শুশুনিয়া

শুশুনিয়া  ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত প্রস্তরযুগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলীয় সকল জেলায়ই, যেমন- বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং মেদিনীপুরে প্রস্তরযুগের হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে। ছোটনাগপুর মালভূমির কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাঁকুড়া জেলার উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে প্রচুর পাথরের হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে। ছোটনাগপুরের উত্তর-পশ্চিম অংশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং তা পাহাড়ি অঞ্চল হতে পাললিক সমভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর মাঝখানে ছিল উঁচু-নিচু ভূমি ও শিলাময় কিছু অংশ। প্রত্নস্থানের এ অংশে দাঁড়িয়ে আছে দুটি বড় পাহাড়- বিহারিনাথ (৪৪৭.৮ মি উঁচু) এবং শুশুনিয়া পাহাড় (৪৩৯.৫ মি উঁচু)। এই জেলায় চারটি বড় নদী আছে,  যথা- দামোদর, দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী এবং শীলাবতী। এই জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত দ্বারকেশ্বর নদীতে উত্তর দিক থেকে পতিত হয়েছে পাথুরে তলদেশ সম্বলিত গন্ধেশ্বরী, কুকরা, বিরা এবং ধানকোরা নদী। এগুলির মধ্যে গন্ধেশ্বরী নদীটি বৃহত্তম। নদীটি শুশুনিয়ার উত্তর-পশ্চিম এবং বাঁকুড়া শহরের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভূতশহরের নিকট দ্বারকেশ্বরে মিলিত হয়েছে।

বাঁকুড়ার সকল পাথরযুগের প্রত্নঅঞ্চলের মধ্যে গন্ধেশ্বরীর উত্তরে অবস্থিত শুশুনিয়া হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অঞ্চলটি বিশুদ্ধ স্ফটিক (কোয়ার্টজ), কণিকার স্ফটিক, গোলাপি রঙের ধাতব পদার্থ (ফেলস্পার) প্রভৃতির জন্য সমৃদ্ধ। শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশ এবং গন্ধেশ্বরী, ধানকোরা, জোর নদী ও অন্যান্য ঝরা ও নালার পার্শ্বস্থ অঞ্চল হতে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ প্রাচীন পাথর যুগ এবং পরবর্তী মধ্য, শেষ ও নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার সংগ্রহ করে। সংগৃহীত প্রত্ন সামগ্রী ছিল হস্তকুঠার, ভারী ছুরি, চাছঁনি ইত্যাদি। প্রাচীন পাথর যুগের বেশিরভাগ হাতিয়ার ছিল অ্যাচিলীয় ধরণের এবং সেগুলি ছিল হালকা, সুন্দর ও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করার পর শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে বিভিন্ন প্রত্নযুগের প্রচুর নুড়ি পাথর, বড় আকারের স্ফটিক ও অসংখ্য হাতিয়ারের উপস্থিতির প্রমাণ (শুশুনিয়া ও এর আশেপাশে প্রায় ৩০টি প্রত্নস্থল থেকে সংগৃহীত) স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পানি এবং খাদ্য (কাঁচা মাংস, বুনো ফলমূল) ছাড়াও প্রাগৈতিহাসিক মানুষ এ অঞ্চলে পাথরের হাতিয়ার তৈরির পর্যাপ্ত রসদ পেয়েছিল। একসময় এখানকার ঘন বনের মধ্যে তৃণভোজী ও মাংসাশী পশুর দলের আবাসভূমি ছিল। এ সকল সুযোগ সুবিধার কারণে শুশুনিয়া বাংলার প্রাচীন পাথরযুগের মানুষের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছিল।

শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশ, ধানকোরা ও বাঁকাজোর, বাগদিহা, জামথোল, শিউলিবোনা, সুয়াবসা, গিধুরিয়া, পারুলিয়া, রামনাথপুর, পাহাড়ঘাটা, কুশবোনা, চান্দ্রা এবং ভরতপুর প্রভৃতি প্রত্নস্থল থেকে প্রাচীন প্রস্তর যুগের হাতিয়ার যেমন, ত্রিকোণাকৃতি ও ভল্লাকার ধরণের কুঠার সংগ্রহ করা হয়েছে। হস্তকুঠারগুলির দৈর্ঘ্য ছিল ১০.৪ সেমি থেকে ১৯ সেমি। কোয়ার্টজ এবং কোয়ার্টজাইট পাথরের খন্ডিত অংশ দিয়ে লৈভ্যাল্লোসিয়ান কৌশলে তৈরি ‘ওভেট’ নামে পরিচিত ডিম্বাকৃতির অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে বাগদিহা, বাঁকাজোর, ভরতপুর, গিধুরিয়া, কুশবোনা এবং মেটালা অঞ্চলে। এই হাতিয়ারগুলি আকারে সাধারণত ৭.৫ সেমি × ৬.৪ সেমি থেকে ৮ সেমি × ৭.৩ সেমি পর্যন্ত হতো। উল্লিখিত হাতিয়ার ছাড়াও শুশুনিয়ার নিকটবর্তী স্থানসমূহ থেকে পাওয়া গিয়েছে ইউ-আকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির হাতলসহ ভারী ছুরি এবং চাছঁনি জাতীয় অস্ত্র।

