শিশুশ্রম
শিশুশ্রম শিশুদেরকে বেতন, মুনাফা বা বিনাবেতনে কোন পারিবারিক খামার, উদ্যোগ বা সংস্থায় কাজের জন্য নিয়োগ করা শিশু শ্রমের আওতায় পড়ে। এটিকে শোষণমূলক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং অনেক দেশই এটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন বেশিরভাগ পরিবারকে তাদের সন্তানদের উপার্জনমূলক কাজে জড়িত করতে বাধ্য করে। ১৫ বছরের নিচে বিশ্বের প্রায় এক-দশমাংশ শিশু (১৫০মিলিয়ন) বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত আছে। এর মধ্যে কিছু পেশা রয়েছে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কর্মজীবী শিশুদের বেশির ভাগই চরম দারিদ্র ও বঞ্চনার মধ্যে বড় হয় এবং বেঁচে থাকে। তারা উন্নত জীবনের জন্য শিক্ষাগ্রহণ ও দক্ষতা উন্নয়নের কোন সুযোগ পায় না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে গ্রেট ব্রিটেনে কারখানা চালু হলে সর্বপ্রথম শিশুশ্রম একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে গৃহযুদ্ধের পর এবং দক্ষিণে ১৯১০ সালের পর শিশুশ্রম একটি স্বীকৃত সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। আগেকার দিনে শিশুরা কারখানায় শিক্ষানবিশ অথবা পরিবারে পরিচারক হিসেবে কাজ করত। কিন্তু কারখানাগুলিতে তাদের নিয়োগ দ্রুতই প্রকৃত অর্থে হয়ে দাঁড়ায় দাসত্ব। ব্রিটেনে ১৮০২ সালে এবং পরবর্তী বছরগুলিতে সংসদে গৃহীত আইন দ্বারা এ সমস্যার নিরসন হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে একই ধরনের আইন অনুসরণ করা হয়। যদিও ১৯৪০ সাল নাগাদ বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশে শিশুশ্রম আইন প্রণীত হয়ে যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উৎপাদন বৃদ্ধির আবশ্যকতা বহু শিশুকে আবার শ্রমবাজারে টেনে নিয়ে আসে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৮ এবং ১৯২২ সালে সুপ্রীম কোর্ট মার্কিন কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত শিশুশ্রম আইন অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। ১৯২৪ সালে কংগ্রেসে একটি সংবিধান সংশোধনী পাশ করা হয়, কিন্তু সেটি অনেক অঙ্গরাজ্যেই অনুমোদন পেতে ব্যর্থ হয়। ১৯৩৮ সালে প্রণীত প্রথম লেবার স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্টস ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত পেশার জন্য ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর এবং সাধারণ নিয়োগের জন্য ১৬ বছর ধার্য করে দেয়।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নয়। ২০০৬ সালের শিশু সনদে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশুশ্রম আইনে কারখানায় ১৮ বছরের কম বয়সের শিশুদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গভর্নমেন্ট ন্যাশনাল চাইল্ড সার্ভে (২০০৩) অনুযায়ী ৫ থেকে ১৪ বয়সী ৩.২ মিলিয়ন শিশু বাংলাদেশে কাজ করে। বাংলাদেশে শিশুদের অধিকারের প্রতি সামান্যই গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশু অধিকারের অব্যাহত অপব্যবহার এবং লঙ্ঘন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে এবং এ অবস্থায় শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুদের রক্ষা ও কল্যাণের জন্য প্রণীত আইন ও আইনগত বিধানগুলি হচ্ছে:
ন্যূনতম মজুরি অধ্যাদেশ (১৯৬১) কিশোরসহ সকল শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম মজুরি প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে এবং নিয়োগকারী কর্তৃক কিশোর শ্রমিককে (১৮ বছরের নিচে) এই অধ্যাদেশের আওতায় গঠিত বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের কম মজুরি প্রদান বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
