শেখ আলাউল হক (রঃ): সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
'''শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি .রঃ'''''')'''  বিখ্যাত দরবেশ। তিনি ইরানের তাবরিজে জন্মগ্রহণ করেন এবং মুসলমান শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন শেখ আবু সাঈদ তাবরিজির শিষ্য। কিন্তু শেষোক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তিনি শেখ শাহাবউদ্দীন সুহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সুতরাং প্রথমে তিনি ছিলেন সুহরাওয়ার্দীপন্থী একজন দরবেশ, কিন্তু পরে চিশতিয়া রীতি গ্রহণ করেন এবং সবশেষে জালিলিয়া নামে এক নতুন রীতি তাঁর নামের শেষে জুড়ে দেওয়া হয়।
'''শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি (রঃ)'''  বিখ্যাত দরবেশ। তিনি ইরানের তাবরিজে জন্মগ্রহণ করেন এবং মুসলমান শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন শেখ আবু সাঈদ তাবরিজির শিষ্য। কিন্তু শেষোক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তিনি শেখ শাহাবউদ্দীন সুহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সুতরাং প্রথমে তিনি ছিলেন সুহরাওয়ার্দীপন্থী একজন দরবেশ, কিন্তু পরে চিশতিয়া রীতি গ্রহণ করেন এবং সবশেষে জালিলিয়া নামে এক নতুন রীতি তাঁর নামের শেষে জুড়ে দেওয়া হয়।


শেখ জালালুদ্দীনের আধ্যাত্মিক গৌরবময় কীর্তি সংস্কৃত ও ফারসি উৎসের মাধ্যমে জানা যায়। শেক শুভোদয়া (শেখ শুভোদয়া বা শেখের আগমন) একটি সংস্কৃত গ্রন্থ। রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাসদ হলায়ুধ মিশ্রকে এর রচয়িতা বলে গণ্য করা হয়। এ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর অলৌকিক কাজ দিয়ে তিনি স্থানীয় বহু হিন্দুকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেন। তিনি আসন্ন তুর্কি আক্রমণ সম্পর্কেও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
শেখ জালালুদ্দীনের আধ্যাত্মিক গৌরবময় কীর্তি সংস্কৃত ও ফারসি উৎসের মাধ্যমে জানা যায়। শেক শুভোদয়া (শেখ শুভোদয়া বা শেখের আগমন) একটি সংস্কৃত গ্রন্থ। রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাসদ হলায়ুধ মিশ্রকে এর রচয়িতা বলে গণ্য করা হয়। এ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর অলৌকিক কাজ দিয়ে তিনি স্থানীয় বহু হিন্দুকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেন। তিনি আসন্ন তুর্কি আক্রমণ সম্পর্কেও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
১২ নং লাইন: ১২ নং লাইন:
দেওতলা বা দেবতলা পান্ডুয়ার কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত। এখানেও জালালুদ্দীন তাবরিজির কিছু স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। এখানে দরবেশের চিল্লাখানায় চারটি আরবি শিলালিপি পাওয়া গেছে। বাংলার সুলতানগণ ১৪৬৪ থেকে ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে এগুলি উৎকীর্ণ করেছিলেন। সবগুলি শিলালিপিতেই মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। তবে এ শিলালিপিগুলিতে প্রাপ্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে এই যে, দরবেশের স্মৃতিরক্ষার্থে দেওতলার নতুন নামকরণ করা হয়েছিল তাবরিজাবাদ। একটি শিলালিপিতে দেওতলা শহরটিকে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির শহর বলা হয়েছে। এই সকল শিলালিপিই সুলতানি আমলে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে পান্ডুয়ার দরগাহতে প্রাপ্ত শিলালিপিটি হচ্ছে মুগল আমলের। সুতরাং মনে হয় যে, সুলতানি আমলে দেওতলা ছিল পান্ডুয়া অপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেওতলায় প্রাপ্ত স্মৃতিচিহ্নসমূহ ইঙ্গিত দেয় যে, দরবেশ তাঁর জীবনের বেশ বড় একটা অংশ বাংলার দেওতলায় অতিবাহিত করেন। অচিরেই দেখা যাবে যে, তিনি সমাহিতও রয়েছেন দেওতলাতেই।
দেওতলা বা দেবতলা পান্ডুয়ার কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত। এখানেও জালালুদ্দীন তাবরিজির কিছু স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। এখানে দরবেশের চিল্লাখানায় চারটি আরবি শিলালিপি পাওয়া গেছে। বাংলার সুলতানগণ ১৪৬৪ থেকে ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে এগুলি উৎকীর্ণ করেছিলেন। সবগুলি শিলালিপিতেই মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। তবে এ শিলালিপিগুলিতে প্রাপ্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে এই যে, দরবেশের স্মৃতিরক্ষার্থে দেওতলার নতুন নামকরণ করা হয়েছিল তাবরিজাবাদ। একটি শিলালিপিতে দেওতলা শহরটিকে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির শহর বলা হয়েছে। এই সকল শিলালিপিই সুলতানি আমলে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে পান্ডুয়ার দরগাহতে প্রাপ্ত শিলালিপিটি হচ্ছে মুগল আমলের। সুতরাং মনে হয় যে, সুলতানি আমলে দেওতলা ছিল পান্ডুয়া অপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেওতলায় প্রাপ্ত স্মৃতিচিহ্নসমূহ ইঙ্গিত দেয় যে, দরবেশ তাঁর জীবনের বেশ বড় একটা অংশ বাংলার দেওতলায় অতিবাহিত করেন। অচিরেই দেখা যাবে যে, তিনি সমাহিতও রয়েছেন দেওতলাতেই।


