শিকার

শিকার  বিবিধ কৌশল ও অস্ত্র ব্যবহার করে বন্য পশুপাখি নিধন। সুদূর অতীতে হিংস্র প্রাণিজগতের উপর বিজয় অর্জনের সময় থেকেই শিকার প্রথা প্রচলিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বনভূমি আবাদের ফলে মানব জাতির ওপর হিংস্রপ্রাণির হুমকি তিরোহিত হলেও বিনোদনের নামে প্রাণি ও পাখি নিধনের মানবীয় প্রবৃত্তি আজও রয়ে গেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও অরণ্যে প্রাণি ও পাখি শিকার এখনও অনেকের কাছে নেশা ও আনন্দের ব্যাপার।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুঁথিগুলি রাজকীয় পরিবারের সদস্য ও তাদের পার্শ্বচরদের শিকারের কাহিনীতে পূর্ণ। প্রাচীন এবং মধ্যযুগের পান্ডুলিপিচিত্র, মাটির ফলকচিত্র, দেয়াল খোদাইকরণ ও অন্তর্লেখের দৃশ্যসমূহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই সময় মানুষ শিকারে আনন্দ ও গর্ব বোধ করত। লোককথার নায়কদের প্রায়ই শিকারে গিয়ে তাদের প্রিয়তমার সম্মুখীন হতে দেখা যায়। কালিদাসের শকুন্তলা এবং রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা কাহিনীতেও অনুরূপ ঘটনা লক্ষণীয়।

মধ্যযুগের শিকারের চিত্রমালা সাক্ষ্য দেয় যে, রাজকীয় শিকার ঢাকি, শিঙাবাদক, গদাধর, ভারবাহী সমভিব্যাহারে সম্পন্ন হতো। এরা সবাই পদমর্যাদা, সারি ও সংগঠন অনুসারে পদব্রজে, পালকিতে, ঘোড়া বা হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে গমন করত। শিঙা-ঢাকের শব্দ ও পার্শ্বচরদের উচ্চ কোলাহলের ফলে ভীতসন্ত্রস্ত প্রাণিরা তাদের গুপ্ত আশ্রয় থেকে বের হয়ে আসত। কতিপয় মাটির ফলকচিত্রে দেখা যায়, হিংস্র পশুরা শিকারি এবং শিকারাভিযানের প্রাণিদের আক্রমণ করছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, কখনও কখনও পশুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শিকারির অঙ্গহানী বা মৃত্যুর ঘটনাও ঘটত।

ঐতিহাসিকভাবে, ঔপনিবেশিক যুগই শিকারের প্রামাণিক কাল, যখন ইউরোপের সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তা এবং ইঙ্গ-ভারতীয় সমাজের সদস্যগণ শিকারকে বাংলায় তাদের জীবনের প্রায় এক নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত বাংলার প্রাকৃতিক ভূভাগে ছিল বাঘ, চিতাবাঘ, বন্যমহিষ, শূকর, গন্ডার, সরীসৃপ প্রভৃতি অধ্যুষিত অরণ্য এবং জলাভ‚ূম। যেহেতু ব্রিটেনে এগুলোর অভাব ছিল, তাই বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা বিনোদনের উৎস হিসেবে শিকারে বিশেষ উদ্দীপনা খুঁজে পেত।

উপনিবেশ-পূর্ব কালের শাসকশ্রেণির তুলনায় ইউরোপীয়দের শিকারের কৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ব্রিটিশদের শিকারের প্রধান অস্ত্র ছিল বন্দুক। তীর এবং বর্শা ছিল মুগলদের প্রধান অস্ত্র। আবাসস্থল থেকে পশুদের বের হয়ে আসতে বাধ্য করার জন্য মুগলরা ঢক্কাবাদকদের ব্যবহার করত। ব্রিটিশরা একই উদ্দেশ্যে শিকারি কুকুরদের নিয়োগ করে। তারা শিকারিদের জন্য গড়ে তুলেছিল বিশেষ লোকজনের সংগঠন, যারা শিকারি কুকুর রক্ষণাবেক্ষণ করত, বহন করত শিকারের সরঞ্জাম এবং সংগঠিত করত শিকারাভিযান। ব্রিটিশদের কাছে শূকর ছিল শিকারের সবচেয়ে পছন্দনীয় বস্ত্ত। শূকর শিকারকে ব্রিটিশগণ ‘বন্যবরাহ বর্শাবিদ্ধকরণ’ বলে অভিহিত করত। সাংস্কৃতিক কারণে স্থানীয় অভিজাতদের কাছে তা ছিল অপছন্দনীয় ব্যাপার। বন্যবরাহ বর্শাবিদ্ধকরণ অভিযানে ইউরোপীয়রা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়ার ব্যবহার করত। শূকর খুঁজে বের করা এবং তাদের আবাসস্থল হতে বের হয়ে আসতে বাধ্য করার কাজে ডালকুত্তা নিয়োজিত হতো। বাঘ শিকারের সময়, মৃগয়াভূমির মনোনীত স্থানে সুবিধাজনক বৃক্ষে স্থাপিত মাচায় অবস্থান নিয়ে শিকারিরা স্বাভাবিকভাবে ঝুঁকি কমাতে চেষ্টা করত। তারা সংলগ্ন এলাকায় বাঘিনীকে প্রলুব্ধ করার জন্য ছাগল, শূকর ইত্যাদিকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করত। শিকারে নিরাপত্তার লক্ষ্যে ব্যাপকভাবে হাতি ব্যবহার করা হতো। সমসাময়িক দলিল এবং সমাধিলিপির সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায়, যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও ব্যাধরা কখনও কখনও বিরক্ত ও আক্রান্ত পশুদের দ্বারা হয় মৃত্যুবরণ করেছে অথবা আহত হয়েছে।

অভিজাততান্ত্রিক শিকারি ছাড়া শিকারি নামে ঐতিহ্যবাহী এক ব্যাধশ্রেণি আছে। এই নির্দিষ্ট জাতভুক্ত ব্যাধরা পেশাদার শিকারি। শিকার তাদের জীবিকার উৎস, এদের অনধিকারপ্রবেশকারী শিকারজীবী বলা যায়। অনধিকারপ্রবেশের বিরুদ্ধে আইনকানুন থাকা সত্ত্বেও এরা পাখি ও পশু শিকার করে পরিবেশকে বিপন্ন করছে।  [সিরাজুল ইসলাম]