সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস
সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত উচ্চ চাপ যুক্ত প্রাকৃতিক গ্যাস। বর্তমানে শহর এলাকায় বায়ু দূষণের সম্প্রসারণের প্রেক্ষিতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসকে বিবেচনা করা হয় পরিবেশের প্রতি অনুকূল জ্বালানি হিসেবে। যানবাহনে ব্যবহূত অন্যান্য প্রচলিত জ্বালানির তুলনায় এই জ্বালানির দূষণ মাত্রা অনেক কম এবং গ্রিন হাউস প্রভাবে এর ভূমিকা সামান্যই। সিএনজিকে ব্যবহার উপযোগী এবং সহজপ্রাপ্য করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাসকে ৩০০০ পিএসআই চাপ প্রয়োগ করে (রান্নার জন্য সরবরাহকৃত প্রচলিত গ্যাসে চুলার কাছে চাপ প্রয়োগের পরিমাণ ২৫ পিএসআই)। প্রাকৃতিক গ্যাসকে সাধারণত পাইপের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্রসমূহে ৩০০০ পিএসআই চাপ প্রয়োগ করে প্রেরণ করা হয়। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে তৈরি করা কমপ্রেসারের সাহায্যে যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার পূর্ণ করা হয়। যে সকল যানবাহনের বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের ব্যবস্থা এবং ট্যাংক (গ্যাস সিলিন্ডার) রয়েছে সেসব সহজেই সিএনজিতে চলতে পারে।
পরিবেশের প্রতি বিরাট হুমকি সৃষ্টিকারী যানবাহন থেকে মারাত্মক নির্গমন সমস্যা বাংলাদেশে সিএনজি রূপান্তরিতকরণ স্থাপনা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। শহরগুলোতে বায়ুমন্ডল মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে, মৃত্যুবৎ কুয়াশার মতো তা শহর এলাকাকে ঘিরে রেখেছে এবং নির্গত ক্ষতিকর উপাদান ও ক্ষতিকর গ্যাসসমূহ এক নীরব ধ্বংসযজ্ঞ সম্পাদন করছে। এসব কিছুর জন্য মূলত যন্ত্রচালিত যানবাহনসমূহই দায়ী। ডিজেল চালিত যানবাহনগুলি সার্বিক যান সংক্রান্ত দূষণের একটি বিরাট অংশের জন্য দায়ী। সিএনজি রুপান্তরিতকরণ স্থাপনা ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরনের যানগুলোতে জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
এ পর্যন্ত ঢাকা শহরের পাঁচটি নির্ধারিত স্থানে সিএনজি রূপান্তরিতকরণ, জ্বালানি সরবরাহ ও বিপণন কেন্দ্র চালু হয়েছে। স্থানসমূহ হলো: জোয়ার সাহারা, মহাখালি, মতিঝিল, আসাদ গেট এবং কল্যাণপুর। এসকল কেন্দ্র পেট্রোবাংলার অধীন রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড (আরপিজিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। প্রথমে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে প্রকল্পের জোয়ার সাহারা সরবরাহ কেন্দ্রে ১৬টি পেট্রোল এবং ১৩টি ডিজেল চালিত যানবাহনকে সফলভাবে সিএনজি চালিত যানে পরিণত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৪-১৯৯৫ সালে ঢাকায় অতিরিক্ত আরো চারটি জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই একই অর্থবৎসরে ৭৫০টি পেট্রোল, ২৫০টি ডিজেল কিট এবং ২০০০ সিএনজি সিলিন্ডার আমদানি করা হয় যানবাহনকে সিএনজি ব্যবহার উপযোগী করার জন্য।
পরবর্তী বৎসরে কোম্পানীটি আরও ১০০০ পেট্রোল কিট আমদানি করে। কিন্তু সকল কেন্দ্রই বিভিন্ন কারণে ক্রেতা অথবা ব্যবহারকারীদের সন্তোষজনক সেবা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। আরপিজিসিএল এ মুহূর্তে যানবাহন সিএনজি চালিতকরণ এবং সিএনজি সরবরাহের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এ পর্যন্ত (২০০০) মাত্র ১২০০টি যানবাহনকে সিএনজি চালিত যানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ১৯৯৬-৯৭ সালে আরপিজিসিএল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ জল পরিবহণ সংস্থার (বিআইডাবিউটিসি) মালিকানাধীন একটি কে-টাইপ ডিজেল ফেরিকে সিএনজি ব্যবহার উপযোগী করেছে। আরিচা ফেরিঘাটে একটি সিএনজি জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন আছে। সরকার ঢাকা শহরে আরও ছয়টি সিএনজি জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং এ লক্ষ্যে ১০০০ পেট্রোল কিট এবং ১০০০ সিলিন্ডার আমদানি ও জোয়ার সাহারা কর্মশালার আধুনিকায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও ১০টি বেবিটেক্সিকে সিএনজি চালিত করার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। সংস্থাটির প্রকৌশলিগণ এর নিজস্ব কারখানায় ইতোমধ্যে তিন চাকার যান ‘মিশুক’ ও ‘বেবিট্যাক্সি’কে সিএনজি চালিত যানে পরিণত করার কাজটি সম্পন্ন করেছে।
