সংবাদপত্র ও রাজনীতি

সংবাদপত্র ও রাজনীতি  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে এই উপমহাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। তবে মুগল আমলে ওয়াকিয়ানবিশ নামে পদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যিনি প্রধানত মুগল শাসকদের সরকারি সংবাদ সংগ্রাহক ছিলেন এবং গোপন সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতেন। জানা যায়, ১৭৬৮ সাল অথবা কাছাকাছি সময়ে জনৈক ব্রিটিশ অভিবাসী উইলিয়ম বোল্ট্স তাঁর প্রকাশিত পত্রিকায় কোম্পানির কর্মকান্ডের অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতির বিবরণ তুলে ধরার দুঃসাহস দেখালে অচিরেই ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি স্থানীয় ইংরেজদের জন্য  বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার নামে দুই পাতার একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর পত্নী ও ইংরেজ বিচারকদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের দরুন এটিও দ্রুত বাজেয়াপ্ত হয়। বেঙ্গল জার্নাল পত্রিকার সম্পাদক উইলিয়ম ডুয়ান সংবাদ পরিবেশনের জন্য দেশ থেকে বিতাড়িত হন। বেঙ্গল হরকরা পত্রিকায় ড. চার্লস ম্যাকলিন ‘সংযমহীন’ সরকারবিরোধী সংবাদ প্রকাশের দায়ে ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৯৯ সালে লর্ড ওয়েলেসলি বাংলায় সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণবিধি চালু করেন।

১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় শিক্ষক ও সংস্কারক গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন। অতঃপর ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে বাংলা মাসিক পত্রিকা দিগদর্শন প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ সালের ২৩ মে বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশের এক সপ্তাহ পর সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক জেমস সিল্ক বাকিংহাম তাঁর প্রকাশিত ক্যালকাটা জার্নাল পত্রিকার মাধ্যমে ভারতের সমসাময়িক ইংরেজ সাংবাদিকতায় সততা ও রুচিশীলতার প্রকাশ ঘটান। রাজা রামমোহন রায় বাংলা সংবাদ কৌমুদী, ইংরেজি ব্রাহ্মিনিক্যাল ম্যাগাজিন ও ফার্সিতে মিরাত-উল-আকবর প্রকাশ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় ও ইউরোপীয় সম্পাদকদের ঐক্যবদ্ধ চাপে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক বিদ্যমান সংবাদপত্র আইন শিথিল করতে বাধ্য হন। গভর্নর জেনারেল জন অ্যাডাম ১৮২৩ সালে গৃহীত বেঙ্গল রেজুল্যুশন্স অনুসরণে সে বছর মুদ্রণের জন্য লাইসেন্স প্রদানের প্রথা চালু করেন। কিন্তু স্যার চার্লস মেটকাফ ১৮২৩ সালের প্রবিধান সংশোধন করেন এবং ১৮৩৫ সালের আইন পাস করেন যাতে সম্পাদক, মুদ্রক ও প্রকাশককে কেবল প্রকাশনার স্থান সম্পর্কে ঘোষণা দেওয়ার নিয়ম চালু হয়। ১৮৩৫ সালে আদালতের ভাষা হিসেবে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি প্রবর্তিত হলে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা প্রবর্তনের সুপারিশ করে। ১৮৪৭ সালে সাপ্তাহিক রংপুর বার্তাবহ প্রগতিশীল বক্তব্য প্রচার এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করে। এমতাবস্থায় লর্ড এলেনবরা কর্মকর্তাদের সরকারি তথ্যাদির গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেন।

