সংবিধান
সংবিধান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয় এবং একই বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বলবৎ হয়। সংবিধানে এগারোটি ভাগ ও চারটি সিডিউলে বিন্যস্ত মোট ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। ভাগগুলো হচ্ছে: প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকার, নির্বাহী, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা, আইনসভা, আইন প্রণয়ন ও আর্থিক পদ্ধতি, অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন, মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, বাংলাদেশের কর্মবিভাগ, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জরুরি বিধানাবলি, সংবিধান সংশোধন এবং বিবিধ।
সংবিধানে বাংলাদেশকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, আইনের শাসন, চলাফেরা সমাবেশ ও সংগঠন করার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও সংহতির নীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে সংবিধানে ১৭টি সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কিছু হয়েছে সাংবিধানিক সংশোধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, কিছু হয়েছে সামরিক আইনের আওতায় ঘোষণা ও আদেশের দ্বারা। বেশ কয়েকবার সরকার পদ্ধতিরও পরিবর্তন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সাংবিধানিক যাত্রার সূচনা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আওতায় জারিকৃত একটি অস্থায়ী সংবিধানের মাধ্যমে। এতে রাষ্ট্রপতিকে (মুজিবনগর সরকারের) সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়। এই ঘোষণাপত্রের স্থলাভিষিক্ত হয় ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ। উক্ত আদেশে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর ও ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে প্রজাতন্ত্রের গণপরিষদ গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। এছাড়া রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ সম্বলিত সংসদীয় পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধানের মৌলিক সংশোধন সাধিত হয়। সংবিধান (চতুর্থ সংশোধনী) আইন ১৯৭৫ দ্বারা সংসদীয় পদ্ধতি পরিত্যক্ত হয় এবং রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সময়কালে মাঝেমধ্যে বেসামরিক সরকারের আগমনসহ কয়েক দফা সামরিক আইন বহাল থাকে। এ সময় বেসামরিক বা সামরিক কোনো সরকারই সংবিধান রদ করে নি, আবার সম্পূর্ণরূপে অনুসরণও করে নি। প্রতিটি শাসনামলেই অংশত ডিক্রি এবং অংশত সংবিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে। সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন ১৯৭৯ দ্বারা সকল সাংবিধানিক ব্যত্যয় নিয়মিত ও সমর্থিত হয়। এই সংশোধনের দ্বারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সম্পাদিত সকল ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ এবং অন্যান্য আইন ও ট্রাইব্যুনাল অনুমোদিত ও সমর্থিত হয়। পরবর্তী সময়ের বিভিন্ন সামরিক আইন ফরমান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান ও অধ্যাদেশের অনুমোদন ও সমর্থন সম্পন্ন হয় সংবিধান (সপ্তম সংশোধনী) আইন ১৯৮৬ দ্বারা। বহুদলীয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকার পর আবারও সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।
সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯১-এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান এবং রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক প্রধান হন। দ্বাদশ সংশোধনী অনুসারে প্রধানমন্ত্রী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন এবং তাঁর মন্ত্রিপরিষদ যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে। তবে সরকারের সকল নির্বাহী ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত হয়েছে বলে উল্লেখ করতে হবে, যদিও বাস্তবিক পক্ষে রাষ্ট্রপতির ওপর কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করা নেই। তত্ত্বগতভাবে প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকলেও এরূপ ক্ষমতা মূলত আনুষ্ঠানিক ও প্রতীকী। ব্রিটেনের রাজার মতো রাষ্ট্রপতি পদের সঙ্গে মর্যাদা ও সম্ভ্রম সংযুক্ত রয়েছে, ক্ষমতা নয়।
সংবিধানের সর্বশেষ এবং সাংবিধানিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সংশোধন করা হয়েছে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী) আইন ১৯৯৬-এর মাধ্যমে। এ আইনে এরূপ একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখা হয়েছে, যে সরকার মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাবার পর যে তারিখে প্রধান উপদেষ্টা কার্যভার গ্রহণ করবেন সে তারিখ থেকে নতুন সংসদ গঠিত ও প্রধানমন্ত্রী তার পদের কার্যভার গ্রহণ করার তারিখ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবে। একজন প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার যৌথভাবে রাষ্ট্রপতির নিকট দায়বদ্ধ থাকবে। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্বাবধয়াক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। [সিরাজুল ইসলাম]
আরও দেখুন সাংবিধানিক সংশোধনী; সাংবিধানিক ক্রমবিকাশ।