জুলাই ২০০০-এ আরপিজিসিএল চীনের তানজিন মেশিনারি ইমপোর্ট এবং এক্সপোর্ট কোম্পানি (টিএমআইইসি)-র সাথে একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণ সংস্থা (সিডিসি) নামক এই প্রতিষ্ঠানটির সারাদেশে ৫১টি সিএনজি বিতরণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি রয়েছে। অংশীদারী এই প্রতিষ্ঠানের ২৫% মালিকানা আরপিজিসিএল-এর, বাকি অংশ টিএমআইইসি’র।
রূপান্তরিতকরণের সুযোগ বৃদ্ধির চাহিদাও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিরাজিত সিএনজি রূপান্তরিতকরণ এবং জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্রগুলির সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সরকার এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে চারটি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান- ন্যাচারাল গ্যাস রিসোর্স লিমিটেড, ইস্ট কোস্ট গ্রুপ লিমিটেড, টেক্সাস গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড এবং প্রেম ইন্টারন্যাশনালকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেয়া হয়েছে সিএনজি রূপান্তরিতকরণ, জ্বালানি সরবরাহ ও বিপণন সুবিধা উন্নয়নের জন্য। শর্তসমূহের মধ্যে একটি হলো উলিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে পরবর্তী পাঁচ বৎসরের মধ্যে স্ব স্ব উদ্যোগে যানবাহনকে সিএনজি চালিত যানে রূপান্তরিত করার পর্যাপ্ত কারাখানা সুবিধাসহ পাঁচটি করে সিএনজি জ্বালানি সরবরাহ এবং বিপণন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোক্তাগণ আশা করছে, কয়েকটি পর্বে বাংলাদেশের যেখানে যেখানে পাইপের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ সুবিধা রয়েছে সেসব এলাকা সিএনজি জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্রসমূহের আওতাভুক্ত হবে। উদ্যোক্তাদের নিকট জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্র এবং রূপান্তরিতকরণ কিটস ও সিলিন্ডার স্থাপনায় নিউজিল্যান্ড/ইউরোপিয়ান মান বজায় রাখার শর্ত আরোপ করা হয়েছে। সিএনজি উৎপাদন এবং বিক্রয়ে গ্যাসশুল্ক নির্ধারিত হবে সরকার কর্তৃক এবং সময়ে সময়ে তা পরিবর্তনের ক্ষমতা সরকার শর্তবলে সংরক্ষণ করে।
একটি যান (কার)-কে সিএনজি চালিত করতে ব্যয় হবে ২২,০০০-৩০,০০০ টাকা, জ্বালানি ট্যাঙ্কের আকারের উপর ব্যয়ের পরিমাণ নির্ভর করে। যদি জ্বালানি সরবরাহ স্থলে (যেখানে যানবাহনে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়) সিএনজির চাপ প্রয়োজনীয় মাত্রায় রাখা যায় তাহলে ৮০ টাকার সিএনজি (৭.৩৫/ঘনমিটার হারে)-তে ঢাকায় একটি মটরকার ১০০ কিমি সহজেই চলতে পারে (একই গাড়িতে অকটেন ব্যবহার করে একই খরচে সর্বোচ্চ ৩০ কিমি যাওয়া সম্ভব, বিরাজিত জ্বালানি মূল্য অনুযায়ী)। সিএনজি চালিত যানসমূহের প্রধান সীমাবদ্ধতাসমূহের একটি হলো তুলনামূলকভাবে কম শক্তি ঘনত্ব (lower energy density)। সিএনজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শক্তির অপচয় ঘটে বিশেষ করে ভারি যানবাহনের ক্ষেত্রে। একবার জ্বালানি নিয়ে সিএনজি বাসগুলি সীমিত দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, (এটি অবশ্য নির্ভর করে সিএনজি সিলিন্ডারের সংখ্যা এবং এদের ধারণক্ষমতার উপর) স্বভাবতই এক্ষেত্রে বার বার জ্বালানি গ্রহণ করতে হয়। সাধারণ ডিজেল চালিত বাস একবার জ্বালানি নিয়ে ৩৫০ কিমি একদিনে চলতে পারে, সে ক্ষেত্রে সিএনজিতে তা যেতে পারবে ২৫০ কিমি। [মুশফিকুর রহমান]
আরও দেখুন প্রাকৃতিক গ্যাস।