ওহাবীদের অভ্যুত্থান, তিতুমীরের আন্দোলন এবং ফরায়জী আন্দোলন, উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের সাঁওতাল বিদ্রোহ এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লব ছিল ভারতীয়দের চরম অসন্তোষের ফল। সংবাদপত্রগুলো এই ঘটনাবলির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের পরিবর্তে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সরকারকে হুঁশিয়ার করেছিল। কিন্তু সিপাহি বিপ্লব শুরু হলে বিশেষভাবে উর্দু সংবাদপত্রগুলোকে এজন্য দায়ী করা হয়। ফার্সি পত্রিকা দুরবীন, সুলতানুল আখবার ও কলকাতার হিন্দু প্যাট্রিয়ট বিপ্লবের জন্য প্রস্ত্ততির আহবান সম্বলিত শেষ মুগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের বিখ্যাত ঘোষণাটি প্রকাশ করে। কলকাতা থেকে বাংলা ও হিন্দিতে প্রকাশিত দ্বিভাষিক দৈনিক সমাচার সুধাবর্ষণ বিপ্লবের অগ্রগতি ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নৃশংসতার সংবাদ ও সমীক্ষা প্রকাশ করত, যেজন্য ১৮৫৭ সালে লর্ড ক্যানিং সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রিত বই ও পত্রিকার প্রচার সীমিত করার জন্য ১৮২৩ সালের বেঙ্গল রেজুল্যুশনের নিয়ন্ত্রক বিধান পুনঃপ্রবর্তন করেন। সরকার দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ও ঢাকা নিউজ (পরবর্তীকালে বেঙ্গল টাইমস) পত্রিকা দুটিকে সতর্ক করে এবং রংপুর বার্তাবহ বন্ধ করে দেয়। ১৮৫৮ সালে আইনটি অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়।

১৮৫৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাপ্তাহিক সোমপ্রকাশ প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলাযন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখান থেকে ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হয়। এ বছরেই দি জন বুল ইন দি ইস্ট (পরবর্তী নামকরণ দি ইংলিশম্যান) ইউরোপীয়দের ও ভারতে নীলকরদের শক্তিশালী মুখপত্র হয়ে ওঠে। ১৮৬৫ সালে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত পাইওনিয়র পূর্ণাঙ্গ সংবাদ পরিবেশনের জন্য খ্যাতি অর্জন করে। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভ্রাতৃগণ যশোরের ক্ষুদ্র গ্রাম ফুলুয়া-মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন (পরবর্তীকালে কলকাতায় স্থানান্তরিত)। ১৮৭৫ সালে রবার্ট নাইট দি স্টেটসম্যান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৯ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আরও জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে বেঙ্গলী পত্রিকার স্বত্ব ক্রয় করেন। ১৮৮১ সালে যোগেন্দ্র নাথ বসু বঙ্গবাসী প্রকাশ করেন। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত বাংলা নীল দর্পণ নাটক ইউরোপীয় নীলচাষীদের নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরলে সরকারি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ফলত সরকার ১৮৭৬ সালে নীলকরদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে। অমৃত বাজার পত্রিকা (যশোর) সহ আরও কতিপয় স্থানীয় পত্রিকা নীলচাষীদের পক্ষাবলম্বন করে।

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। দি স্টেটসম্যান, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ও অমৃত বাজার পত্রিকা কংগ্রেসের সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আ্যংলো-ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র, বিশেষত পাইওনিয়র কংগ্রেসে যোগদানে মুসলমানদের নিরুৎসাহিত করে। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা ও বেঙ্গলী সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুসলমানদের সহযোগিতা কামনা করেন, কিন্তু তাতে সাড়া পাওয়া যায় নি। বাংলার সৈয়দ আমীর আলী নীরবতা পালন করেন। লক্ষ্ণৌতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে, কংগ্রেস প্রস্তাবিত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার মুসলমানদের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে। পাইওনিয়র স্যার সৈয়দের লক্ষ্ণৌ বক্তৃতা প্রকাশ করে। আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেট কংগ্রেসের গোটা জাতির প্রতিনিধিত্বের দাবি পরিত্যাগের আহবান জানায়। ইংলিশম্যান পত্রিকা স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব আবদুল লতিফ ও সৈয়দ আমীর আলীকে মুসলমানদের প্রকৃত নেতা হিসেবে চিহ্নিত করে। ইতোমধ্যে ভাইসরয় লর্ড ডাফরিন কংগ্রেসকে ‘নিতান্ত ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু দল’ বলে অভিহিত করেন। বঙ্গবাসী এ বিরূপ মন্তব্যে রুষ্ট হয়। কংগ্রেস সমর্থক পত্রিকা দি নিউ ইন্ডিয়া ও অমৃত বাজার পত্রিকা দলকে সংস্কারের জন্য অবিরত আবেদন-নিবেদনের নীতি পরিত্যাগের পরামর্শ দেয়। ডাফরিনের মন্তব্য অবশ্য অন্য কোনো রাজনৈতিক মঞ্চের অবর্তমানে কংগ্রেসের প্রতি মুসলমানদের সহানুভূতিশীল করে তোলে। সরকার মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গির এ পরিবর্তন লক্ষ্য করে এবং সৈয়দ আমীর আলীকে বিচারক নিযুক্ত করে।

