সরীসৃপ
সরীসৃপ Reptilia শ্রেণীর মেরুদন্ডী প্রাণীর। প্রাণিজগতে এদের অবস্থান উভচর ও পাখিদের মধ্যবর্তী। কাছিম ও কাউঠা, টিকটিকি, সাপ, কুমির এবং টুয়াটারা (Sphenodon) সরীসৃপ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এরা প্রধানত চতুষ্পদী, কিন্তু সাপ ও কিছু টিকটিকি উপাঙ্গহীন। এদের ত্বকের বহির্ভাগ বহিস্ত্বকীয় অাঁশে ঢাকা, যা ত্বককে আঘাত ও শুষ্কতা থেকে রক্ষা করে। কাউঠায় অন্তস্ত্বকীয় অাঁশ (ত্বকের নিম্নস্তরে) সর্বাধিক বিকশিত, যেগুলি পরস্পরের সঙ্গে ও পাঁজরের সঙ্গে মিশে গিয়ে খোলসের সৃষ্টি করে। কুমির, টুয়াটারা এবং কিছু টিকটিকিরও অন্তস্ত্বকীয় অাঁশ থাকে। র্যাটল সাপের ঘর্ঘর শব্দ উৎপাদক ‘র্যাটল’ আসলে পরিবর্তিত বহিস্ত্বকীয় অাঁশ। সরীসৃপের ফুসফুস থাকে। কতগুলি কাছিম বেশি সময় পানির নিচে থাকার জন্যে গলবিলীয় শ্বসনের মাধ্যমে সম্পূরক অক্সিজেন সংগ্রহ করে। সরীসৃপের হূৎপিন্ড ৩টি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত, ব্যতিক্রম কুমির, তাদের হূৎপিন্ড চার প্রকোষ্ঠের। বহু সরীসৃপ আত্মরক্ষার্থে দুর্গন্ধ নিঃসরণ করে বা যৌন আকর্ষণার্থে সুগন্ধ ছড়ায়। একদল টিকটিকি ও কয়েক দল সাপের উপরের চোয়ালে বিষগ্রন্থি থাকে।
সম্ভবত ৩০ কোটি বছর আগে সরীসৃপের উদ্ভব ঘটেছিল। ডাইনোসরও সরীসৃপ, প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশে সর্বমোট সরীসৃপ প্রজাতির সংখ্যা ১২৬। এসব সরীসৃপ প্রজাতির মধ্যে আছে ২ প্রজাতির কুমির, ২১ প্রজাতির কাছিম ও কাইট্টা, ১৮ প্রজাতির টিকটিকি ও ৬৭ প্রজাতির সাপ এবং সামুদ্রিক সরীসৃপের মধ্যে ১২ প্রজাতির সাপ ও ৫ প্রজাতির কাছিম। স্বাদুপানির কুমির (Crocodylus palustris) এখন আর প্রাকৃতিক পরিবেশে দেখা যায় না। অন্তর্দেশীয় সরীসৃপের ৫৮ প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের হুমকির মুখে, ১২ প্রজাতি (২ কুমিরজাতীয়, ৭ কাছিম ও কাউঠা, ২ টিকটিকি ও ২ সাপ) অতি বিপন্ন, ২৪ প্রজাতি (১১ কাছিম ও কাইট্টা, ২ টিকটিকি ও ১১ সাপ) বিপন্ন এবং ২২ প্রজাতি (২ কাছিম ও কাউঠা, ৫ টিকটিকি ও ১৫ সাপ) বিপন্নপ্রায়। তথ্যাভাবে সামুদ্রিক সরীসৃপ সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে অবস্থাটি মূল্যায়ন করা যায় নি। তবে, বাংলাদেশের জলসীমায় প্রাপ্ত ৫ প্রজাতির কাছিম কেবল বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীব্যাপীই হুমকির সম্মুখীন। বাজচঞ্চু কাছিম (Hawksbill Turtle, Eretmochelys imbricata) অতি বিপন্ন এবং লগারহেড কাছিম (Loggerhead Turtle, Caretta caretta), সবুজ কাছিম (Green Turtle, Chelonia mydas), অলিভ রিডলে কাছিম (Olive Ridley Turtle, Lepidochelys olivacea), লেদারব্যাক কাছিম (Leatherback Turtle, Dermochelys coriacea) বিপন্ন।
