শিল্পে ব্যবহূত অণুজীব
শিল্পে ব্যবহূত অণুজীব গুরুত্বপূর্ণ শিল্প প্রক্রিয়ায় ব্যবহার্য অণুজীব। এ ধরনের অণুজীব প্রকৃতিতে আলাদাভাবে থাকে এবং এদের ব্যবহারের লক্ষ্যে অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটানো হয়। অণুজীব মাটির জীবসম্পদের অবিচ্ছেদ্য এক উপাদান এবং মাটির জীবীয় ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এদের উপস্থিতি অপরিহার্য। এই ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীবগুলিকে বাতাস, পানি, মাটি, গভীর সমুদ্রর, অতিরিক্ত উষ্ণ পরিবেশ, এমনকি উষ্ণ প্রস্রবণ এবং অতিমাত্রায় পুষ্টিশূন্য আবাসেও দেখা যায়। নির্দিষ্ট গুণের জন্য এরা প্রকৃতি ও মানুষের কাজে সমভাবে ব্যবহারযোগ্য এবং অনেক অণুজীব এখন প্রয়োজনীয় শিল্প উৎপাদনে ব্যবহূত হচ্ছে।
বাংলাদেশে শিল্পে ব্যবহার্য অণুজীবের ওপর অনুসন্ধান বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি সক্রিয় ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিগত কয়েক দশক ধরে কতকগুলি ক্ষেত্রে পরিমিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে চিনি কলগুলির শিল্পবর্জ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অণুজীবের ব্যবহারের আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। আখের গুড়কে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে Aspergillus niger অণুজীবের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আখের গুড় থেকে সাইট্রিক এসিড উৎপাদনের প্রয়াসও গৃহীত হয়। ল্যাবরেটরিতে জীন পরিব্যক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে Aspergillus niger-এর উচ্চ ফলনশীল স্ট্রেইনের বিকাশ ঘটিয়ে সাইট্রিক এসিড উৎপাদনের পরীক্ষা চালানো হয়। আখের ছোবড়াও চিনি কলের একটি বর্জ্য পদার্থ। এটি সেলুলোজসমৃদ্ধ ও জটিল শর্করাজাতীয় পদার্থ। অন্যবিধ ব্যবহারের জন্য উৎসেচকের সাহায্যে সেলুলোজ থেকে সরল চিনিতে রূপান্তর সম্ভব বলে ভাবা হয়েছিল, যদি উৎসেচক সেলুলোজ উৎপাদনকারী অণুজীবকে কম ব্যয়সাপেক্ষে রূপান্তরের কাজে ব্যবহার করা যেত। ল্যাবরেটরিতে শর্করায়ণ নামের এই প্রক্রিয়াকে প্রমিতমানের সেলুলোজ উৎপাদনকারী স্ট্রেইন, যেমন Cellulomonas ও Trichoderma reesei ব্যবহার করে পরীক্ষা করা হয়েছে। একইভাবে, কাগজ ও মন্ড শিল্পে ব্যবহূত জটিল চিনি জাইলানকে (xylan) Thermomyces lanuginosus ও Rhizomucor pusillus স্ট্রেইনের সাহায্যে সরল চিনিতে রূপান্তরে তাদের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। Thermomyces aurantiacus উৎপাদিত কোষ বহির্ভূত সেলুলোজ ও Saccharomyces cerevisiae উৎপাদিত কোষ বহির্ভূত বিটা-গুকানেজও পরীক্ষিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (BCSIR)-এর ল্যাবরেটরিতে সেমি-পাইলট স্কেলে আখের গুড় ব্যবহার করে বেকারির ঈস্ট (yeast) উৎপাদনের গবেষণা চলছে।
চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টরের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। গবাদি পশু ও অন্যান্য প্রাণীর চামড়া প্রক্রিয়াকরণের লক্ষ্যে জীবাণুর সাহায্যে চামড়া থেকে আমিষ ও চর্বি সরানো হয়। এতে পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পাদনের পদক্ষেপ গ্রহণে সুবিধা হয়। প্রোটিয়েজ (protease) ও লাইপেজ (lipase) জাতীয় ক্ষার উৎসেচক এ কাজে ব্যবহারযোগ্য। কতকগুলি ব্যাকটেরিয়া, যেমন, Bacillus-এর কতক প্রজাতি এই উৎসেচক উৎপাদন করে এবং তা কোষ থেকে নিঃসরণ করে। এ ক্ষেত্রেও Bacillus-এর কতকগুলি স্ট্রেইন আলাদা করা হচ্ছে এবং ল্যাবরেটরিতে কোষ-বহির্ভূত প্রোটিয়েজ উৎপাদনের জন্য গবেষণা চলছে।
মৃত্তিকার অনেক অণুজীব যেমন অ্যাক্টিনোব্যাকটেরিয়া, ব্যবহার উপযোগী ব্যাকটেরিয়ারোধী গুণাবলিসহ গৌণ বিপাককারী পদার্থ (metabolite) উৎপাদন করে। এসব পদার্থকে অ্যান্টিবায়োটিক বলে। ব্যবহারযোগ্য ব্যাকটেরিয়ারোধী পদার্থ তৈরির জন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ও গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলিতে অ্যাকটিনোব্যাক্টেরিয়ার বহু মৃত্তিকা বিশেষক অণুজীব নিয়ে গবেষণা কাজ চলছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপক সংখ্যক বিশেষক অণুজীবের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং এদের কয়েকটির কোষ থেকে সক্রিয় পদার্থও শনাক্ত করা হয়েছে। অবশ্য, বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ কোন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উপাদানের সন্ধান এখনও মেলে নি।
দেশে অল্প কয়েকটি গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিল্পে ব্যবহার্য অণুজীব নিয়ে বেশিরভাগ কাজ সম্পাদিত হয়েছে। এর মধ্যে আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, ঢাকা ও অন্যান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান ও জীবরসায়ন বিভাগ ইত্যাদি উলেখযোগ্য। দেশের অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অণুজীববিজ্ঞান বিভাগগুলিতেও স্বল্প পরিমাণ গবেষণা হয়েছে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে ল্যাবরেটরি পরিচালিত শিল্পে ব্যবহার্য অণুজীব বিষয়ে বহু গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। অবশ্য, সত্যিকারের শিল্প উৎপাদনে এসব অণুজীবের প্রয়োগ অনেক ক্ষেত্রে আজও সম্ভব হয় নি।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ডিস্টিলারিগুলিতে ঈস্ট ও ঝোলাগুড় (molasses) ব্যবহার করে আখের গুড় থেকে ইথানল (ethanol) উৎপাদনই বর্তমানে দেশের শিল্পে অণুজীব ব্যবহার সংক্রান্ত বড় প্রক্রিয়া। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি আধা-পরীক্ষামূলক স্কেলে জৈবসার হিসেবে ব্যবহারের জন্য নাইট্রোজেন বন্ধনকারী অণুজীব Rhizobium উৎপাদনের প্রয়াস গ্রহণ করেছে। শিল্পে এই প্রক্রিয়া ব্যবহারের বিষয়টি শিল্প উদ্যোক্তারা বর্তমানে পরীক্ষা করে দেখছেন। [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]