সুজাউদ্দীন মসজিদ

সুজাউদ্দীন মসজিদ  ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার দহপাড়ায় অবস্থিত। নওয়াব  মুর্শিদকুলী খানএর জামাতা ও উত্তরসূরি নওয়াব  সুজাউদ্দীন মুহম্মদ খান (১৭২৭-১৭৩৯) কর্তৃক নির্মিত এই স্থানটি ফারহাবাগ বা ‘আনন্দ বাগান’ (The garden of joy) হিসেবে পরিচিত।

দুর্ভাগ্যক্রমে ফারহাবাগ বর্তমানে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে এবং নদীটি মসজিদটির অর্ধেক অংশ গ্রাস করে ফেলেছে। তবে নওয়াব সুজাউদ্দীনের সমাধির উত্তর দিকে অবস্থিত রোশনিবাগ-এর প্রাচীর ঘেরা বাগান চত্বরের মধ্যে এখনও একটি মসজিদ টিকে আছে। বর্তমানে এটিই সুজাউদ্দীনের মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদটির পূর্বদিকের সম্মুখভাগে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুসারে জনৈক মহবত জং ১১৫৬ হিজরিতে (১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ) এটি নির্মাণ করেন। উল্লিখিত শিলালিপির সর্বশেষ শব্দটির সংখ্যাসূচক মানের উপর ভিত্তি করে এ তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছে। মহবত জং ছিল নওয়াব আলীবর্দী খানের উপাধি। তিনি ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের নওয়াব ছিলেন। তাই অনুমান করা যেতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর চার বছর পর আলীবর্দীই এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।

সুজাউদ্দীনের মসজিদই মুর্শিদাবাদে ঢাকা ও রাজমহলের মুগল স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে নির্মিত প্রাচীনতম এক-আইলবিশিষ্ট আয়তাকার মসজিদ। এর পূর্বদিকের দেওয়ালে রয়েছে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ এবং তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পশ্চিম দেওয়ালের ভেতরের অংশে তিনটি কুলুঙ্গিকৃত মিহরাব নির্মিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথ এবং কেন্দ্রীয় মিহরাব পার্শ্ববর্তী প্রবেশপথ এবং মিহরাব অপেক্ষা বৃহত্তর। এছাড়া কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি বপ্র (Parapet) পর্যন্ত উঁচু একটি আয়তাকার প্রক্ষেপণের ভিতরে স্থাপিত। এই প্রক্ষেপণের দুপ্রান্তে রয়েছে একটি করে সরু অষ্টভুজাকার মিনার। মিনারগুলি বপ্র ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে এবং এগুলির শীর্ষে রয়েছে গুলদস্তা-র আলঙ্কারিক কারুকার্য। ইমারতটির চার কোণে সংযুক্ত হয়েছে বপ্র ছাড়িয়ে উপরে উঠে যাওয়া চারটি সরু অষ্টভুজাকার বুরুজ (Turret)। এগুলির মধ্যবর্তী অংশে রয়েছে কয়েক সারি ব্যান্ড ও ছাঁচে ঢালা নকশা, আর শীর্ষে রয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজে আচ্ছাদিত নিরেট ছত্রী। দেওয়াল থেকে খানিকটা ভেতরের দিকে স্থাপিত ব্যাসাল্ট পাথরে তৈরি এককেন্দ্রিক প্রবেশপথ তিনটির উপরে রয়েছে বৃত্তাকার খাঁজকাটা খিলান। ইতঃপূর্বে মুর্শিদাবাদে নির্মিত  কাটরা মসজিদ (১৭২৪-২৫) ও আজিমুন নিসা বেগমের মসজিদেও এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। তবে সুজাউদ্দীনের মসজিদের ক্ষেত্রে প্রবেশপথের উপরের এই বহুখাঁজবিশিষ্ট খিলানগুলি দেওয়াল সংলগ্ন স্তম্ভের উপর স্থাপিত, যা পূর্বোক্ত মসজিদদ্বয়ে ব্যবহূত হয় নি। মসজিদটির সম্মুখভাগের নির্মাণশৈলীও বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের খিলানটির উপরে রয়েছে দেওয়াল সংলগ্ন স্তম্ভের উপরে স্থাপিত দো-চালা আচ্ছাদনের নকশা। পাশের দুটি ‘বে’র প্রবেশপথের উপরেও রয়েছে অনুরূপ নকশা। কেবল এ ক্ষেত্রে মোটিফটি দো-চালা নয় চার-চালা। লক্ষণীয় যে, পশ্চিম দেওয়ালে মিহরাবের পেছনের প্রক্ষিপ্ত অংশেও অনুরূপ দো-চালা নকশা ব্যবহূত হয়েছে। এই রীতি বাংলা অঞ্চলে এখানেই প্রথম লক্ষ্য করা যায়।

মসজিদে আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে তিনটি গম্বুজ। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড়। এর দু পাশের ছোট গম্বুজদুটি দেখতে চার-চালা আকৃতির। কেন্দ্রীয় গম্বুজটি অর্ধ গোলাকার ও খাঁজকাটা। একটি অষ্টকোণাকৃতি পিপার উপর স্থাপিত এই গম্বুজের শীর্ষে রয়েছে পদ্ম-কলস নকশা শোভিত শীর্ষচূড়া (Finial)। মসজিদটির কার্নিস ও বপ্র চমৎকারভাবে অলংকৃত এবং দুটি স্তরে বিভক্ত। স্তরদুটির মধ্যবর্তী অংশে দর্শনীয় একটি ব্যান্ড নকশা নির্মাণের মাধ্যমে এগুলিকে পরস্পর থেকে পৃথক করা হয়েছে।  [সুতপা সিনহা]