সাংবিধানিক আইন

সাংবিধানিক আইন সংবিধানভিত্তিক আইন, সুপ্রীম কোর্টের বিভিন্ন রায়, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন আদেশ (১৯৭২), সংসদ কার্যপ্রণালীবিধি ও সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির সাথে আলোচনা-পরামর্শের প্রথাসহ বিভিন্ন নিয়মতান্ত্রিক কনভেনশন বা প্রথা এ আইনের আওতাভুক্ত। রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭২ সনের নভেম্বরে গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ এবং ১১টি প্রধান ভাগে বিন্যস্ত ৪টি তফসিল রয়েছে। শুরুতে সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে মূল রাষ্ট্রীয় নীতি বলে ঘোষণা করা হয়। সংবিধানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, যে সমাজ বা দেশে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা, সমতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।

সংবিধানের প্রথমভাগে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম একক প্রজাতন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ আইন বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে সংগতিহীন হলে সে আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হবে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্রপরিচালনার যে মূলনীতিসমূহ বর্ণিত হয়েছে তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো নির্ধারিত আছে। মূলনীতিসমূহ বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে বলবৎযোগ্য না হলেও এগুলো রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থার মৌলিক বিষয়। এগুলো সাধারণ আইনসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ সংবিধানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নির্দেশকরূপে কাজ করে। আদালতকে এসব নীতিমালার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হয় এবং আদালত সংবিধানের কোনো বিধানকে এসব নীতিমালার পরিপন্থী হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না, যদি না এই বিধানের ভাষা আদলতকে এই সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারে যে ওই বিশেষ ক্ষেত্রে সংবিধানপ্রণেতাগণ অনুরূপ ব্যতিক্রমের অবকাশ রেখেছেন।

সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহ। এ অধিকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা যায় না কিংবা এ অধিকার ক্ষুণ্ণ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকার, ধর্ম, গোষ্ঠী, জাতবৈষম্য, নারী-পুরুষভেদ ও জন্মস্থানের কারণে বৈষম্য থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার, সরকারি চাকুরিতে সমান সুযোগ লাভের অধিকার, অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সমিতিবদ্ধ বা সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ), পেশা বা জীবিকার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সম্পত্তিতে অধিকার, বাসগৃহে একান্ততা ও পত্রযোগাযোগের নিরাপত্তালাভের অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে। জীবনের নিরাপত্তা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, যথেচ্ছ গ্রেপ্তারি ও আটক থেকে রক্ষা, বাধ্যতামূলক শ্রম থেকে রক্ষা এবং বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে রক্ষা পাওয়ার অধিকার নাগরিক ও অনাগরিক উভয় শ্রেণীর বাসিন্দাদের প্রাপ্য, যার মধ্যে রয়েছে ভূতাপেক্ষ দন্ডমূলক আইনসমূহ, দ্বৈত বিপদ, নিজে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবং নিষ্ঠুর ও অমানুষিক শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার। ৩১ অনুচ্ছেদ বিশেষ করে সকল নাগরিকের আইনানুগ আচরণ লাভের অধিকার নিশ্চিত করেছে, যে আইনে আরও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ঊর্ধ্বতন আদালত কর্তৃক নির্ধারিত স্বাভাবিক বিচারের নীতিমালার মতো বিচারবিভাগীয় নীতিমালা। তবে সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশবাহিনী প্রভৃতি নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নিয়ম-শৃঙ্খলার সাথে সম্পর্কিত আইন এ আইনের আওতাবহির্ভূত। বাংলাদেশের সংবিধানের মূলপাঠে একটি সংসদীয় সরকারের ব্যবস্থা ছিল। ১৯৭৫ সনের জানুয়ারি মাসে গৃহীত ৪র্থ সংশোধনীর বিধানসমূহের আওতায় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে ১৯৯১ থেকে সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিধানাবলি সন্নিবেশিত হয়।