পান্ডুয়ার বড়ি দরগাহতে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির কবর পাওয়া যায় না। দেওতলার সঙ্গে দরবেশের সংশ্লিষ্টতা সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাওয়ার কারণে দেওতলাতেও তাঁর কবরের অবস্থান নির্দেশ করা যায় নি। শিলালিপিগুলিতে পাওয়া তাবরিজাবাদ শব্দটির সঠিক পাঠোদ্ধার ১৯৩০-এর আগে পর্যন্ত সম্ভব হয় নি। আগের লিপিবিশারদগণ শব্দটিকে ‘তিরুয়াবাদ’ পড়েছিলেন, যা পন্ডিতদের বিভ্রান্ত করেছিল। শব্দটির নির্ভুল পাঠ তাবরিজাবাদ এবং তাবরিজির মৃত্যুস্থান ও সমাধিস্থল নিশ্চিত করতেও তা সাহায্য করে।  [[আইন-ই-আকবরী|আইন]][[আইন-ই-আকবরী|-ই]][[আইন-ই-আকবরী|-আকবরী]]তে বলা হয়েছে যে, শেখ মারা গিয়েছিলেন দেবমহলে এবং এটি আধুনিক পন্ডিতদের বিভ্রান্ত করেছে। বাংলায় দেবমহল নামে কোন জায়গা নেই; পক্ষান্তরে শেষ জীবনে শেখ বাংলা ত্যাগ করেছিলেন এমন কোন প্রমাণও নেই। আধুনিক পন্ডিতগণ এখন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি দেওতলা ওরফে তাবরিজাবাদে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।
পান্ডুয়ার বড়ি দরগাহতে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির কবর পাওয়া যায় না। দেওতলার সঙ্গে দরবেশের সংশ্লিষ্টতা সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাওয়ার কারণে দেওতলাতেও তাঁর কবরের অবস্থান নির্দেশ করা যায় নি। শিলালিপিগুলিতে পাওয়া তাবরিজাবাদ শব্দটির সঠিক পাঠোদ্ধার ১৯৩০-এর আগে পর্যন্ত সম্ভব হয় নি। আগের লিপিবিশারদগণ শব্দটিকে ‘তিরুয়াবাদ’ পড়েছিলেন, যা পন্ডিতদের বিভ্রান্ত করেছিল। শব্দটির নির্ভুল পাঠ তাবরিজাবাদ এবং তাবরিজির মৃত্যুস্থান ও সমাধিস্থল নিশ্চিত করতেও তা সাহায্য করে।  [[আইন-ই-আকবরী|আইন-ই-আকবরী|-তে বলা হয়েছে যে, শেখ মারা গিয়েছিলেন দেবমহলে এবং এটি আধুনিক পন্ডিতদের বিভ্রান্ত করেছে। বাংলায় দেবমহল নামে কোন জায়গা নেই; পক্ষান্তরে শেষ জীবনে শেখ বাংলা ত্যাগ করেছিলেন এমন কোন প্রমাণও নেই। আধুনিক পন্ডিতগণ এখন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি দেওতলা ওরফে তাবরিজাবাদে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।


