শেগুর্ফনামা-ই-বিলায়েত
শেগুর্ফনামা-ই-বিলায়েত ভ্রমণকাহিনীমূলক একটি গ্রন্থ। এটি রচনা করেন মির্জা শেখ ইহতেশামউদ্দীন। ইহতেশামউদ্দীনের পিতা ছিলেন শেখ তাজুদ্দীন বিন শিহাবউদ্দীন। তিনি নদীয়া জেলার পাঁচনুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড সুইন্টনের ফারসি মুনশি হিসেবে ইহতেশামউদ্দীন ১১৭৯ হিজরিতে (১৭৬৫-৬৬ সালে) ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করেন এবং ১১৮৩ হিজরিতে (১৭৬৯-৭০ সালে) ফিরে আসেন। শেগুর্ফনামা-ই-বিলায়েত এর অর্থ হলো লন্ডনের চমৎকার কাহিনীমালা। কাহিনীকার এই গ্রন্থে তাঁর লন্ডন পরিদর্শনের স্মৃতিচারণ করেন। বইটি ফারসি ভাষায় ১৭৮৪ সালে লিখিত হয়। ক্যাপ্টেন জে.ই আলেকজান্ডার বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং ১৮২৭ সালে এটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এই অনুবাদ ত্রুটিপূর্ণ। গ্রন্থটি সহজপ্রাপ্য নয়।
কতিপয় পন্ডিত ইহতেশামউদ্দীনের পিতামহ শিহাবউদ্দীনকে ফতহীয়া-ই-ইবরীয়া বা তারিখ-ই-আসাম গ্রন্থের প্রণেতা শিহাবউদ্দীন তালিশের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন, কিন্তু এই শনাক্তকরণ সঠিক বলে মনে হয় না। ইহতেশামউদ্দীন ১৭৮৪ সালে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন এবং সম্ভবত তিনি ১৮০০ সালের পরে আর জীবিত ছিলেন না। আর ফতহীয়া-র লেখক সম্ভবত ১৬৬৬ সালের পরে মারা যান নি (কেননা এই বছর হঠাৎ করে বই লেখা শেষ হয়ে যায়)। উভয়ের সম্ভাব্য মৃত্যুর তারিখের মধ্যে ১৩৪ বছরের পার্থক্য। এই বিবেচনায় শিহাবুদ্দীন তালিশ গ্রন্থকারের পিতামহ হতে পারেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় লেখক ভালভাবে শিক্ষা গ্রহণ করেন, বিশেষ করে ফারসি ভাষায় ও ইসলামি বিষয়াবলিতে তাঁর পান্ডিত্য ছিল গভীর। নওয়াব মীর কাসিমের সময়কার মুনশি শেখ সলিমুল্লাহ ও মুনশি মির্জা মুহম্মদ কাসিম তাঁর বন্ধু ছিলেন। তিনি কিছু কিছু হিন্দি ও বাংলা শিখেছিলেন। তিনি সুইন্টনকে আরবি বই কালিলা ওয়া দিমনা-তে পাঠ দেন এবং ফারহাং-ই-জাহাঙ্গীরী (ফারসি অভিধান) অনুবাদ করতে সাহায্য করেন। এই অনুবাদ গ্রন্থটি স্যার উইলিয়ম জোনসকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। উইলিয়ম জোনস পরবর্তীকালে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হয়েছিলেন এবং তিনি বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটিরও প্রতিষ্ঠাতা (১৭৮৮)।
শেগুর্ফনামায় ইহতেশামউদ্দীন সমুদ্রপথে জাহাজে চড়ে লন্ডন যাতায়াতের বিবরণ ও লন্ডনে অবস্থানকালে যেসকল নতুন নতুন বিষয় তিনি দেখেছেন তা বর্ণনা করেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালে তিনি মুখ্যত লন্ডনেই থাকেন। তিনি অক্সফোর্ড পরিদর্শনে যান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সঙ্গে মিলিত হন। লন্ডন ও অক্সফোর্ড উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। মির্জা ইহতেশামউদ্দীন ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড সুইন্টনের মুনশি বা সচিব হিসেবে লন্ডন যান, আর সুইন্টনকে মুগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের দূত হিসেবে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের নিকট পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এমন কিছু কারণে তাদের লন্ডন যাত্রার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। মুগল সম্রাটের নিকট থেকে পরিচয়পত্র এবং দশ লক্ষ টাকা মূল্যের ‘খিলাত’ (উপঢৌকন) তাঁদের লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাংলার ইংরেজ গভর্নর লর্ড ক্লাইভ তা তাঁদেরকে দেন নি। সুইন্টন তা জানতেন কিন্তু তিনি বিষয়টি যাত্রার প্রায় সপ্তাহ খানেক পর মীর্জা ইহতেশামউদ্দীনের নিকট প্রকাশ করেন।
ইহতেশামউদ্দীন যখন বুঝলেন যে তাঁদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে তখন তিনি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সুইন্টন এবং তাঁর কিছু বন্ধু-বান্ধব ইহতেশামউদ্দীনকে ফারসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কিছুদিন লন্ডনে থাকার জন্য সম্মত করাতে চেষ্টা করেন। এমনকি তাঁরা তাঁকে ইংরেজ রমণী বিয়ে করানোর প্রলোভনও দেখান, কিন্তু কিছুতেই তিনি রাজি হন নি। বাংলায় ফিরে আসার পর তাঁর কর্মজীবন বিষয়ে আর কিছুই জানা যায় না। তিনি তাঁর গ্রন্থ শেগুর্ফনামা-ই-বিলায়েত ১৭৮৪ সালে রচনা করেন। ভ্রমণ কাহিনীমূলক গ্রন্থসম্ভারে এটি এক মূল্যবান সংযোজন। এখানে এমন কিছু মূল্যবান তথ্য আছে যা বাংলায় ইংরেজ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের কার্যাবলির বিবরণ পুনর্মূল্যায়নে সাহায্য করে। ১৯৩৪ সালে কলকাতার ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সঙ্গে মওলানা আবুল কালাম আজাদের এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে শেগুর্ফনামা-ই-বিলায়েত সর্বপ্রথম বাংলার মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। পরবর্তীকালে পন্ডিতবর্গ বাংলা জার্নালে এই গ্রন্থ সম্পর্কে প্রবন্ধাদি লেখেন। এর মূল ফারসি পান্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও বাঁকিপুরের (বিহার, পশ্চিমবঙ্গ) খোদাবক্স গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। [আবদুল করিম]
আরও দেখুন ইহতেশামউদ্দীন, মির্জা শেখ।