রাষ্ট্রপতি সংসদ-সদস্যদের দ্বারা পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হন। তিনি আদালতের (বিচার) প্রক্রিয়ার অধীন নন, কেবল সংসদে অভিশংসনের মাধ্যমে তাঁকে তাঁর পদ থেকে অপসারিত করা যায়। প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বেলায় রাষ্ট্রপতির নিজ বিচার-বিবেচনা প্রয়োগের এখতিয়ার রয়েছে। অন্যান্য সকল বিষয়ে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। সকল নির্বাহী কার্যব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির নামে গ্রহণ করতে হয়, তবে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রিবর্গ সংসদের কাছে দায়বদ্ধ। সংসদে কোনো অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের অবশ্যই পদত্যাগ করতে হয়। রাষ্ট্রপতির রয়েছে জরুরি পরিস্থিতিতে অধ্যাদেশ প্রণয়নের বিধানিক ক্ষমতা, তৎসহ সংবিধান ও বিভিন্ন আইনে প্রদত্ত কর্তৃত্বাধিকারবলে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা। তিনি ক্ষমা মঞ্জুর ও দন্ড বিলম্বিত করার ক্ষমতারও (অনুচ্ছেদ ৪৮-৫৮-ক) অধিকারী। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতি, অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূণ্য হলে জাতীয় সংসদের স্পীকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

সংবিধান জনসাধারণের  নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রশাসনের সকল স্তরে তাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রেখেছে। তাই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হবে এবং এসব  প্রতিনিধি স্থানীয় পর্যায়ে কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ কতিপয় নির্বাহী কার্য সম্পাদন করবেন (অনু. ৬০)।

প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণ কর্তৃক সরাসরি নির্বাচিত তিন শ’ সদস্য নিয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত। সংসদের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মহিলাদের জন্য ৪৫টি সংরক্ষিত আসন। এসব সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্যরা সংসদে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন (অনু. ৬৫)। সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনে নির্বাচিত সদস্যদের ভোটে একজন স্পীকার ও একজন ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন (অনু. ৭৪)। স্পীকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পীকার সংসদের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। সংসদীয় কার্যপ্রণালীবিধির আওতায় সংসদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক ক্ষমতা স্পীকারের রয়েছে। কার্যপদ্ধতিগত আইন এবং সংসদের বিধি ও রীতির সাধারণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান স্পীকারের কাজ বলে মনে করা হয় এবং তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গ্রহণ ছাড়া তাঁর নিজের দেওয়া কোন রুলিং-এর ওপর কোনো বিতর্ক অনুষ্ঠান বা সমালোচনার অনুমতি প্রদান করেন না।

রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহবান, মুলতবি এবং এর বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। সংসদের এক অধিবেশন থেকে পরবর্তী অধিবেশনের মধ্যে ৬০ দিনের বেশি বিরতি থাকতে পারে না (অনু. ৭২)। কেবলমাত্র সংবিধানে নির্ধারিত সীমাবদ্ধতা ছাড়া প্রজাতন্ত্রের বিধানিক ক্ষমতা সংসদের এখতিয়ারে ন্যস্ত থাকবে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সকল বিষয়ে বিস্তারিত আইন প্রণয়নের সময় বা দক্ষতা সংসদের নেই। অনেক ক্ষেত্রেই সংসদ আইনের রূপরেখা পাস করে এবং এর বিস্তারিত বিষয়াদি প্রণয়নের দায়িত্ব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়। সংবিধান প্রকাশ্যে এই আইন প্রণয়ন ক্ষমতা অর্পণের অনুমোদন দেয় (অনু. ৬৫)। সরকারি অর্থসংস্থান ও করারোপের ক্ষেত্রে সংসদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। সংসদের কোনো আইন দ্বারা প্রদত্ত কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো কর আরোপ করা কিংবা আদায় করা যায় না (অনু. ৮৩)। বাজেট নির্ধারণ করার একচেটিয়া ক্ষমতা রয়েছে সংসদের (অনু. ৮৭) এবং সংসদ কর্তৃক পাসকৃত কোন উপযোজন আইনের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রদত্ত না হলে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারেন না (অনু. ৯০)। সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এ মর্মে বিধান রয়েছে যে, যদি কোনো সংসদ-সদস্য সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন, কিংবা সংসদে যে দলের মনোনয়নক্রমে নির্বাচিত হয়েছেন সে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে (অনু. ৭০)। এ বিষয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে স্পীকার সিদ্ধান্তের জন্য বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন [অনু. ৬৬ (৪)]।