জালাল, অর্থাৎ সিলেটের  [[শাহ জালাল (রঃ)|শাহ জালাল ]][[শাহ জালাল (রঃ)|(রঃ]][[শাহ জালাল (রঃ)|)]], নামে বাংলায় আরেকজন বিখ্যাত দরবেশ রয়েছেন। মাঝে মাঝে দুজনকে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। সিলেটের দরবেশ সম্পর্কিত সকল সাক্ষ্য, শিলালিপি ও সাহিত্যিক লেখ্যপ্রমাণ তাঁকে শাহ জালালরূপে অভিহিত করেছে। পক্ষান্তরে পান্ডুয়া ও দেওতলার দরবেশ সম্পর্কিত সকল শিলালিপি ও অন্যান্য লেখ্যপ্রমাণ তাঁকে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজিরূপে আখ্যায়িত করেছে। ফলে আধুনিক পন্ডিতদের মধ্যে একটা ঐকমত্য রয়েছে যে, এ দুজন একই এবং অভিন্ন ব্যক্তি নন।
জালাল, অর্থাৎ সিলেটের  [[শাহ জালাল (রঃ)|শাহ জালাল (রঃ)]], নামে বাংলায় আরেকজন বিখ্যাত দরবেশ রয়েছেন। মাঝে মাঝে দুজনকে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। সিলেটের দরবেশ সম্পর্কিত সকল সাক্ষ্য, শিলালিপি ও সাহিত্যিক লেখ্যপ্রমাণ তাঁকে শাহ জালালরূপে অভিহিত করেছে। পক্ষান্তরে পান্ডুয়া ও দেওতলার দরবেশ সম্পর্কিত সকল শিলালিপি ও অন্যান্য লেখ্যপ্রমাণ তাঁকে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজিরূপে আখ্যায়িত করেছে। ফলে আধুনিক পন্ডিতদের মধ্যে একটা ঐকমত্য রয়েছে যে, এ দুজন একই এবং অভিন্ন ব্যক্তি নন।


শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির মৃত্যু তারিখও একটি বিতর্কিত বিষয়। দুটি তারিখ উপস্থাপন করা হয়: ৬২৩ হিজরি/ ১২২৬ খ্রিস্টাব্দ, এবং ৬৪২ হিজরি/ ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর সমসাময়িক দিল্লির সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ (মৃত্যু ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং মুলতানের শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়ার (মৃত্যু ১২৬২ খ্রিস্টাব্দ) নাম বিবেচনা করলে দুটি তারিখই সম্ভাব্য বলে মনে হয়।  [আবদুল করিম]
শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির মৃত্যু তারিখও একটি বিতর্কিত বিষয়। দুটি তারিখ উপস্থাপন করা হয়: ৬২৩ হিজরি/ ১২২৬ খ্রিস্টাব্দ, এবং ৬৪২ হিজরি/ ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর সমসাময়িক দিল্লির সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ (মৃত্যু ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং মুলতানের শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়ার (মৃত্যু ১২৬২ খ্রিস্টাব্দ) নাম বিবেচনা করলে দুটি তারিখই সম্ভাব্য বলে মনে হয়।  [আবদুল করিম]