কংগ্রেসের এলাহাবাদ অধিবেশনের পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংবাদপত্র, বিশেষত দেশী ভাষার পত্রিকাগুলো কংগ্রেসকে সমর্থন করে। কংগ্রেসবিরোধীদের চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত, জনপ্রিয় পত্রিকা বঙ্গবাসীর নেতৃত্বে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা মনে করত যে, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কংগ্রেস নেতারা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত চরিত্র না বুঝে মোহগ্রস্ত হয়ে কাজ করছেন। দ্বিতীয়ত, মুসলমানদের পরিচালিত সংবাদপত্রগুলোও কংগ্রেসের বিরোধিতা করে, যদিও তারা দুটি পরস্পরবিরোধী দলে বিভক্ত ছিল। একদল আলীগড় স্কুলের সমর্থক, অপর দল ছিল ব্রিটিশদের প্রতি স্যার সৈয়দ আহমদের নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শনের নীতির বিপক্ষে। তৃতীয়ত, আ্যংলো-ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র, প্রধানত পাইওনিয়র হিন্দুদের অভিপ্রায় সম্পর্কে মুসলমানদের মনে সন্দেহ জাগিয়ে তুলছিল। শেষত, এক শ্রেণীর সংবাদপত্রের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শাসকদের মনোরঞ্জন। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলো কংগ্রেসের সভার খবর প্রকাশ করত, কিন্তু তারা ছিল আইরিশ ধরনের বলপ্রয়োগের আন্দোলনে বিশ্বাসী। এ প্রেক্ষাপটে ১৮৭৮ সালে উপমহাদেশের স্থানীয় ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোকে আরও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট পাস করা হয়। ১৮৯৭ সালে ভারতীয় দন্ডবিধিতে রাজদ্রোহ বা বিদ্রোহ এবং শ্রেণীবিদ্বেষ সংক্রান্ত ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়। সরকার ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি অপরাধ সম্পর্কে তদন্ত এবং রাজদ্রোহমূলক পুস্তক-পুস্তিকা বাজেয়াপ্তকরণ আইন পাস করে। কংগ্রেস ও কংগ্রেসের সমর্থক সংবাদপত্রগুলো প্রতিবাদ জানায়।

আর্য সমাজের ‘শুদ্ধি’ আন্দোলনের পক্ষে সনাতন ধর্ম পত্রিকার ভূমিকা, মির্জা গোলাম হোসেন কাদিয়ানীর আল হাকাম পত্রিকা এবং শিয়াদের প্রকাশিত দারূল সালতানাত ও উর্দু গাইড পত্রিকার প্রচারণা এবং হানাফী, মোহাম্মদী, ওয়াহাবী ও সুন্নী সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, আর এইসঙ্গে অমৃত বাজার পত্রিকায় মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী মন্তব্য, স্যার সৈয়দ আহমদকে তাঁর অনুসারীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত করে। স্যার সৈয়দের প্রতিষ্ঠিত আলীগড় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হলে এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ বিচ্ছিন্নতা ও পৃথকত্বের সপক্ষে প্রচার শুরু করলে ভারতে পৃথক রাষ্ট্রগঠনের এক ঐতিহাসিক ভিত্তি আবিষ্কৃত হয়। ১৯০৫ সালে ঘোষিত বঙ্গভঙ্গ কংগ্রেসের জন্য অপ্রত্যাশিত সুযোগ বয়ে আনে। বঙ্গভঙ্গের পর বঙ্কিমচন্দ্রের গান বন্দে মাতরম্ রাতারাতি বাংলার উদ্দীপনাময় কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়। ঢাকা প্রকাশ এ মর্মে নিবন্ধাদি প্রকাশ করে যে, বঙ্গভঙ্গ মুসলমান সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু লর্ড কার্জন ঘোষণা করেন যে, বঙ্গবিভাগের মাধ্যমে মুসলমানরা একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ লাভ করবে।