কাছিম ও কাইট্টা দাঁতহীন ও মজবুত চোয়ালযুক্ত এবং সাধারণত বর্মসদৃশ খোলকধর প্রাণী। শক্ত বর্মাচ্ছাদিত খোলকটি স্বভাবত অস্থিফলক দ্বারা গঠিত। উপরের অংশ বা ক্যারাপেস (carapace) কাছিমের পিঠ ও পাশকে এবং নিচের অংশ বা পাসট্রোন (plastron) উদরকে ঢেকে রাখে, আর দুই অংশ পাশে যুক্ত থাকে। ব্যতিক্রম হলো নিউগিনির ফলকহীন কাছিম ও সামুদ্রিক চর্মপৃষ্ঠ কাছিম (বঙ্গোপসাগরেও আছে), যাদের দেহ পুরু অস্থিময় ত্বকে আবৃত। ভয় পেলে অধিকাংশ কাছিম তার গলা S-আকৃতিতে ভাঁজ করে মাথাটি সোজা খোলকের ভিতর ঢোকায়। বিভিন্ন ধরনের কাছিম ফুসফুসের মাধ্যমে শ্বসনকার্য চালায় এবং সকলেই ডাঙ্গায় ডিম পাড়ে। স্থলবাসী প্রজাতি, বিশেষত Testudinidae গোত্রের সদস্যরা সাধারণত কাইট্টা নামে পরিচিত। স্বাদুপানি বা স্বল্প-লোনাপানির কচ্ছপ, বিশেষত যেগুলি খাওয়া যায় সেগুলিকে সাধারণত terrapin বলা হয়। এগুলি কয়েক সেমি থেকে ২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ক্ষুদ্রতমটি দাগফুটকি কাইট্টা (Speckled Cape Tortoise, Homopus signatus), খোলকের দৈর্ঘ্য ৯৫ মিমি, ওজন প্রায় ১৪০ গ্রাম। বৃহত্তমটি চর্ম কাছিম (Leather Turtle, Dermochelys coriacea), খোলকের দৈর্ঘ্য হয় ২.৪ মিটার পর্যন্ত, ওজন সর্বোচ্চ ৮৬০ কেজি। বন্দি অবস্থায় অনেকগুলি অর্ধশতাধিক বছর বেঁচেছিল বলে জানা যায় এবং একটি বিশাল কাউঠাকে ১৫২ বছর পর্যন্ত বাঁচতে দেখা গেছে।
পৃথিবীব্যাপী উষ্ণমন্ডল ও নাতিশীতোষ্ণমন্ডলে ১২ গোত্রে বিভক্ত Testudines বর্গের ৯০ গণের ২৫০ প্রজাতির কাছিম ও কাইট্টা রয়েছে। এগুলি কেবল প্রাচীনতম সরীসৃপ নয়, এদের পরিবর্তনও ঘটেছে সামান্যই। বাংলাদেশে ৫ গোত্রের (৩ অন্তর্দেশীয় ও ২ সামুদ্রিক) ২৬ প্রজাতির কাছিম ও কাইট্টা (বর্গ Testudines, সাবেক বর্গ Chelonia) আছে। অন্তর্দেশীয় ২১ প্রজাতির মধ্যে ২০ প্রজাতির কাছিম ও কাউঠা নানা হুমকির সম্মুখীন: ৭ অতি বিপন্ন, ১১ বিপন্ন ও ২ বিপন্নপ্রায়।
অতি বিপন্ন প্রজাতিগুলি হলো: বড় কাউঠা, (River Terrapin, Batagur baska), ধুর কাছিম (Three-striped Roof Turtle, Kachuga dhongoka), পাহাড়ি হলুদ কাছিম (Elongated Tortoise, Indotestudo elongata), পাহাড়ি কাছিম (Alongatid Tortoise, Manouria emys), বোস্তামি কাছিম (Black Soft-shell Turtle, Aspideretes nigricans), সিম কাছিম (Chitra indica) এবং জাতা কাছিম (Bibron’s Soft-shell Turtle, Pelochelys bibroni)।
