শরাফী, কলিম
শরাফী, কলিম (১৯২৪-২০১০) উপমহাদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব। ১৯২৪ সালের ৮ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শিউরি মহকুমার খয়রাডিহি গ্রামে এক পীর বংশে নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সৈয়দ সামি আহমেদ, মা বেগম আলিয়া। ৪ বছর বয়সে তিনি তাঁর মাকে হারান। নানির স্নেহে তাঁর শৈশবের দিনগুলো অতিবাহিত হয়।
১৯৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রাবস্থায় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন তৎকালীন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী। ওই সময় তিনি গ্রেফতার হয়ে বীরভূমের সিউড়ী জেলে ১৫ মাস কারাবন্দী থাকার পর ১৯৪৩ সালে কারামুক্ত হন। ওই সময় শ্রীমতি রানী চন্দের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্রী। তার প্রেরণায় কলিম শরাফী গণসঙ্গীত শিখতে আগ্রহী হন।
১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। ১৯৪৩ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সূচনা ঘটলে বহুরূপী নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে বিভিন্ন গানের স্কোয়াডে যোগদান করেন এবং পাশাপাশি নাটকেও অভিনয় করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কৃষ্ণনাথ কলেজে এবং ১৯৪৫ সালে তিনি ক্যাপিটাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু গণনাট্য সংঘের হয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হলে তাঁর ডাক্তারী পড়ার অবসান ঘটে। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি হন। এসময় তিনি উত্তর কলকাতার প্রগতিশীল সংস্কৃতি ধারার নেতা সুধি প্রধানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। এবছর তিনি কলকাতায় মুসলিম প্রধান অঞ্চলে দাঙ্গার বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এসময়ই এইচএমভি থেকে বের হয় তাঁর গণসঙ্গীতের প্রথম রেকর্ড। সুবিনয় রায় ও শৈলজারঞ্জনের কাছে সঙ্গীত বিষয়ে দীক্ষা নিয়ে ১৯৪৭ সালে তিনি শুভ গুহঠাকুরতা প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত বিদ্যালয় ‘দক্ষিণী’তে যোগদান করেন।
৪৬-এর দাঙ্গার প্রথমে তিনি গণসঙ্গীত গাইলেও পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত-চর্চার দিকেই বেশি মনোনিবেশ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং পরে মুক্তি পান। ১৯৪৮ সালে যখন গণনাট্য সংঘের বিশৃঙ্খল অবস্থা, তখন কলিম শরাফী মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, মোঃ ইসমাইল প্রমুখের সঙ্গে মিলে ‘বহুরূপী’ নাট্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত নাট্য সংস্থাটি নবান্ন, পথিক, ছেড়াতার, রক্তকরবী, ইত্যাদি নাটকের সফল মঞ্চায়ন করে।
কলিম শরাফী দুর্ভিক্ষের সময় (পঞ্চাশের মন্বন্তর) নঙ্গরখানায় কাজ করতে গিয়ে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফফর আহমদের সংস্পর্শে এসে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। এসময় তিনি আর্থিক দুরাবস্থায় দিনাতিপাত করেন। ফলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আব্দুল আহাদ ও কবি সিকান্দার আবু জাফরের আহবানে ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকায় এসে বেতারে যোগদান করেন। ঢাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত বিশেষত সুকান্তের ‘অবাক পৃথিবী’ গানটি গেয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নজরে পড়েন। ফলে তিনি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে গিয়ে বসবাস করেন এবং সেখানে গড়ে তোলেন ‘প্রান্তিক’ নাট্যদল। এ কাজে তাঁর সঙ্গী ছিলেন একুশের কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, চিরঞ্জীব দাশ শর্মা, অচিন্ত্য চক্রবর্তী, এমএ সামাদ, রমেন মজুমদার, ফওজিয়া সামাদ, নিত্যগোপাল দত্ত প্রমুখ। ১৯৫১ সালে তিনি চট্টগ্রাম ‘জিইটি জেড ব্রাদার্স’ নামে একটি আমেরিকান কোম্পানিতে যোগদান করেন। একই