সিং, অনন্ত
সিং, অনন্ত (১৯০৩-১৯৭৯) বিপ্লবী, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অন্যতম নায়ক এবং রাজনীতিবিদ। ১৯০৩ সালের ১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের আগ্রা অঞ্চলের বাসিন্দা।
অনন্ত সিং-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি নয়। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের সংস্পর্শে আসেন। সূর্যসেন তাঁর অসাধারণ সাহস, সাংগঠনিক দক্ষতা, শৌর্যবীর্য, বুদ্ধিমত্তা এবং কর্মোদ্যোগ দেখে মুগ্ধ হন। এ সুযোগে অনন্ত সিং সূর্যসেনের একজন ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বাসভাজন সহকর্মীর মর্যাদা লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি বিপ্লবীদলে ঢুকে পড়েন, আর পড়াশোনারও ইতি ঘটে। অনন্ত সিং ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা এবং শরীরচর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন, তাই বিপ্লবীকর্মে তা সহায়ক হয়।
ছোটবেলা থেকেই অনন্ত সিং-এর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বা আন্দোলনের মনোভাব প্রকাশ পায়। তাঁরই নেতৃত্বে স্কুলের সহপাঠীরা ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়, যদিও তিনি নিজে সে আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করা হলে তিনি বিপ্লবী আন্দোলনকে আরও জোরদার করার ব্যাপারে সচেষ্ট হন। প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য তিনি নিজেই বোমা ও কার্তুজ বানাতেন। এ বিদ্যা তিনি স্কুলজীবনে অর্জন করেন। তাঁর উদ্ভাবিত বোমা বানানোর ফরমুলা জনৈক সাহেবের নামে প্রকাশিত হয়ে তা এক সময় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
বিপ্লবীকর্মে অর্থসংস্থানের জন্য একবার তিনি আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করার উদ্যোগ নেন। এতে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ হয় এবং পুলিশকে পরাজিত করে তাঁরা পাহাড়ে পালিয়ে যান। পরে সন্দ্বীপ হয়ে কলকাতায় গেলে সেখানে পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়েন। এবার ছাড়া পেলেও বিপ্লব কর্মকান্ডের জন্য ১৯২৪ সালে তিনি পুনরায় ধরা পড়েন এবং তাঁর চার বছরের জেল হয়। জেল থেকে বের হয়ে অনন্ত সিং তাঁর বিপ্লবের কৌশল পরিবর্তন করেন। তিনি একটি ব্যায়ামাগার স্থাপন করে কৌশলে যুবকদের এনে বিপ্লবে দীক্ষা দেন। এভাবে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিপ্লবকে সংগঠিত করেন। তাঁর এ সংগঠননৈপুণ্য এবং সুচতুর পরিকল্পনা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনকে অনেকাংশে সফল করে তোলে। এ সময় চট্টগ্রাম শহর চারদিন ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল।
অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনায় অনন্ত সিং-কে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতছাড়া হলে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে তিনি ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে আশ্রয় নেন। কিন্তু অন্যান্য সহকর্মীদের বিচার ও জেলে তাঁদের ওপর অত্যাচারের খবর শুনে তিনি খুবই বিচলিত বোধ করেন। তাই কলকাতা গিয়ে পুলিশ কমিশনারের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। পুলিশ তাঁকে জেলে পাঠালেও সেখানে তিনি নিশ্চেষ্ট বসে থাকেননি। চট্টগ্রামের ঘটনা নিয়ে কোর্টে যখন মামলা চলছিল তখন তিনি জেলের ভিতর সুড়ঙ্গ কেটে বোমা মেরে জেল উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু জেলের প্রাচীরে ডিনামাইট পাতানোর সময় পুলিশ দেখে ফেলায় তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে এ ঘটনার পরে ইংরেজ সরকার বিপ্লবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় এবং কারও কারও মতে এসব কারণেই চট্টগ্রাম মামলায় অভিযুক্ত কারও ফাঁসি হয়নি। বিচারে যে দশজনের দ্বীপান্তর হয় অনন্ত সিং ছিলেন তাঁদেরই একজন। ১৯৩২ সালে তাঁদের আন্দামান সেলুলার জেলে পাঠানো হলে জেলের মধ্যে তিনি অনশন শুরু করেন। শেষে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজী প্রমুখের সহায়তায় তাঁদের স্বদেশের কারাগারে ফিরিয়ে আনা হয়। অনন্ত সিং স্বাধীনতার আগের বছর ১৯৪৬ সালে জেল থেকে মুক্তি পান।
জেলে থাকা অবস্থায় অনন্ত সিং-এর রাজনৈতিক মতবাদের পরিবর্তন ঘটে। সেখানে বসে তিনি মার্ক্সীয় সাহিত্য ও দর্শন পড়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং জেল থেকে বের হয়ে কম্যুউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। এ সময় তিনি অবশ্য সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে ছিলেন। কিছুদিন তিনি চলচ্চিত্র এবং মোটর ব্যবসায়ও নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ যে, বিপ্লবী আন্দোলনের সময় কৃত ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগে স্বাধীন দেশেও তাঁকে দীর্ঘ আট বছর (১৯৬৯-৭৭) কারাগারে থাকতে হয়। এ সময় তিনি হূদরোগে আক্রান্ত হন এবং অসুস্থতার কারণে মৃত্যুর কয়েকমাস পূর্বে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
অনন্ত সিং দীর্ঘজীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতা দিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ, অগ্নিগর্ভ চট্টগ্রাম, মাস্টারদা, স্বপ্ন ও সাধনা, আমি সেই মেয়ে, কেউ বলে ডাকাত কেউ বলে বিপ্লবী প্রভৃতি। অনন্ত সিং-এর জ্যেষ্ঠা ভগিনী ইন্দুমতীও ছিলেন একজন বিপ্লবী নারী। তিনি অস্ত্র চালাতে জানতেন এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য জেলও খেটেছেন। অনন্ত সিং বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁর নিকট থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছেন। ১৯৭৯ সালের ২৫ জানুয়ারি অনন্ত সিং মৃত্যুবরণ করেন। [দুলাল ভৌমিক]