জাতীয় সংসদের আলোচনায় অবাধ মত প্রকাশের সুবিধার জন্য সংবিধান এর সদস্যদের  কতিপয় অধিকার ও অব্যাহতি প্রদান করে। কোনো আদালতে সংসদের কার্যাবলির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না; সংসদের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সংসদের সদস্য ও কর্মকর্তারা কোনো আদালতের এখতিয়ারাধীন হবেন না। সংসদ-কক্ষে কিংবা সংসদীয় কোনো কমিটিতে কিংবা সংসদীয় কার্যাবলির ওপর সংবাদপত্রে কোনো অনুমোদিত রিপোর্ট প্রকাশের জন্য কোনো সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার জন্য সংসদ-সদস্য ও সংসদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো কুৎসা বা অবমাননা কিংবা আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করা যাবে না (অনু. ৭৮)। তবে সংবিধানের ৭৬ ও ৭৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুসারে অতিরিক্ত অধিকার ও দায়মুক্তিমূলক সুবিধাদি প্রদানপূর্বক সংসদীয় কার্যপ্রণালীবিধি বা সংসদ কর্তৃক অন্য কোনো আইন প্রণীত হলে সে আইনকে অবশ্যই সংবিধানের তৃতীয় অংশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে, যাতে কতক মৌলিক অধিকার সন্নিবেশিত রয়েছে।

সংসদ মোট সদস্য-সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংবিধানের বিধানাবলি সংশোধন করতে পারে (অনু. ১৪২), তবে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংসদ সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যাবলির কোন পরিবর্তন করতে পারে না। সাধারণত জনগণের সার্বভৌমত্ব, সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব, সুপ্রীম কোর্টের বিচার পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনকে সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সনে সংবিধানবহির্ভূত পন্থায় সামরিক আইন ঘোষণা করা হয় এবং সংবিধানের ‘পঞ্চম’ ও ‘সপ্তম’ সংশোধনী দ্বারা আইন-কর্তৃপক্ষের  গৃহীত সকল পদক্ষেপকে বৈধতা দেয়া হয়।

সংসদের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর [অনু. ৭২(৩)]। এ মেয়াদ শেষে কিংবা যদি তারও আগে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে এরূপ ভেঙে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়। এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বতন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং অন্য অনধিক দশজন উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টাগণ পরবর্তী সংসদ গঠিত হবার পর (অধ্যায় ২ক) নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত দৈনন্দিন প্রশাসন পরিচালনায় যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিবর্গের দায়িত্ব পালন করেন। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের তাঁদের কার্যকালের মেয়াদে যে কারণে এবং যে পদ্ধতিতে সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতিকে অপসারণ করা যায় সেই কারণ ও পদ্ধতি ব্যতিরেকে অপসারণ করা যায় না (অনু. ১১৮)।

৭৭ অনুচ্ছেদে এ মর্মে বিধান রয়েছে যে, সংসদ কোনো মন্ত্রণালয়, কোনো সরকারি কর্মকর্তা কিংবা কোনো বিধিসম্মত সরকারি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত কোনো পদক্ষেপ সম্পর্কে তদন্তের জন্য অ্যাক্ট দ্বারা একজন ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করতে পারেন। যদিও ১৯৮০ সনে ‘ন্যায়পাল অ্যাক্ট, ১৯৮০’ নামক আইন পাস হয় এবং সরকারি গেজেট বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ আইন কার্যকর ও বলবৎ করার জন্য সরকারকে ক্ষমতা দেয়া হয়, তথাপি ন্যায়পালের পদটি এখনও পূরণ করা হয় নি।