বছর তিনি একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে কিছু সময় কাজ করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকার কার্জন হলের সাহিত্য সম্মেলনে ‘প্রান্তিক’ দল নাটক ও নৃত্যসঙ্গীত পরিবেশন করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৫৬ সালে ৯২-ক ধারা জারির ফলে শেরে বাংলার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করা হলে তিনি আবার পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েন এবং আত্মগোপনে বাধ্য হন। এবছরই তিনি ড. আনিছুর রহমান ও ড. রফিকুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে হ-য-ব-র-ল সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ নাটকটি মঞ্চায়ন করেন। তাঁর প্রথম পেব্যাক হয় ১৯৫৭ সালে পূর্ব বাংলায় নির্মিত আকাশ আর মাটি ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। ১৯৫৮-১৯৭১ সাল পর্যন্ত রেডিওতে নিষিদ্ধ ছিল তাঁর গান। ১৯৬২ সালে তিনি এসএস মাসুদ প্রযোজিত সোনার কাজল ছবি পরিচালনা করেন। এসময় তিনি প্রামাণ্যচিত্র ভেনিস নির্মাণ করেন, চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। ১৯৬৪ সালে জাপানি কারিগরি সহায়তায় পাকিস্তানে এনইসি নামে টেলিভিশন চালু হলে তিনি উক্ত টেলিভিশনের অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় কলিম শরাফীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী চক্রান্ত আবারও চলতে থাকে। তাঁর পাসপোর্ট নিষিদ্ধ করে জাপানে একটি প্রশিক্ষণে যাওয়া থেকে তাঁকে বিরত রাখা হয়। পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রোগ্রাম ডিরেক্টরের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবছর তিনি উদীচীর সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ব্রিটিশ কোম্পানি পরিচালিত রেকর্ডিং স্টুডিওতে ম্যানেজার ইস্ট পাকিস্তান হিসেবে যোগদান করেন। পরে জেনারেল ম্যানেজার, ডিরেক্টর ও জেনারেল ম্যানেজার ইস্ট পাকিস্তান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় একুশে উদযাপন উপলক্ষে গঠিত কমিটিতে কলিম শরাফীর নাম তালিকাভূক্ত করা হয়। পরে উক্ত তালিকা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাঁকে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। কলিম শরাফী ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’(১৯৭৯, পরে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’)-এর প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক ছিলেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ‘সঙ্গীত ভবন’ নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উক্ত ‘সঙ্গীত ভবন’ এবং বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সংস্থার তিনি সভাপতি ছিলেন। নববইয়ের দশকে কলিম শরাফী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করেন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণআদালতে সম্পৃক্ত হওয়ায় ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় এবং ১৯৯৫ সালের ২৫ মার্চ ঘাতক-দালাল বিরোধী গণসমাবেশে অংশগ্রহণ করায় দেশের ২৪ বরেণ্য ব্যক্তির সঙ্গে তাঁকেও মামলার আসামী করা হয়।
কলিম শরাফীর সঙ্গীত জীবন দীর্ঘ হলেও তাঁর প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা মাত্র ১৮টি; ১৫টি ক্যাসেট, ৩টি সিডি। সঙ্গীতাঙ্গনে বিশিষ্ট অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কলিম শরাফী একুশে পদক (১৯৮৫), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৯), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুব উলাহ স্বর্ণপদক, শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র থেকে কৃতী বাঙালি সম্মাননা পদক, বাংলা একাডেমী কর্তৃক রবীন্দ্রপদক (প্রথম, ২০১০) এবং মেরিল প্রথম আলো তারকা জরিপ পুরষ্কার ২০০৬-এর আজীবন সম্মাননা পদকে ভূষিত হন। ২০১০ সালের ২ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। [শামীমা আক্তার]