টিকটিকি চতুষ্পদ ও প্রতি পায়ে ৫ আঙ্গুলবিশিষ্ট সরীসৃপ, যদিও কতক কৃমিসদৃশ; তথাকথিত কাঁচসাপের (glass snake) মতো কয়েকটি প্রজাতির পা নেই এবং দেহের অভ্যন্তরে শুধু পায়ের চিহ্নাবশেষটুকুই আছে। কর্ণরন্ধ্র, সচল চক্ষুপত্র ও অপেক্ষাকৃত কম-নমনীয় চোয়ালের দরুন এদেরকে সাপ থেকে স্পষ্টতই আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। অধিকাংশ প্রজাতির সদস্য মাংসাশী, বিশেষত পতঙ্গভুক, কিন্তু কতকগুলি সর্বভুক। বহু টিকটিকি বৃক্ষবাসী এবং অনেক স্থলচর টিকটিকি আরোহণদক্ষ। এরা দ্রুত দৌড়াতে পারে, কারও গতি ঘণ্টায় প্রায় ২৪ কিমি। কতকগুলি টিকটিকি গর্ত খোঁড়ে। অধিকাংশই সাঁতারু এবং কয়েকটি জীবনের অর্ধাংশ পানিতে কাটায়। শেষোক্তদের মধ্যে গ্যালাপাগোস দ্বীপের ইগুয়ানা একমাত্র সামুদ্রিক টিকটিকি। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনাঞ্চলে শূন্যে ভেসে-চলা ধরনের উড়ন্ত ড্রাগন দেখা যায়। বাংলাদেশে চিরসবুজ মিশ্র বনাঞ্চলে উড়ন্ত টিকটিকি (Draco blanfordii) রয়েছে। উত্তর আমেরিকার মরুভূমির গিলা মনস্টার (Gila Monster) ও গুটিযুক্ত (beaded) টিকটিকি দুটি বিষধর। কুমেরু এবং উত্তর আমেকিার ও এশিয়ার সুমেরুর কিছু এলাকা ছাড়া ভূপৃষ্ঠের প্রায় সর্বত্র টিকটিকি রয়েছে।
ক্রিটেসিয়াস যুগের শেষে, প্রায় ৬.৫ কোটি বছর আগে প্রাণিবিলুপ্তির কালপর্বে টিকটিকিরা টিকে যায়, টিকতে পারেনি ডাইনোসর ও অন্যান্য বৃহৎ সরীসৃপ। তৎকালে টিকে-থাকা অবশিষ্ট সরীসৃপ কাউঠা, কুমির ও টুয়াটারা থেকে অতঃপর আর বিভিন্ন ধরনের অজস্র জীবের উৎপত্তি ঘটে নি। যেহেতু টিকটিকি থেকে একমাত্র বড় দল হিসেবে সাপ উদ্ভূত হয়েছিল, তাই বলা যায় ৯৫ শতাংশের বেশি জীবিত সরীসৃপ আদি-টিকটিকির বংশধর। অশ্মীভূত টিকটিকির সংখ্যা বাদে, বর্তমানে জীবিত প্রায় ৪,৩০০ প্রজাতির টিকটিকির তুলনায় এই দলের অস্তিত্বকালে (প্রায় ১৪ কোটি বছর) সম্ভবত ৮০০ প্রজাতিরও কম ডাইনোসর বিদ্যমান ছিল। টিকটিকি ৮ সেমি থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কমোডো ড্রাগনের মতো তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। বেশির ভাগ টিকটিকিই আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট এবং কামড়াতে পারলেও আক্রমণকারীকে হটাতে পারে না, কিন্তু আক্রান্ত হলে তারা লেজ দিয়ে জোরে আঘাত করে, শব্দ করে বা মলমূত্র ছুঁড়ে মারে। পালানোর আরেকটি উপায় হলো স্বঅঙ্গচ্ছেদ (autotomy), অর্থাৎ লেজের মতো দেহের কোন প্রত্যঙ্গ খসানো। অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন লেজটি অনেকক্ষণ নড়াচড়া করে, সম্ভবত শিকারিকে বিভ্রান্ত করতে, পালানোর জন্য শিকারকে কিছুটা বাড়তি সময় দিতে। লেজ হারানোর জন্য এরা যথেষ্ট খেসারত দিয়ে থাকে। টিকটিকির লেজ চর্বিসঞ্চয়ের প্রধান স্থান এবং এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি হারানোর ফলে শীতকালে টিকটিকির সংখ্যা ও বংশবৃদ্ধির হার হ্রাস পায়। পক্ষান্তরে এই সাময়িক ক্ষতির পর লেজের যেকোন বিশেষ কাজ, যেমন চলাচল, অাঁকড়ে ধরা ও সামাজিক আচরণ ইত্যাদি পুষিয়ে নেবার কৌশল টিকটিকিকে অবশ্যই আয়ত্ত করতে হয়। লেজহীন পুরুষ টিকটিকির সামাজিক মর্যাদাহানি ঘটে এবং সে প্রজননের সুযোগ হারায়। কয়েক মাসে পুনরায় টিকটিকিতে লেজ গজায়, তবে নতুন লেজটিতে কিছুটা বিকৃতি থাকে।
ক্ষুদ্রতম টিকটিকি (Monilo Gecko, Sphaerodactylus parthenopion) প্রায় ৩৪ মিমি লম্বা, ওজন হয় ০.১২ গ্রাম এবং বৃহত্তম (Komodo Monitor, Varanus komodoensis) ১৭০-৩১০ সেমি লম্বা, ওজন ৩৫-১৬৫ কেজি। সারাবিশ্বে ২৬ গোত্র ও ৪২০ গণের প্রায় ৪,৩০০ প্রজাতির টিকটিকি রয়েছে। বাংলাদেশে ৪ গোত্রে (Gekkonidae, Agamidae, Scincidae ও Varanidae) বিভক্ত টিকটিকির (বর্গ Lacertilia, সাবেক Squamata) ১৮ প্রজাতি আছে। এই ১৮ প্রজাতির মধ্যে ৮ প্রজাতি বিভিন্ন পর্যায়ের হুমকির সম্মুখীন। উড়ন্ত টিকটিকি (Draco, Draco blanfordii) অতি বিপন্ন, ২ প্রজাতি রামগোদি বা কালোগুই (Monitor Lizard, Varanus salvator), গুই, সোনাগুই, হলদে সাপ (Yellow Monitor, Varanus flavascens) বিপন্ন এবং ৫ প্রজাতি বিপন্নপ্রায়। তথ্যাভাবে ৫ প্রজাতির পরিস্থিতি এখনও অজানা। এই মুহূর্তে কেবল ৫ প্রজাতির টিকটিকিই বিপদমুক্ত।
সাপ Serpentes বর্গভুক্ত লম্বা ও সরু গড়নের সরীসৃপ। সাপ উপাঙ্গহীন, অবশ্য আদি-সাপে শ্রোণিচক্র ও নখর (spur) ছিল, যা আসলে পশ্চাৎ প্রত্যঙ্গের চিহ্নাবশেষ। ত্বক শক্ত অাঁশে ঢাকা, যা শুষ্ক আবহাওয়ায় পানিঘাটতি কমায় ও দেহকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। সাপ বছরে কয়েকবার ত্বক বদলায়। অধিকাংশ মেরুদন্ডী প্রাণীর কশেরুকার তুলনায় সাপে কশেরুকার সংখ্যা বেশি (মানুষে ৩২, সাপে ৪ শতাধিক)। এদের ফুসফুস একটি, ব্যতিক্রম অজগর, যাদের দুটি ফুসফুস। সাপের চোয়াল শিথিলভাবে যুক্ত এবং খুবই নমনীয়। ছুঁচালো পশ্চাৎমুখী দাঁতগুলি করোটির ধারক অস্থির সঙ্গে মিশানো। সাপের কান ও সচল চক্ষুপত্র নেই। দৃষ্টিশক্তি উত্তম। সাপ বায়ুবাহিত শব্দ শোনে না, কিন্তু ভূমি থেকে করোটির হাড়ে পরিবাহিত নিম্ন-কম্পনাঙ্কের তরঙ্গ (১০০-৭০০ Hz) অনুভব করতে পারে। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১০ কিমি বেগে পার্শ্বীয় তরঙ্গণের (undulation) মাধ্যমে চলাচল সাপের সুপরিচিত কৌশল। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বনাঞ্চলের Colubridae গোত্রের কয়েকটি সাপ অস্বাভাবিকভাবে গাছ থেকে গাছে চলাচল করে বলে এরা ‘উড়ুক্কু সাপ’ নামে পরিচিত। এগুলি উঁচু গাছ থেকে ঝাপ দেয় এবং দেহকে পাশে চ্যাপ্টা করে বাতাসে বেশ কিছুদূর ভেসে অক্ষত অবস্থায় আশ্রয়ে নামে।
