শাহ বারিদ খান
শাহ বারিদ খান মধ্যযুগের আখ্যানকবি। শাহ বারিদ খান ‘বিদ্যাসুন্দর’, ‘রসুল বিজয়’ ও ‘হানিফা-কয়রাপরী’ নামে তিনখানি আখ্যানমূলক কাব্য রচনা করেন। কাব্যের প্রাপ্ত পান্ডুলিপিগুলি খন্ডিত হওয়ায় কবির ব্যক্তিগত পরিচয় জানা যায় না। ভনিতার সামান্য তথ্য থেকে বলা যায়, কবি চট্টগ্রামের নানুপুরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা নানুজান মল্লিক গুণী ব্যক্তি ছিলেন, পিতামহ জিঠাকুরও বিদ্বান, ধার্মিক ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রপিতামহ উজিয়াল মল্লিক শাস্ত্রে ‘বিজ্ঞবর’ ছিলেন। প্র-প্র-পিতামহ ছিলেন পিয়ার মল্লিক। কবির ভাষায়-
পিয়ার মল্লিক সুত/বিজ্ঞবর শাস্ত্রযুত/উজীয়াল মল্লিক প্রধান।
তান পুত্র জিঠাকুর/তিন সিক সরকার/অনুজ মল্লিক মুছা খান\
রসের রসিক অতি/রূপে জিনি রতিপতি/দাতা অগ্রগণ্য অর্কসুত।
ধৈর্যবন্ত যেন মেরু/জ্ঞানেত বাসবগুরু/মানে কুরু ধর্মে ধর্মসুত\
তান সুত গুণাধিক/নানু রাজা মহল্লিক/জগত প্রচার যশ খ্যাতি।
তান সুত অল্পজ্ঞান/হীন সাবিরিদ খান/পদবন্ধে রচিত ভারতী\-
(বিদ্যাসুন্দর, পৃ. ১১)
‘মল্লিক’ ছিল মুগল আমলের রাজ-প্রদত্ত উপাধি। কবির নাম সাবিরিদ খাঁ, শা’ বারিদ খাঁ ইত্যাদি রূপে লেখা হয়েছে। ফারসি অভিধানে ‘বারিদ’ শব্দ আছে, যার অর্থ যোগাযোগ কর্তা; ‘সাবিরিদ’ শব্দ নেই। অনুমিত হয়, কবির প্রকৃত নাম বারিদ খাঁ ছিল, সুফিতত্ত্বে জ্ঞান অর্জন করে ‘শাহ’ উপাধি পান। শাহ বারিদ খান আরবি-ফারসি ভাষা ছাড়াও সংস্কৃত ভাষা জানতেন; বিদ্যাসুন্দর কাব্যের উৎস সংস্কৃত চৌরপঞ্চাশিকা বা বিদ্যাসুন্দরম্ কাব্য; উপরন্তু তাঁর কাব্যের নানা স্থানে সংস্কৃত ভাষায় রচিত পাত্রপাত্রী-স্থান-কাল সূচক নির্দেশনা আছে। কাব্যের রচনা-জ্ঞাপক কোনো পদবন্ধ পাওয়া যায়নি; কাব্যের ভাষাভঙ্গি ও শব্দরূপ লক্ষ করে পন্ডিতগণ কবির আবির্ভাবকাল ষোল শতক বলে নির্ধারণ করেছেন। তিনি ভারতীয় উৎস থেকে বিদ্যাসুন্দর এবং আরব-ইরান উৎস থেকে রসুল বিজয় ও হানিফা-কয়রাপরী কাব্য রচনা করেন। বিদ্যাসুন্দর ও হানিফা-কয়রাপরী রোমান্সসূলভ প্রণয়কাব্য, রসুল বিজয় ইসলামের গৌরব-গাথা। হানিফা-কয়রাপরী ও রসুল বিজয় কাব্যে যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রাধান্য থাকায় উভয় কাব্যকে জঙ্গনামা নামেও চিহ্নিত করা হয়। প্রথম কাব্যে রত্নাবতীর রাজপুত্র সুন্দরের সঙ্গে কাঞ্চিপুরের রাজকন্যা বিদ্যাবতীর রূপ-গুণ ও প্রণয়াকর্ষণ বর্ণিত হয়েছে; পুথি খন্ডিত বলে বাকি অংশ জানা যায় না। দ্বিতীয় কাব্যে হজরত আলীর বীরপুত্র হানিফার সঙ্গে সহীরামের রাজকন্যা বীরাঙ্গনা জয়গুনের প্রথমে যুদ্ধ ও পরে প্রেম-পরিণয়ের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। কাব্যে অন্য অনেক যুদ্ধ, রাজ্যজয় ও ইসলাম প্রচারের বিষয়টিও অনুচ্চারিত থাকেনি। রসুল বিজয় কাব্যের মূল সুরই ছিল ইসলাম প্রচার। হজরত মহম্মদ (স.) দিগ্বিজয়ে বের হয়ে বহু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং অনেক শত্রুকে পরাভূত করে ইসলামে দীক্ষিত করেন। হানিফা-কয়রাপরী ও রসুল বিজয় উভয় কাব্যের অধিকাংশই ঘটনা ও চরিত্র অনৈতিহাসিক ও কাল্পনিক। শাহ বারিদ খান নাটগীতির আঙ্গিকে রচিত প্রথম কাব্যে রচনা-চাতুর্য ও শিল্পগুণের পরিচয় দিলেও পরের দুটি ঘটনাসর্বস্ব ও বিবৃতিমূলক কাব্যে তা ধরে রাখতে পারেননি। তিনি আরব-ইরানের কাহিনী আমদানি করে ওই যুগে বাংলাদেশে মুসলিম সংস্কৃতির ভিত্তি রচনা করেন। কবির ভাষা ছিল শুদ্ধ ও মানসম্পন্ন। [ওয়াকিল আহমেদ]