প্রজাতন্ত্রের বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা বিচারবিভাগের উপর ন্যস্ত। সুপ্রীম কোর্ট ও তার অধস্তন আদালতগুলো নিয়ে এ বিচারবিভাগ গঠিত। সংবিধানের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত; এ আদালতের রয়েছে বিচার পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা। সুপ্রীম কোর্ট,  হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগ এ দুই বিভাগ নিয়ে গঠিত। (অনু. ৯৪) প্রতিটি বিভাগই একেকটি কোর্ট অব রেকর্ড এবং এর অবমাননার জন্য তদন্তের আদেশ দান বা দন্ডাদেশ দানের ক্ষমতাসহ আইন সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী থাকবে (অনু. ১০৮)। বিচার প্রশাসনে জনগণের আস্থা বহাল রাখার উদ্দেশ্যেই কেবল নয়, বরং সুপ্রীম কোর্ট প্রদত্ত আদেশ ও নির্দেশ বলবৎ করার জন্যও এ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

হাইকোর্ট বিভাগ বিধি মোতাবেক মামলা ও আবেদন গ্রহণ, আপীলের শুনানি গ্রহণ এবং অধস্তন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত ও বিচারকার্য সম্পাদনকারী অন্যান্য সংস্থার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন গ্রহণের এখতিয়ারপ্রাপ্ত (অনু. ১০১)। কতিপয় সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি ব্যতিরেকে হাইকোর্ট বিভাগ তার বিচারবিভাগীয় পুনর্বিবেচনার ক্ষমতাবলে, রাষ্ট্রের গৃহীত ব্যবস্থাদিতে যাতে সংবিধানের কোনো বিধান কিংবা দেশের আইনসমূহ লঙ্ঘিত না হয় সেজন্য যেমন রাষ্ট্রগৃহীত ব্যবস্থাদি পুনর্বিবেচনা করার অধিকারী, তেমনি মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষার গ্যারান্টি বিধায়ক বিধানাবলিসহ সংবিধানের যেকোন বিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ যেকোন আইন বাতিল করার ক্ষমতারও অধীকারী (অনু. ১০২)। হাইকোর্ট বিভাগ এ ক্ষমতার অনুশীলনক্রমে সার্টিওরারাই, ম্যান্ডামাস, নিষেধাজ্ঞা, হেবিয়াস কর্পাস ও কুও ওয়ার‌্যান্টো  প্রকৃতির রিট জারি করতে পারে। রাষ্ট্রের কোনো কাজে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিই কেবল হাইকোর্ট বিভাগ সমক্ষে রিট আবেদন পেশ করতে পারেন। তবে আপীল বিভাগ জনস্বার্থ সম্পর্কিত বিরোধের ক্ষেত্রে এ স্থায়ী বিধির পরিমার্জন করেছে। আপীল বিভাগ জনস্বার্থের বেলায় একজন সুপরিজ্ঞাত ব্যক্তি কর্তৃক গরিব ও অবহেলিত ব্যক্তিদের পক্ষে আদালতে তাদের অভাব-অভিযোগ ব্যক্ত করার এবং জনসাধারণের স্বার্থজড়িত অতীব গুরুত্বপূর্ণ  বিষয় আদালতে উত্থাপনের  অনুমতি দেয়।

আপীল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের বিভিন্ন রায়ের বিরুদ্ধে আনীত আপীল-আবেদনের শুনানি গ্রহণ করে। আইনে বিধান থাকলে আপীল বিভাগ প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের মতো যেকোন ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে আনীত আপীল-আবেদনের শুনানি গ্রহণ করতে পারে (অনু. ১০৩)। আপীল বিভাগের নিজ রায় বা আদেশ পুনর্বিবেচনা (অনু. ১০৫) ও পূর্ণাঙ্গ বিচার করার ক্ষমতা রয়েছে (অনু. ১০৪)। যখন রাষ্ট্রপতি চাইবেন তখন (অনু. ১০৬) জনগুরুত্বপূর্ণ আইনের বিষয়ে নানা প্রশ্নের ওপরেও নিজ অভিমত প্রদান করার এখতিয়ার এ আপীল বিভাগের রয়েছে। আপীল বিভাগের যেকোন রায় হাইকোর্ট বিভাগের জন্য অবশ্য পালনীয় এবং এ দুই ডিভিশনের যেকোন বিভাগের দেয়া রায় তাদের অধস্তন সকল আদালতের জন্য (অনু. ১১১) অবশ্য পালনীয় হবে। নির্বাহী বিভাগ সুপ্রীম কোর্টের সহায়তায় কাজ করতে বাধ্য, আর সে কারণেই সুপ্রীম কোর্টের রায়ের অধীন থাকতেও বাধ্য (অনু. ১১২)। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিগণ নির্বাহী কর্তৃপক্ষ বা সংসদ কর্তৃক বদলি বা অপসারণযোগ্য নন। প্রধান বিচারপতি ও তাঁর পরবর্তী দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে নিয়ে গঠিত সর্বোচ্চ বিচার পরিষদ সমক্ষে কোনো বিচারপতির দৈহিক বা মানসিক অসামর্থ্য কিংবা তার অসদাচরণ প্রমাণ করা গেলেই কেবল তাঁকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করা যাবে (অনু.  ৯৬)।

