শাহজাদপুর মসজিদ
শাহজাদপুর মসজিদ সিরাজগঞ্জ জেলার অন্তর্গত শাহজাদপুর সদরের একেবারে শেষপ্রান্তস্থিত দরগাপাড়ায় হুরাসাগর নদীর পাড়ে অবস্থিত। বিশ্বাস করা হয় যে, পনেরো শতকে প্রখ্যাত সুফীসাধক মখদুম শাহ এ মসজিদ নির্মাণ করেন। কোন লিপি প্রমাণে এর তারিখ নির্ণয় করা হয় নি। মসজিদের স্থাপত্য রীতি ও অলংকরণ শৈলী ইঙ্গিত দেয় যে, মসজিদটি পনেরো শতকে নির্মিত হয়েছিল।
বহুগম্বুজ বিশিষ্ট আয়তাকার মসজিদের তিন সারিতে পাঁচটি করে মোট পনেরোটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য ১৯.১৩ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থ ১২.৬০ মিটার। অভ্যন্তর ভাগে এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১৫.৭৭ মিটার ও ৯.৬০ মিটার এবং দেওয়াল ১.৫৭ মিটার পুরু। এ মসজিদ কিবলা কোঠা দেওয়ালের লম্বে, পাঁচটি স্তম্ভপথে (‘বে’) এবং উত্তর-দক্ষিণে তিনটি স্তম্ভপথে (‘আইল’) বিভক্ত হয়ে মোট পনেরটি চতুষ্কোণাকার এলাকায় বিভক্ত হয়েছে। বর্গাকার নিম্নভাগ থেকে গম্বুজ স্থাপনের জন্য বৃত্ত নির্মিত হয়েছে উপরে পেন্ডেন্টিভের মাধ্যমে। জুল্লাতে রয়েছে দুসারিতে দন্ডায়মান মোট আটটি কালো ব্যাসাল্ট পাথরের স্তম্ভ।
স্তম্ভগুলি মোটামুটি অষ্টভুজাকৃতির এবং এগুলির ভিত ও ক্যাপিটালও বর্গাকৃতির। পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে চারটি অন্তঃপ্রবিষ্ট মিহরাব; পাঁচটি মিহরাব নেই এই কারণে যে, কেন্দ্রীয় মিহরাবের ডানপার্শ্বে ঠিক একটি মিহরাবের স্থলে মসজিদের একমাত্র দ্বিতল মিম্বারটি অবস্থিত। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বেশি অলংকৃত। পাঁচটি স্তম্ভপথের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে পূর্ব দিকে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশপথ। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়াল তিনটি করে প্যানেলে বিভক্ত, এতে আদিতে প্রবেশপথ থাকলেও বহু পূর্বেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনতিউচ্চ গম্বুজগুলি স্কন্ধবিহীন এবং সরাসরি ছাদ থেকে উত্থিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে যদিও স্তম্ভগুলি অষ্টভুজাকৃতির বলা হয়, কিন্তু এর প্রত্যেকটি স্তম্ভ একটি অপরটি থেকে কিছু পরিমাণে ভিন্ন। স্তম্ভগুলি বিভিন্ন রকম হওয়াতে ঝুলন্ত শিকল ঘণ্টার নকশাও সবগুলি খন্ডে দেখা যায় না। সুলতানি আমলের অধিকাংশ ইমারতের স্তম্ভে খোদিত শিকল ঘণ্টা, চক্রাকার ফুল, লতাপাতা, আরবি লিপি ও জ্যামিতিক রেখাচিত্রের সঙ্গে এ মসজিদের নকশায় যথেষ্ট মিল লক্ষণীয়। এ মসজিদের দেওয়ালে অবিচ্ছেদ্যভাবে নিয়মিত দূরত্বে বারোটি নিমগ্ন স্তম্ভ (pilaster) ও চার কোণে চারটি জোড় স্তম্ভ পাথরে তৈরি এবং খিলানগুলি দ্বিকেন্দ্রিক কৌণিক রীতির। মসজিদের ভেতর দেওয়ালগাত্রে সমদূরবর্তী অবস্থানে প্রদীপ কুলুঙ্গি রয়েছে।
অতি সামান্য বক্রাকার কার্নিসের বৈশিষ্ট্যটি শাহজাদপুর মসজিদে পরপর তিনটি সারির উদ্গত ইট রেখার মাধ্যমে এক আকর্ষণীয় রূপ লাভ করেছে। কার্নিসের নিচে টেরাকোটা অলংকরণের একটি মাত্র অক্ষত সারি সমান্তরালভাবে প্রাচীরের চারদিকে, বিশেষ করে পূর্ব দেওয়ালে দৃশ্যমান। সম্ভবত মুগল আমলে সংস্কারের সময়ে মূল টেরাকোটা নকশা দেওয়ালগাত্র থেকে লুপ্ত হয়ে যায়। মসজিদের অলংকরণের মধ্যে রয়েছে আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে সংস্থাপিত প্রবেশপথগুলি। প্রতি দুটি প্রবেশপথের মাঝে বহির্দেওয়ালে আয়তাকার ছোট ছোট প্যানেলের অভ্যন্তর ভাগ খাঁজবিশিষ্ট খিলানে অলংকৃত। এ খাঁজ খিলানের উপর থেকে ঝুলন্ত কলার মোচাকৃতির নকশা ছাড়া উপরিভাগে রয়েছে শিরাল নকশা। এখানে চোখা দাঁতের ন্যায় খাঁজ খাঁজ নকশা, মুক্তাদানার নকশা ও চক্রাকার ফুলের নকশা দেখা যায়। ফাসাদের প্যানেল নকশার অনুরূপ নকশা-অলংকার রামপালের (মুন্সিগঞ্জ) বাবা আদম মসজিদে (১৪৮৩ খ্রি) দেখা যায়। এ মসজিদে কোন পার্শ্ব বুরুজ নেই। এ মসজিদের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বৈশিষ্ট্য এর সাত ধাপবিশিষ্ট গম্বুজযুক্ত দ্বিতল মিম্বার। বাংলাদেশে অবস্থিত অন্যতম প্রাচীন এই মসজিদে প্রাথমিক সুলতানি আমলে বিকশিত মসজিদ স্থাপত্যরীতির সকল বৈশিষ্ট্যই পরিলক্ষিত হয়। [আয়শা বেগম]