্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ তিববত ও নেপালের দিকে চলে যান।

সুভাষিতরত্নকোষের ২৭৫ জন লেখক বা কবির মধ্যে মাত্র এগারো জনকে সাত শতকের পূর্বেকার বলে মনে হয়। আবার বিদ্যাকরের পছন্দের লেখকগণ ছিলেন স্থানিক ও কালিক বিবেচনায় তাঁর সমসাময়িক ও ঘনিষ্ঠ জন। বল্লন, যোগেশ্বর, বসুকল্প, মনবিনোদ, অভিনন্দ প্রমুখ প্রত্যেকেই ছিলেন বাংলার অধিবাসী অথবা অন্তত পাল সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলবাসী (বাংলা ও বিহারের মূল ভূ-খন্ড নিয়ে গঠিত পাল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত)। মাঝে মাঝে ও অপেক্ষাকৃত কম উদ্ধৃত লেখকদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন পাল রাষ্ট্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজকুমার ও পুরোহিত যাদের শ্লোক অপরাপর কোন গ্রন্থে পাওয়া যায় না। এঁদের মধ্যে ছিলেন  ধর্মপাল, রাজ্যপাল, বুদ্ধকরগুপ্ত, খিপক এবং জ্ঞানশ্রী। যদিও বিদ্যাকর ধ্রুপদী লেখক, যেমন কালিদাস, রাজশেখর এবং ভবভূতির শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন, তথাপিও তিনি প্রাচ্যদেশীয় অথবা বাঙালি কবিদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। ৭০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের সময়কার লেখকদের মধ্যে তাঁর পছন্দের লেখকদের শ্লোক তিনি উদ্ধৃত করেছেন। তাই সুভাষিতরত্নকোষ সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্য ধ্রুপদী যুগের (৭০০-১০৫০ খ্রি) একটি কাব্য সংকলন।

চার ধরনের উৎস থেকে শ্লোক নিয়ে বিদ্যাকর সেগুলির বিন্যাস ঘটান - মহাকাব্য, নাটিকা, ছোট কাব্য এবং বাছাইকৃত কাব্য সংকলন ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শ্লোকসমূহ। তিনি মূলত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন নাটিকা, ছোট কাব্য এবং কাব্য সংকলনসমূহ থেকে। সুভাষিতরত্নকোষে রয়েছে ৫০টি ব্রজ্য অথবা অংশ। সংস্কৃত সাহিত্যকর্মের সাধারণ রীতি-নীতি অনুসরণে তিনি শুরুতেই আশীর্বাদমূলক শ্লোক বিন্যস্ত করেন। একজন বৌদ্ধভিক্ষু হিসেবে এরপর তিনি বুদ্ধের প্রশংসা করেন (সেকশন ১)। বুদ্ধের প্রশংসাসূচক শ্লোকসমূহের পর বোধিসত্ত্ব লোকেশ্বর এবং বোধিসত্ত্ব মঞ্জুঘোষ-এর ওপর শ্লোক বিন্যস্ত করেন (সেকশন ২ ও ৩)। বিদ্যাকর গৌতম বুদ্ধের প্রশংসাসূচক শ্লোকের চেয়ে হিন্দু দেবতাদের প্রশংসামূলক শ্লোক বেশি উদ্ধৃত করেন (সেকশন ৪-৭)। ৮-১৩ নং সেকশনে বিভিন্ন ঋতুর ওপর শ্লোক বিন্যস্ত হয়। প্রেমের কবিতার প্রতি বিদ্যাকরের পছন্দের প্রকাশ ঘটেছে ১৪-২৬ নং সেকশনের প্রেমমূলক শ্লোকসমূহে। সুভাষিতরত্নকোষ কাব্য-সংকলনে পল্লীর মাঠ-ঘাট সংক্রান্ত শ্লোক রয়েছে ১২, ১৩, ও ৩৫ নং সেকশনে। এই সকল শ্লোক সমকালীন সমাজের ওপর আলোকপাত করে। যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শৌর্য-বীর্যের ওপরও শ্লোক রয়েছে ৪৫-৪৬ সেকশনে। ৪৯ নং সেকশনে (বিবিধ শিরোনামধারী) হরি-হর-এর ওপর শ্লোক (প্রেম ও নীতিবাক্য সংক্রান্ত শ্লোকসমূহ) পাওয়া গেছে যা পার্থিব জ্ঞানের বিভিন্ন দিক শিক্ষা দিত। শেষ ব্রজ্যে (৫০ নং সেকশন) কবিদের প্রশংসা করা হয়েছে। এর একাধারে সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে।

সংস্কৃত সাহিত্যে প্রাচীন বাংলার অবদানের প্রমাণ হচ্ছে বিদ্যাকরের এই কাব্য সংকলন। এর মধ্যে প্রাচীন বাংলার আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের মূল্যবান তথ্যও বিধৃত রয়েছে। সংস্কৃত শ্লোকের প্রাচীনতম সাধারণ কাব্য সংকলন হিসেবে এটি আজো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেনযুগের সভাকবি গোবর্ধনাচার্য (আর্যাসপ্তশতী) এবং শ্রীধরদাস (সদুক্তিকর্ণামৃত) এই ঐতিহ্যকেই ধারণ এবং সংস্কৃত সংকলন সাহিত্যকে (কোষকাব্য) সমৃদ্ধ করেন।  [শাহানারা হোসেন]

গ্রন্থপঞ্জি  DD Kosambi and Gokhale (ed), The Subhasitaratnakosa, Harvard Oriental Series, 42, 1957; HH Ingalls (tr), An Anthology of Sanskrit Court Poetry, Vidyakara’s ‘Subhasitaratnakosa’, HOS, 44, 1965.