সাপের মুখের তালুতে একটি সংবেদী (chemosensory) অঙ্গ থাকে এবং চলাচলের সময় সাপের দ্বিধাবিভক্ত জিভে সর্বক্ষণ উপলব্ধি উদ্দীপকগুলি এ প্রত্যঙ্গ গ্রহণ করে। সাপের স্বরযন্ত্র নেই, কিন্তু হিস্ হিস্ শব্দ করতে পারে। অধিকাংশ সাপই স্থলচর এবং কোন কোনটি গর্তবাসী অথবা বৃক্ষবাসী। জলচর সাপও আছে এবং পুরো একটি দলের সাপের সবগুলিই সামুদ্রিক। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলের সাপেরা শীতনিদ্রায় যায়। সাধারণত একা থাকাই অভ্যাস, তবে খাদ্য ও আশ্রয়ের প্রয়োজনে কখনও একত্রে জড়ো হয় এবং শীতনিদ্রায় অনেকগুলি একত্রে থাকে। সাপ ১৫ সেমি থেকে ১০ মিটারের বেশি লম্বা হতে পারে। ছোট সাপ পতঙ্গভুক এবং বড় সাপ নিজ দেহের তুলনায় বড় আকারের প্রাণী খায়। এদের দাঁত শিকার ধরা ও আটকে রাখার উপযোগী, তবে চর্বণক্ষম নয়। চোয়াল ও পাঁজরের গড়ন এবং প্রসারণক্ষম পেশি ও ত্বক সাপকে বৃহৎ প্রাণী আস্ত গলাধঃকরণে সাহায্য করে।
অনেক সাপ নিজের মাথার চেয়ে অনেক বড় মাপের শিকার খেতে পারে এবং কোন কোন প্রজাতিকে নিজের ওজনের চেয়ে অনেক ভারি শিকার খেতে দেখা যায়। অজগর সাপ বন্য শূকর, হরিণ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। দেহের তুলনায় বড় প্রাণী আহারের দরুন সাপ দীর্ঘদিন অনাহারে কাটাতে পারে। কিছু সাপ শিকারকে মাটিতে চেপে রেখে ধরে, কোন কোনটি, যেমন অজগর শিকারকে পেঁচিয়ে চেপে গুঁড়িয়ে ফেলে এবং বিষধর সাপেরা শিকারের দেহে বিষ ঢুকিয়ে দেয়। ভয় দেখালে বা শঙ্কিত হলে সাপ ছোবল দিতে পারে। সাপটি বিষধর হলে ছোবল কখনও কখনও মারাত্মক হয়ে থাকে। বিশেষ প্রজাতির সাপের চেহারা জানা থাকলে বিষদাঁত পরীক্ষা করে বিষধর সাপ থেকে নির্বিষ সাপ শনাক্ত করা যায়।
সাপে নিষেক অভ্যন্তরীণ। পুরুষ টিকটিকির মতো পুরুষ সাপেরও দুটি রমণাঙ্গ থাকে এবং দুটির যে কোনটি সঙ্গমে ব্যবহূত হতে পারে। কয়েক প্রজাতির স্ত্রী সাপ ভবিষ্যৎ বংশ রক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শরীরের ভিতরে কয়েক বছর শুক্রাণু জমা রাখে। অধিকাংশ স্ত্রী সাপ ডিম পাড়ে। কতকগুলিতে দেহের ভিতরে ডিম থেকে বাচ্চা জন্মায়। গুটিকয় সাপ জীবিত বাচ্চা প্রসব করে আর এদের বাচ্চারা কুসুমস্থলীর পরিবর্তে অমরাসদৃশ গঠন দ্বারা পরিপোষিত হয়। কতিপয় সাপ ডিমে তা দেয়, কিন্তু বাচ্চাদের মাতৃস্নেহে লালন-পালন করে না।