১৯০৬ সালে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ গঠিত হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে আরও দুটি আন্দোলনের সূচনা ঘটে, সরকারি চাকুরি বর্জন আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলন। ইতোমধ্যে কংগ্রেস উদারপন্থী ও জাতীয়তাবাদী ধারা এ দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। শেষোক্ত ধারাকে সাধারণত চরমপন্থী বলা হতো। বেশিরভাগ সংবাদপত্র সুরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে মধ্যপন্থী ধারা অনুসরণ করে, অন্যদিকে বিপিন চন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ চরমপন্থীদের নেতৃত্ব দেন। অরবিন্দ ও বিপিন চন্দ্রের পত্রিকা বন্দে মাতরম্ সর্বাত্মক বর্জন নীতি সমর্থন করে এবং যুগান্তর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের জন্য সন্ত্রাসবাদের পক্ষে প্রচার শুরু করে। বাংলার মুসলমানরা রোজনামা-এ-মোকাদ্দাস-হাবলুল ও সুলতান  নামক ফার্সি পত্রিকার মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলন সমর্থন করে।

ফলত ১৯০৮ সালে নিউজ পেপার্স (অপরাধ সংঘটনে উস্কানি) অ্যাক্ট পাস হলে সন্ত্রাসী তৎপরতার প্রতি সহানুভূতিশীল কতিপয় সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়। যেকোন আন্দোলন ও সমালোচনা দমনের জন্য ১৯১৩ সালের ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট এবং ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া রেগুলেশনস্ প্রয়োগ করা হতো। ১৯১৬ সালে তদানীন্তন পূর্ববাংলার প্রথম ইংরেজি দৈনিক হেরাল্ড ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলের সম্ভবত প্রথম বাংলা দৈনিক জ্যোতি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালের ইন্ডিয়ান প্রেস (জরুরি ক্ষমতা) অ্যাক্ট স্থানীয় সরকারি কর্তৃপক্ষকে সংবাদপত্রের জামানত বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা প্রদান করে। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত জাগরণ, নোয়াখালীর দেশের বাণী, বরিশাল হিতৈষী, বগুড়ার কথা ও ফরিদপুর হিতৈষিণী ব্রিটিশ শাসকের রোষানলে পতিত হয়। ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুথান এদেশের পত্রিকাগুলোকে আরও সোচ্চার ও মুক্তকণ্ঠ হতে উৎসাহিত করে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকা কিংবা পূর্ববাংলার অন্য কোথাও কোনো জাতীয় পত্রিকা ছিল না। মুসলিম লীগের সমর্থক দু‘টি পত্রিকা আজাদ ও মর্নিং নিউজ তখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো। কলকাতায় মুসলিম লীগের একটি দুর্বল অংশ ইত্তেহাদ প্রকাশ করত। এই তিনটি পত্রিকা পর্যায়ক্রমে পূর্ববাংলায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকা থেকে জিন্দেগী প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান অবজারভার এবং পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। নবপ্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি মুসলিম লীগ সরকারের কট্টর সমালোচনা করত। সাপ্তাহিকটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত দৈনিক ইনসাফ বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক পয়গাম  এবং সিলেট থেকে প্রকাশিত নওবেলাল  জাতীয় দৈনিকের ভূমিকা পালন করে।

১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদে উর্দুর সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরম খাঁর পত্রিকা দৈনিক আজাদ খাজার বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ঢাকার উর্দু দৈনিক পাসবান, সিলেটের আসাম হেরাল্ড ও যুগভেরী একই পথ অনুসরণ করে, যদিও এগুলোতে উর্দুর পক্ষ সমর্থনে কিছু সংবাদও প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে এবং কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়। প্রতিবাদে আজাদ পত্রিকার সম্পাদক এবং প্রাদেশিক পরিষদে সরকার দলীয় সদস্য আবুল কালাম শামসুদ্দীন পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি পুলিশের গুলিবর্ষণস্থলে ছাত্রদের নির্মিত শহীদ মিনারও উদ্বোধন করেন।