নির্বাহী সরকারের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখার জন্য সংবিধান রাজনৈতিক নির্বাহিগণ ছাড়াও সিভিল ও সামরিক পদধারী কর্মকর্তা দ্বারা নির্বাহী সরকার পরিচালনার ব্যবস্থা রেখেছে। সামরিক পদধারী ব্যক্তিদের চাকুরি বা সার্ভিসের শর্তাবলি ৬২ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে প্রণীত আইন অনুযায়ী নির্ধারিত হয় এবং এ ধরনের কোনো আইনের অবর্তমানে রাষ্ট্রপতি প্রণীত বিধির আওতায় নির্ধারিত হয়। অবশ্য, কোনো সামরিক পদাধিকারী কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতির সন্তোষানুযায়ী মেয়াদকালের জন্য স্বীয় পদে বহাল থাকবেন (অনু. ১৩৪)। একইভাবে, বেসামরিক কর্মকর্তারাও রাষ্ট্রপতির  সন্তোষানুযায়ী মেয়াদকালের জন্য তাদের নিজ নিজ পদে বহাল থাকবেন, তবে সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদে শর্ত আরোপিত আছে যে, বেসামরিক পদধারী কর্মকর্তাদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের চেয়ে অধস্তন কোনো কর্তৃপক্ষ তাদের পদচ্যুত বা অপসারিত করতে অথবা তাদের পদমর্যাদার অবনতি ঘটাতে পারবেন না এবং কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হবে না এ বিষয়ে কারণ দর্শানোর সুযোগ না দিয়ে তাদের শাস্তি প্রদান করা যাবে না। অসামরিক পদাধিকারীদের চাকুরির শর্তাবলি আইনের আওতায় সংসদ নির্ধারণ করবে এবং এধরনের আইন প্রণীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করবেন (অনু. ১৩৩)। চাকুরির শর্তাবলি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে অসামরিক পদাধিকারিগণ ১১৭ অনুচ্ছেদভিত্তিক আইনে গঠিত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল সমীপে প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারবেন এবং প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারাধীন কোনো বিষয়ে কোনো অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার হাইকোর্ট বিভাগসহ কোনো আদালতের নেই। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হতে পারে তখনই যখন সিভিল সার্ভিসের কোনো সদস্য কোনো আইন বা আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো দলিলের ভিত্তিতে তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হবার অভিযোগ করেন। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। আবার সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের সিদ্ধান্তক্রমে, প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধেও আপীল বিভাগে আপীল করা যাবে।

সংবিধানে সরকারি কর্মকমিশনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যার উপর প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োগের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচনের উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনা এবং প্রজাতন্ত্রের চাকুরি সংক্রান্ত নির্ধারিত বিভিন্ন বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দানের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এ কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য এই নিশ্চয়তাবিধান করা হয়েছে যে, কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের তাদের  কার্যকালের মেয়াদে একমাত্র সুপ্রীম কোর্টের বিচারককে যে যে কারণে ও পদ্ধতিতে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করা যায়, সে কারণ ও পদ্ধতি ছাড়া তাঁদের পদ থেকে অপসারণ করা যাবে না (অনু. ১৩৭-৩৯)।  [মাহমুদুল ইসলাম]