দোকান ও স্থাপনা আইন (১৯৬৫) দোকানে বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ বছরের কমবয়সী শিশুনিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এই আইন ১৮ বছরের কম বয়সী ব্যক্তির জন্য শ্রমঘণ্টাও নির্ধারণ করে দিয়েছে।
কারখানা আইন (১৯৬৫) ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১৪ বছরের কমবয়সী ব্যক্তিকে নিয়োগদান নিষিদ্ধ করেছে এবং শিশু ও কিশোরের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রবিধান দিয়েছে। এছাড়া এই আইন কোন কারখানায় নারী শ্রমিকদের ৬ বছরের নিচে সন্তানদের লালন-পালনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়েছে।
শিশু আইন (১৯৭৪) এবং শিশু বিধি (১৯৭৬) সকল ধরনের আইনগত প্রক্রিয়াকালে শিশুর স্বার্থ রক্ষা করবে। এই আইনে আলাদা কিশোর আদালত গঠনের জন্য বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু অপরাধী যদি যৌথভাবে একই অপরাধ করে থাকে তাহলেও তাদের যৌথ বিচার অনুষ্ঠান করা যাবে না।
খনি আইন (১৯২৩) ১৫ বছরের কম বয়সের কোন ব্যক্তিকে কোন খনিতে নিয়োগদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ১৫ থেকে ১৭ বছরের যুবকদের নিয়োগ প্রদান নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
শিশু নিয়োগ আইনে (১৯৩৮) বলা হয়েছে যে রেলওয়ের কয়েকটি কাজে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না এবং রেলওয়ে কারে অথবা বাসে অথবা কোন বন্দরের অধীন এলাকায় শিশুরা কোন দ্রব্য বিক্রয় করতে পারবে না।
শিশু (শ্রম অঙ্গীঁকার) আইনে (১৯৩৩) ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুর শ্রম চুক্তির অঙ্গীকার অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে একটি সাধারণ দৃশ্য হচ্ছে মেয়ে শিশু অভ্যন্তরীণ ‘মহিলা’ অঙ্গনে আর বালকরা বাইরের ‘পুরুষ’ অঙ্গনে কাজে নিয়োজিত থাকে। এর ফলে বালিকাদের মধ্যে স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি পরিলক্ষিত হয়। শিশুদের শ্রমশক্তি অনেক পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুদের সাথে যে অর্থনৈতিক মূল্য জড়িয়ে আছে তাই জনগণকে বড় পরিবার গঠনে অনুপ্রাণিত করে। শিশুদের নিকট থেকে সাহায্য পাওয়ার প্রত্যাশার জন্ম হয় পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যের সাথে সাংসারিক বোঝা ভাগাভাগি করে নেওয়ার গভীর মনস্তাত্ত্বিক ধারণা থেকে। জীবনের শুরুতেই উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ শিশুদেরকে তাদের শিশুত্বের বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জনে বাধ্য করে। এই পরিবর্তন শিশুর ‘উৎপাদন জীবনচক্র’ অনুধাবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুদের সংগঠিত ও অসংগঠিত উভয় ধরনের খাতেই নিয়োগ দেওয়া হয়। সংগঠিত খাতে শিশুরা আইন দ্বারা প্রতিরক্ষা পায়, কিন্তু অসংগঠিত খাতে তারা এতটা সৌভাগ্যবান নয়। সেখানকার কাজের পরিবেশ অত্যন্ত নিম্নমানের।
এক হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৫-১৪ বছর বয়সী মোট শিশু জনসংখ্যার ১৯%, ছেলেশিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ২১.৯% এবং মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে তা ১৬.১%। অর্থনীতির খাত অনুযায়ী শিশুশ্রমিকদের বণ্টনের চিত্র হচ্ছে: কৃষি ৩৫%, শিল্প ৮%, পরিবহণ ২%, অন্যান্য সেবা ১০% এবং গার্হস্থ্যকর্ম ১৫%। কিন্তু পরিবহন খাতে শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য ব্যাপক। অথাৎর্ যেখানে ০.১% মেয়ে শ্রমিক সেখানে ছেলে শ্রমিক হলো ৩%। তবে শিশুশ্রম নিয়োগের প্রায় ৯৫%-ই ঘটে অনানুষ্ঠানিক খাতে। এদের জন্য সাপ্তাহিক গড় কর্মঘণ্টা আনুমানিক ৪৫ এবং মাসিক বেতন ৫০০ টাকার নিচে। মেয়ে শিশুশ্রমিকের মাসিক বেতন ছেলে শিশুশ্রমিকের তুলনায় গড়ে প্রায় ১০০ টাকা কম। বাংলাদেশের আনুমানিক ২০% পরিবারে ৫-১৪ বছরের কর্মজীবী শিশু রয়েছে। এই সংখ্যা শহুরে পরিবারগুলির জন্য ১৭% এবং গ্রামীণ পরিবারের জন্য ২৩। [মীর শামসুর রহমান]