উল্লেখ্য যে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের আন্দোলন পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই শুরু হয়েছিল। ইনসাফ, জিন্দেগী ও দেশের দাবী ১৯৪৮ সালের মার্চে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য গঠিত কাউন্সিলের অবস্থান সমর্থন করে। একই বছর মার্চে উর্দুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণের জন্য মর্নিং নিউজ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়, কিন্তু সরকারপন্থী সংবাদ কোনক্রমে রেহাই পেয়ে যায়। ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দানের জন্য পাকিস্তান অবজারভার ১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বন্ধ করে দেওয়া হয়। মিল্লাত, ইনসাফ, আমার দেশ, ঢাকার সাপ্তাহিক সৈনিক ও ময়মনসিংহের সাপ্তাহিক চাষী রাষ্ট্রভাষার দাবি সর্মথন করে।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আজাদ, সংবাদ ও মর্নিং নিউজ মুসলিম লীগকে সমর্থন করে। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক ছিল যুক্তফ্রন্টের সমর্থক। পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী এবং সম্পাদক আবদুস সালাম যুক্তফ্রন্ট থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকার স্থায়ী হতে পারে নি। এ সরকারের পতনের পর ইত্তেফাক ও সংবাদ পরিবর্তিত ব্যবস্থাপনায় সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগকে, অন্যদিকে পাকিস্তান অবজারভার ও মিল্লাত এ.কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টিকে সমর্থন করে। এই মতপার্থক্য ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান পাসের সময় তীব্র হয়ে ওঠে। ইত্তেফাক পূর্ব-পশ্চিম অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি উত্থাপন করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায়। ১৯৫৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানী কর্তৃক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠিত হলে দৈনিক সংবাদ ও ভাসানীর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দলের সমর্থক হয়। দৈনিক ইত্তেফাক তখন আওয়ামী লীগকে সমর্থন করত।

যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেলে এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালে ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী মারাত্মকভাবে আহত হলে সংবাদপত্রগুলো রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আক্রমণ শুরু করে। দেশের অশান্ত পরিবেশে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক  অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। অতঃপর ১৯৬২ সালের জুন মাসে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পূর্ব পর্যন্ত সংবাদপত্র কঠোর সামরিক আইনে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। বিচারপতি হামুদুর রহমানের রিপোর্টে নিয়ন্ত্রণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিবাদসহ রাজনৈতিক বিক্ষোভের সংবাদ পরিবেশনের জন্য ইত্তেফাক, পাকিস্তান অবজারভার ও সংবাদ কালো তালিকাভুক্ত হয়। সংবাদপত্রের বিরোধী ভূমিকার জের হিসেবে ১৯৬৪ সালে জাতীয় প্রেস ট্রাস্ট গঠিত হয়। মনিং নিউজ  ট্রাস্টের মালিকানাধীনে আসে এবং ট্রাস্ট কর্তৃক সেই বছর ৬ নভেম্বর বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালের ৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ছয়দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। ট্রাস্টের পত্রিকাগুলো ও আজাদ ৬-দফার বিরোধিতা করে এবং অন্য সব পত্রিকা ছয়দফা সমর্থন করে। ইত্তেফাক সম্পাদককে পুনরায় গ্রেফতার করে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভারতের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ১৯৬৭ সালে আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করে অন্যান্য সন্দেহভাজনসহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয় এবং ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম সারির বামপন্থী ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। সকল পত্রিকাই জোরালো ভাষায় এই হত্যাকান্ডের নিন্দা করে। ১৯৬৯ সালে ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশিত হয় এবং আন্দোলনে যোগদান করে। আন্দোলনের তীব্রতা এবং সংবাদপত্রগুলোর সহায়ক ভূমিকা জেনারেল আইয়ুব খানকে জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক সর্বাত্মক অসহযোগিতার আহবান পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। সকল পত্রিকাই ১৯৭১ সালের ১ মার্চের সামরিক বিধান অগ্রাহ্য করে, যাতে আপত্তিকর সংবাদ পরিবেশনের জন্য ১০ বছরের কারাদন্ডের বিধান ছিল। তারপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে এবং সেদিন থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো কার্যত অবরুদ্ধ ছিল।

বাংলাদেশের সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অঙ্গীকার সম্বলিত যথাযথ বিধান সন্নিবেশিত থাকা সত্ত্বেও মনে হয়, এই স্বাধীনতা সহজে অর্জিত হয় নি। ১৯৭৩ সালের মুদ্রণ ও প্রকাশন আইন এবং ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন মূলত সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এক-দলীয় রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি প্রবর্তনের ক্ষেত্র তৈরি করে এবং অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় প্রকাশিত চারটি সংবাদপত্র ব্যতীত অন্য সকল সংবাদপত্র  প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সংবাদপত্রের হারানো স্বাধীনতা পর্যায়ক্রমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনে সংবাদপত্রগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং মুদ্রণ ও প্রকাশন আইন সংশোধিত না-হওয়া পর্যন্ত সংবাদপত্রগুলোকে আবারও পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই সরকার ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট এবং প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস্ অ্যাক্ট-এ মৌলিক সংশোধনী আনয়ন করে।  [এম তৌহিদুল আনোয়ার]