পৃথিবীব্যাপী ১৮ গোত্রে, ৪৫০ গণে প্রায় ২,৭৫০ প্রজাতির সাপ রয়েছে। অধিকাংশই গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশের বাসিন্দা। এদের মধ্যে ক্ষুদ্রতম হলো (১৫ সেমি-র চেয়ে কম) নানা ধরনের সুতাসাপ (গোত্র Lephtotyphlopidae) ও দৃষ্টিহীন সাপ (গোত্র Anomalepididae) এবং বৃহত্তম (ওজনে ২৫০ কেজির বেশি) অ্যানাকোন্ডা (Eunectes murinus)। বাংলাদেশে ৭ গোত্রে (৬ অন্তর্দেশীয় ও ১ সামুদ্রিক) ৭৯ প্রজাতির (অন্তর্দেশীয় ৬৭, সামুদ্রিক ১২) সাপ আছে। অন্তর্দেশীয় ৬৭ প্রজাতির সাপের মধ্যে ১৫টি বিষধর (Elapidae গোত্রের ১০ প্রজাতি ও Viperidae গোত্রের ৫ প্রজাতি)। সবগুলি সামুদ্রিক সাপই বিষাক্ত। বাংলাদেশে গোলবাহার বা অজগর (Reticulated Python, Phython reticulata) ও চন্দ্রবোড়া (Russell’s Viper, Vipera russellii) অতি বিপন্ন। এগারো প্রজাতির সাপ বিপন্ন এবং ১৫ প্রজাতি বিপন্নপ্রায়। তথ্যাভাবে আজও সামুদ্রিক ও অন্তর্দেশীয় ৩৩ প্রজাতির সাপের অবস্থা মূল্যায়ন করা যায় নি।
কুমির ও ঘড়িয়াল Crocodilia বর্গের বৃহৎ মাংসাশী সরীসৃপ। এই বর্গের ৩ গোত্র Crocodylidae (কুমির ১৩ প্রজাতি), Alligatoridae (অ্যালিগ্যাটর ২ প্রজাতি) এবং Gavialidae (ঘড়িয়াল ২ প্রজাতি)। এগুলি উষ্ণমন্ডলীয় ও উপউষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে জলাভূমি বা নদীর তীরে বাস করে ও পানিতে শিকার ধরে। কুমিরের শরীর ও লেজ চ্যাপ্টা, পা খাটো ও চোয়াল শক্তিশালী। মাথার আগার কাছাকাছি চোখ, কান ও নাকের ছিদ্র এবং পানিতে ভেসে থাকার সময় এগুলি খোলা থাকে। ডুবন্ত কুমির কান ও নাকের ছিদ্র এসব অঙ্গে অবস্থিত কপাটিকা দ্বারা বন্ধ রাখে।
ছোট কুমির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী খেয়ে থাকে। বড় কুমির মাছ ছাড়াও পানির কাছাকাছি আসা ডাঙ্গার স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি ও শিকার করে। কুমিরগোষ্ঠীর কতকগুলি বৃহদাকার সদস্য কখনও কখনও মানুষকে আক্রমণ করে। স্ত্রী কুমির নদীর তীরে পচা আগাছা দিয়ে তৈরি বাসায় বা অগভীর গর্তে সাধারণত ২০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফোটার শব্দ শুনলে সেগুলি মাটি খুঁড়ে বের করে। অধিকাংশ প্রজাতির কুমিরের গড় দৈর্ঘ্য ১.৮-৩ মিটার। সর্ববৃহৎ কুমির, সুন্দরবনের লোনাপানির কুমির (Crocodylus porosus) ৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা, ওজন প্রায় ১৫০০ কিলোগ্রাম। আফ্রিকার ক্ষুদ্রতম কুমির/বামন কুমির (Ossteolaemus tetrapis) একমাত্র Crocodylid যা Crocodylus গণভুক্ত নয়, গড়ে ১.