মধ্যপ্রস্তর যুগের অধিকাংশ হাতিয়ারই তৈরি হতো নুড়ি পাথর এবং কোয়ার্টজ জাতীয় পাথরের খন্ডিতাংশ দিয়ে। প্রত্নস্থলে পাওয়া গিয়েছে হাতিয়ারের মূল অংশসমূহ এবং পরিমার্জন করা হয়নি এমন ফলকসমূহ। এসময়ে ক্ষুদ্র অস্ত্রসমূহ যেমন, ছেদক, তীরের ফলা, চাঁছনি, খনন যন্ত্র (৩-৪ সেমি) ইত্যাদিও তৈরি করা হতো। সম্ভবত এ অঞ্চলের নবাগতরাই এসব হাতিয়ারের ব্যবহারকারী ছিল। শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশ, বামুনদিহা, বাবলাডাঙা, ধানকোরা, বিরিবাড়ি, সুয়াবসা, মেটালা, জামথোল, পাহাড়ঘাটা, শিউলিবোনা এবং কুরকুটা প্রত্নস্থলসমূহ থেকে এ যুগের হাতিয়ারসমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে। এর পরে আসে উচ্চ পুরোপলীয় যুগ। এসময়ের ‘বুরিন’ বা পাথরের খোদাই যন্ত্র পাওয়া গিয়েছে। শুশুনিয়ার নিকটবর্তী কয়েকটি প্রত্নস্থলে এ যুগের কিছু হাতিয়ার পাওয়া গিয়েছে।

এই অঞ্চলে শেষ প্রস্তর যুগের ‘পিগমি’ হাতিয়ার বা ক্ষুদ্রাকৃতির পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। এগুলির মধ্যে নিরেট এবং পাথরের ফলকসমূহ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্লেড (এক বা উভয় দিকে সোজা ধারযুক্ত), ছেদক, খোদাই করার সরু ছুরি, চাঁছনি ইত্যাদি। শুশুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশ, পাথরঘাটা, জলজলিয়া, ভরতপুর, শিমুলবেরিয়া, জামথোল, ধানকোরা, বাঁকাজোর, বিরিবাড়ি, হাপানিয়া এবং মেটালা নামক প্রত্নস্থলসমূহ থেকে উক্ত হাতিয়ারসমূহ সংগৃহীত হয়েছে। আকিক, চেলসেডনি, জ্যাসপার প্রভৃতি পাথর দিয়ে তৈরি এ সকল হাতিয়ার আকারের দিক থেকে জ্যামিতিক ধরণের ছিল না।

ব্যসল্ট, ডোলেরাইট, এপিডায়োরাইট প্রভৃতি পাথরের তৈরি নতুন পাথর যুগের (নবোপলীয়) হাতিয়ারসমূহ শুশুনিয়া অঞ্চল থেকে পাওয়া গিয়েছে। সাধারণভাবে ত্রিকোণ আকৃতির- ছোট বা লম্বা বাটালি, কুঠার (অমসৃণ এবং মসৃণ), কাঠ চাঁছার বাইস বাঁকাজোর, চান্দ্রা ও ধানকোরা থেকে পাওয়া গিয়েছে। নানা আকৃতির বাইস পাওয়া গিয়েছে চান্দ্রা, বিশিন্দা, বিরিবাড়ি এবং ধানদোরা অঞ্চলে। এ ছাড়াও শুশুনিয়ার নিকটবর্তী কিছু অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে আংটির পাথর (সম্পূর্ণ বা ভাঙ্গা)।

শুশুনিয়া পাহাড়ের একটি গুহাবর্তে শ্রী সিংহবর্মনের পুত্র ‘পুষ্করণাধিপ মহারাজা শ্রী চন্দ্রবর্মন’-এর নামাঙ্কিত একটি লিপি (চার শতকের বর্ণমালায়) আবিষ্কৃত হয়েছে। পন্ডিতগণ মনে করেন শুশুনিয়া থেকে প্রায় ৪০ কিমি উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত দামোদর তীরবর্তী পোখর্নাই প্রাচীন পুষ্করণ এবং এই  চন্দ্রবর্মণ ও এলাহাবাদ প্রশস্তিতে উল্লিখিত চন্দ্রবর্মন এক ও অভিন্ন।  [শ্যামচাঁদ মুখার্জী]