১০:০৬, ১৬ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি (রঃ)  বিখ্যাত দরবেশ। তিনি ইরানের তাবরিজে জন্মগ্রহণ করেন এবং মুসলমান শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলায় এসেছিলেন। তিনি ছিলেন শেখ আবু সাঈদ তাবরিজির শিষ্য। কিন্তু শেষোক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তিনি শেখ শাহাবউদ্দীন সুহরাওয়ার্দীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সুতরাং প্রথমে তিনি ছিলেন সুহরাওয়ার্দীপন্থী একজন দরবেশ, কিন্তু পরে চিশতিয়া রীতি গ্রহণ করেন এবং সবশেষে জালিলিয়া নামে এক নতুন রীতি তাঁর নামের শেষে জুড়ে দেওয়া হয়।

শেখ জালালুদ্দীনের আধ্যাত্মিক গৌরবময় কীর্তি সংস্কৃত ও ফারসি উৎসের মাধ্যমে জানা যায়। শেক শুভোদয়া (শেখ শুভোদয়া বা শেখের আগমন) একটি সংস্কৃত গ্রন্থ। রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাসদ হলায়ুধ মিশ্রকে এর রচয়িতা বলে গণ্য করা হয়। এ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর অলৌকিক কাজ দিয়ে তিনি স্থানীয় বহু হিন্দুকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করেন। তিনি আসন্ন তুর্কি আক্রমণ সম্পর্কেও ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।

ফারসি উৎসগুলি হচ্ছে তাজকিরা সাহিত্য। এগুলি প্রাথমিক মুসলমান সুফীদের, বিশেষত উত্তর ভারতের সুফীদের জীবন-বৃত্তান্ত সম্পর্কিত। এসব উৎস এ ধারণা দেয় যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশের রাজত্বকালে (১২১০-১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ) দিল্লিতে এসেছিলেন। সুলতান তাঁকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং সম্মান দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বাংলা অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি বাংলায়ই বসবাস করেন। তিনি একটি খানকাহ নির্মাণ করেন এবং তাঁর শিষ্যদেরকে রহস্যমূলক জ্ঞান দান করেন।

এই দরবেশের বাংলায় আগমনের তারিখ সম্পর্কে সংস্কৃত ও ফারসি উৎসগুলির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। শেক শুভোদয়া অনুসারে তিনি ১২০৪-১২০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই বাংলায় এসেছিলেন। এ তারিখটি হচ্ছে বখতিয়ার খলজির গৌড় জয়ের তারিখ। ফারসি উৎসগুলি অনুসারে তিনি ইলতুৎমিশের সিংহাসনারোহণের (১২১০ খ্রিস্টাব্দ) আগে বাংলায় আসেন নি। তবে আধুনিক পন্ডিতগণ শেক শুভোদয়ার প্রামাণিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দাবি করা হয়েছে যে, শেক শুভোদয়া ছিল হলায়ুধের রচনা এবং তিনি ছিলেন সংস্কৃতে একজন বড় পন্ডিত। কিন্তু শেক শুভোদয়ার ভাষা হচ্ছে অবিশুদ্ধ সংস্কৃত। এটা এতই বিকৃত যে, লক্ষ্মণসেনের একজন জ্ঞানী সভাসদের কলম থেকে এ লেখা উৎসারিত হয়েছে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেন না। এ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এটাওয়াহতে (বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশে)। তিনি ছিলেন মালিক কাফুরের পুত্র এবং রমজান খান নামে এক ব্যবসায়ীর সহায়তায় তিনি শিক্ষালাভ করেছিলেন এবং সেই ব্যবসায়ীর দুষ্কর্মের জন্যই তাঁকে তাঁর জন্মস্থান ত্যাগ করতে হয়েছিল। সব ফারসি উৎসেই তাঁকে তাবরিজি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলায় তাঁর স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে নির্মিত অট্টালিকাগুলিতে প্রাপ্ত সকল শিলালিপিই তাঁকে তাবরিজিরূপে আখ্যায়িত করেছে। এ সবই প্রমাণ করে যে, এই দরবেশ পারস্যের তাবরিজ থেকে এসেছিলেন। তাঁর তাবরিজি খেতাবটি এতই জনপ্রিয় ছিল যে, দেওতলাকে (বাংলায় তাঁর একটি আবাসস্থল) তাঁর নামানুসারে তাবরিজাবাদ নাম দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং আধুনিক পন্ডিতগণ মনে করেন যে, শেক শুভোদয়া গ্রন্থটি নকল। দরবেশের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ গ্রন্থটি রচনা করা হয়েছিল। তারা এটাও নির্দেশ করেছেন যে, আকবরের রাজত্বকালে বাংলায় টোডরমলের রাজস্ব-তালিকা তৈরি করার সময় এ নকল গ্রন্থটি রচনা করা হয়েছিল। ফারসি উৎসগুলি থেকেও দেখা যায় যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি ছিলেন মুলতানের শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া ও দিল্লির শেখ কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকির সমসাময়িক। কাজেই এটা প্রায় নিশ্চিত বলেই প্রতীয়মান হয় যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি ইলতুৎমিশের রাজত্বকালে দিল্লিতে এসেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে বাংলায় চলে যান।