৫ মিটার লম্বা। Crocodylus গণভুক্ত ১০ প্রজাতির কুমিরের দৈর্ঘ্যও প্রায় অনুরূপ। দক্ষিণ ও মধ্য আফ্রিকার সর্বত্র স্বাদু ও লোনাপানিতে নীল নদের কুমির (Crocodylus niloticus) দেখা যায়। এটিও লোনাপানির কুমিরের (Crocodylus porosus) মতো কখনও কখনও মানুষকে আক্রমণ করে; এরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া ও সলোমন দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় স্বাদুপানির জলাভূমির কুমির বা মকর (Crocodylus palustris) কোন কোন অঞ্চলে পবিত্র বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে মুক্ত জলাশয়ে এই কুমির আর নেই। অবশ্য কয়েকটি (৪-৫) এখনও দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট জেলায় হযরত খানজাহান আলীর দরগাহর পুকুরে রয়েছে। দক্ষিণ ফ্লোরিডা, পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমে স্বাদু ও লোনাপানির আমেরিকান কুমির (Crocodylus acutus) দেখা যায়। বিরক্ত না করলে তারা মানুষকে আক্রমণ করে না। Orinoco Crocodile (Crocodylus intermedius) ভেনিজুয়েলা ও কলাম্বিয়ার অরিনোকো অববাহিকার স্বাদুপানির কুমির। মধ্য আমেরিকা ও কিউবার দু’একটি অঞ্চলে ২ প্রজাতির অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কুমির পাওয়া যায়।
অ্যালিগ্যাটরের তুলনায় অধিকাংশ কুমির অধিক আক্রমণাত্মক। এই দুটি দলকে আলাদা শনাক্ত করা যায় নিচের চোয়ালের লম্বা চতুর্থ দাঁতের সাহায্যে, যেটি কুমিরের আছে, অ্যালিগ্যাটরে নেই। কুমির মুখ বন্ধ করলে এই দাঁত বেরিয়ে থাকে। অধিকাংশ কুমিরের তুন্ড অ্যালিগ্যাটরের তুন্ডের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সরু। অ্যালিগ্যাটর ও কাইম্যান (Caiman) Alligatoridae গোত্রভুক্ত এবং একত্রে Alligatorids নামে পরিচিত। সব অ্যালিগ্যাটরে নিম্ন চোয়ালের দাঁত ঊর্ধ্ব চোয়ালের গর্তে ঢুকে থাকে এবং মুখ বন্ধ থাকলে বাইরে থেকে দাঁত দেখা যায় না। পৃথিবীর দূর-বিচ্ছিন্ন দুটি অঞ্চলে দুই প্রজাতির প্রকৃত অ্যালিগ্যাটর পাওয়া যায়। ছয় মিটারের বেশি লম্বা আমেরিকান অ্যালিগ্যাটর (Alligator mississippiensis) যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বে দেখা যায়। চীনের ইয়াংসি নদী ও শাখা-প্রশাখার বাসিন্দা চীনা অ্যালিগ্যাটর (Alligator sinensis) দৈর্ঘ্যে কদাচিৎ দুই মিটার ছাড়িয়ে যায়। এরা ঘন আগাছাকীর্ণ জলাভূমিতে থাকে।
দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার সকল Alligatorid কাইম্যান নামে পরিচিত। বৃহত্তম কালো কাইম্যান (Melanosuchus niger) ৬ মিটারের বেশি লম্বা হতে পারে। জীব রাসায়নিক তথ্য থেকে দেখা যায় যে এটি অ্যালিগ্যাটরের চেয়ে অন্যান্য কাইম্যানের সঙ্গে অধিক ঘনিষ্ঠ, যদিও বাহ্যিক চেহারা হুবহু আমেরিকার অ্যালিগ্যাটরের মতোই। ব্রাজিলের আমাজান অববাহিকার সর্বত্রই এদের বাস। Caiman গণে আছে দুইটি প্রজাতি; দক্ষিণ মেক্সিকো থেকে উত্তর আর্জেন্টিনা পর্যন্ত রয়েছে বহুদৃষ্ট Caiman crocodylus এবং ব্রাজিল উপকূলের নদীনালা ও জলাভূমিতে এবং প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনার নদীগুলিতে আছে প্রশস্ত তুন্ড C. latirostris। সমগ্র বিশ্বে কুমিরের চামড়ার সামগ্রীর ৬০-৭০ শতাংশই যোগায় ক্যাইম্যান, আর এজন্য এরাই কুমির বর্গের সর্বাধিক শিকারকৃত প্রাণী।