বাংলায় পান্ডুয়া ও দেওতলা এ দুটি জায়গা শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির স্মৃতিবিজড়িত হওয়ার কারণে পবিত্রীকৃত। দীর্ঘদিন ধরে পান্ডুয়া মুসলমান সুলতানদের রাজধানী ছিল এবং এখানেই এই বিখ্যাত দরবেশের দরগাহ অবস্থিত। এটা বড়ি দরগাহ নামে অভিহিত এবং এখানে অনেকগুলি ভবন বিদ্যমান। এগুলি হচ্ছে: ১. একটি জামে মসজিদ, ২. দুটি চিল্লাখানা (চল্লিশ দিনের জন্য নির্জন আশ্রয়স্থান), ৩. একটি তনুরখানা (রান্নাঘর), ৪. একটি ভান্ডারখানা (গুদাম ঘর), ৫. সালামি দরওয়াজা বা প্রবেশদ্বার। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভক্ত এসব ভবন তৈরি করেছিলেন, যার কোনোটিই শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির সময়ের মতো প্রাচীন নয়। দরগাহটি বাইশ হাজারি রূপে পরিচিত, অর্থাৎ দানকৃত ভূ-সম্পত্তির আয় ছিল বাইশ হাজার টাকা। ছোটি দরগাহ (এটি শেখ নূর কুতুব আলমের দরগাহ। তিনি এক শতক পরে পান্ডুয়ায় প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন) থেকে পৃথক করার জন্যই এটি বড়ি দরগাহরূপে অভিহিত।

দেওতলা বা দেবতলা পান্ডুয়ার কয়েক মাইল উত্তরে অবস্থিত। এখানেও জালালুদ্দীন তাবরিজির কিছু স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। এখানে দরবেশের চিল্লাখানায় চারটি আরবি শিলালিপি পাওয়া গেছে। বাংলার সুলতানগণ ১৪৬৪ থেকে ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে এগুলি উৎকীর্ণ করেছিলেন। সবগুলি শিলালিপিতেই মসজিদ নির্মাণের উল্লেখ রয়েছে। তবে এ শিলালিপিগুলিতে প্রাপ্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে এই যে, দরবেশের স্মৃতিরক্ষার্থে দেওতলার নতুন নামকরণ করা হয়েছিল তাবরিজাবাদ। একটি শিলালিপিতে দেওতলা শহরটিকে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির শহর বলা হয়েছে। এই সকল শিলালিপিই সুলতানি আমলে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। পক্ষান্তরে পান্ডুয়ার দরগাহতে প্রাপ্ত শিলালিপিটি হচ্ছে মুগল আমলের। সুতরাং মনে হয় যে, সুলতানি আমলে দেওতলা ছিল পান্ডুয়া অপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেওতলায় প্রাপ্ত স্মৃতিচিহ্নসমূহ ইঙ্গিত দেয় যে, দরবেশ তাঁর জীবনের বেশ বড় একটা অংশ বাংলার দেওতলায় অতিবাহিত করেন। অচিরেই দেখা যাবে যে, তিনি সমাহিতও রয়েছেন দেওতলাতেই।

পান্ডুয়ার বড়ি দরগাহতে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির কবর পাওয়া যায় না। দেওতলার সঙ্গে দরবেশের সংশ্লিষ্টতা সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাওয়ার কারণে দেওতলাতেও তাঁর কবরের অবস্থান নির্দেশ করা যায় নি। শিলালিপিগুলিতে পাওয়া তাবরিজাবাদ শব্দটির সঠিক পাঠোদ্ধার ১৯৩০-এর আগে পর্যন্ত সম্ভব হয় নি। আগের লিপিবিশারদগণ শব্দটিকে ‘তিরুয়াবাদ’ পড়েছিলেন, যা পন্ডিতদের বিভ্রান্ত করেছিল। শব্দটির নির্ভুল পাঠ তাবরিজাবাদ এবং তাবরিজির মৃত্যুস্থান ও সমাধিস্থল নিশ্চিত করতেও তা সাহায্য করে।  [[আইন-ই-আকবরী|আইন-ই-আকবরী|-তে বলা হয়েছে যে, শেখ মারা গিয়েছিলেন দেবমহলে এবং এটি আধুনিক পন্ডিতদের বিভ্রান্ত করেছে। বাংলায় দেবমহল নামে কোন জায়গা নেই; পক্ষান্তরে শেষ জীবনে শেখ বাংলা ত্যাগ করেছিলেন এমন কোন প্রমাণও নেই। আধুনিক পন্ডিতগণ এখন এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি দেওতলা ওরফে তাবরিজাবাদে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

জালাল, অর্থাৎ সিলেটের  শাহ জালাল (রঃ), নামে বাংলায় আরেকজন বিখ্যাত দরবেশ রয়েছেন। মাঝে মাঝে দুজনকে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। সিলেটের দরবেশ সম্পর্কিত সকল সাক্ষ্য, শিলালিপি ও সাহিত্যিক লেখ্যপ্রমাণ তাঁকে শাহ জালালরূপে অভিহিত করেছে। পক্ষান্তরে পান্ডুয়া ও দেওতলার দরবেশ সম্পর্কিত সকল শিলালিপি ও অন্যান্য লেখ্যপ্রমাণ তাঁকে শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজিরূপে আখ্যায়িত করেছে। ফলে আধুনিক পন্ডিতদের মধ্যে একটা ঐকমত্য রয়েছে যে, এ দুজন একই এবং অভিন্ন ব্যক্তি নন।

শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির মৃত্যু তারিখও একটি বিতর্কিত বিষয়। দুটি তারিখ উপস্থাপন করা হয়: ৬২৩ হিজরি/ ১২২৬ খ্রিস্টাব্দ, এবং ৬৪২ হিজরি/ ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর সমসাময়িক দিল্লির সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ (মৃত্যু ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং মুলতানের শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়ার (মৃত্যু ১২৬২ খ্রিস্টাব্দ) নাম বিবেচনা করলে দুটি তারিখই সম্ভাব্য বলে মনে হয়।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি  Shaikh Abdul Haq Dehlavi, Akbar-ul-Akhyar fi Asrar-ul-Abrar; Ghulam Sarwar, Khazinat-ul-Asfiya; Muhammad Enamul Haq, A History of Sufism in Bengal, Dhaka, 1975; Abdul Karim, Social History of the Muslims in Bengal, 2nd edition, Chittagong, 1985.