সারণি বাংলাদেশের সরীসৃপ।
বর্গ | গোত্র | প্রজাতির সংখ্যা |
অন্তর্দেশীয় প্রজাতি | ||
কুমির ও ঘড়িয়াল | Crocodylidae | ২ |
ধোরalidae | ১ | |
কাছিম ও কাউঠা | Bataguridae | ১৩ |
Testudinidae | ২ | |
Trionychidae | ৬ | |
টিকটিকি | বেশkonidae | ৫ |
Agamidae | ৪ | |
Scincidae | ৬ | |
Varanidae | ৩ | |
সাপ | Typhlopidae | ৩ |
Boidae | ৩ | |
Acrochordidae | ১ | |
Colubridae | ৪৫ | |
Elapidae (বিষাক্ত সাপ) | ১০ | |
Viperidae (বিষাক্ত সাপ) | ৫ | |
মোট = | ১০৯ | |
সামুদ্রিক প্রজাতি | Hydrophidae (বিষাক্ত সাপ) | ১২ |
Cheloniidae | ৪ | |
Dermochelyidae | ১ | |
মোট = | ১৭ | |
সর্বমোট = | ১২৬ |
ঘড়িয়াল (Gavialis gangeticus) অত্যন্ত লম্বা, সরু ও সমান্তরালপার্শ্ব তুন্ডের বৈশিষ্ট্যে কুমির ও অ্যালিগ্যাটর থেকে স্পষ্টত পৃথক। মৎস্যভুক এই সরীসৃপ এপাশ-ওপাশ মাথা ঝেটিয়ে মাছ শিকার করে। নদীর তীরে পুঁতে রাখা ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। Gavialidae গোত্রে আছে অতি সরু তুন্ডের ২ প্রজাতির কুমির। ভুয়া-ঘড়িয়াল (Tomistoma schlegelii) ও ঘড়িয়াল যথাক্রমে ৪ মিটার ও ৬.৫ মিটারের অধিক লম্বা। ভুয়া-ঘড়িয়াল থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জলাভূমি, হ্রদ ও নদীতে এবং সুমাত্রা, বর্নিও ও জাভা দ্বীপে বাস করে। এটি কালো দাগে সুচিহ্নিত এবং প্রাপ্তবয়স্করাও অল্পবয়সীদের মতো রঙচঙে। প্রকৃত ঘড়িয়ালের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের তুন্ডের আগায় একটি বড় মাংসপিন্ড জন্মে, যা সম্ভবত সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় উৎপন্ন শব্দাবলি রূপান্তরের কাজে ব্যবহূত হয়। অন্যান্য অধিকাংশ কুমিরের তুলনায় এরা অধিক সময় পানিতে কাটায় এবং পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সিন্ধু, ভিমা, মহানদী, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, কালাদান ও ইরাবতী নদীর অপেক্ষাকৃত খরস্রোতধৌত এলাকায় বিচরণ করে।
বাংলাদেশের দক্ষিণে সুন্দরবনে মোহনার কুমির (Crocodylus porosus) এবং উত্তরে পদ্মা নদীতে ঘড়িয়াল (Gavialis gangeticus) রয়েছে। বাংলাদেশে উভয় প্রজাতির কুমির অতি বিপন্ন। [মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম]