শবে মিরাজ

শবে মিরাজ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের একটি তাৎপর্যময় ও অলৌকিক ঘটনা। ‘শবে-মিরাজ’ একটি যৌগিক শব্দ। ‘শব’ শব্দটি ফারসি, অর্থ রাত। ‘মিরাজ’ শব্দের অর্থ সিঁড়ি, ঊর্ধ্বগমন, আরোহণ ইত্যাদি, এটি আরবি শব্দ।

নবুয়তের একাদশ বছরের ২৬ রজব দিবাগত রাতে মহানবী (সা.) উম্মেহানীর ঘরে শায়িত ছিলেন। এ অবস্থায় তাঁর নিকট মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরীল (আ.) ঊর্ধ্ব জগৎ ভ্রমণ ও আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভের আমন্ত্রণ নিয়ে আগমন করেন। জিবরীল (আ.) সেখান থেকে তাঁকে কাবা চত্বরে নিয়ে আসেন। সেখানে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করা হয়। এরপর তাঁকে প্রথমে বায়তুল মাকদাস এবং বায়তুল মাকদাস থেকে মহান আল্লাহর আরশ পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। ইসলামের ইতিহাসে মহানবী (সা.)-এর এ ভ্রমণই মিরাজ নামে পরিচিত। মিরাজ কোনো স্বপ্ন ছিল না বরং মিরাজ সশরীরে, সজ্ঞানে ও জাগ্রত অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়।

এ ভ্রমণকে দুটি ধাপে ভাগ করা হয়। প্রথম ধাপের ব্যপ্তি কাবা চত্বর থেকে বায়তুল মাকদাস পর্যন্ত। পবিত্র কুরআনে এ অংশকে ‘ইসরা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসরা শব্দের অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। রাতে সংঘটিত হওয়ায় এ ঘটনাকে ‘ইসরা’ বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনি পবিত্র (আল্লাহ) যিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রিভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত।’ মিরাজ গমণের দ্বিতীয় ধাপ শুরু বায়তুল মকাদাস থেকে, শেষ মহান আল্লাহর আরশে আজিমে। পবিত্র কুরআনের সূরা নজমের ১-১৮ নং আয়াতে মিরাজ সম্পর্কিত বর্ণনা রয়েছে। হাদিস গ্রন্থগুলোতে ২৬ জন সাহাবী কর্তৃক ইসরা এবং মিরাজ সম্পর্কে প্রামাণ্য বর্ণনাসূত্রে বেশ কিছু সহীহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

মিরাজ রজনীতে মহানবী (সা.) উম্মে হানী (রা.)-এর ঘরে শায়িত ছিলেন। সে অবস্থায় হযরত জিবরীল (আ.)-এর আগমন ঘটে। মহান আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল (আ.) তাঁকে কাবা চত্বরে নিয়ে যান এবং সেখানে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করেন। এরপর শুরু হয় ভ্রমণ। অলৌকিক বাহন বোরাকে আরহণ করিয়ে প্রথমেই তাঁকে কাবা চত্বর থেকে বায়তুল মাকদাসে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বায়তুল মাকদাসে অন্যান্য নবীদেরকেও উপস্থিত দেখতে পান। এ সময় জিবরীল (আ.) তাঁকে নামাযে ইমামতি করতে বললে তিনি সকল নবীর ইমাম হয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করেন।

বায়তুল মাকদাস ভ্রমণ শেষে শুরু হয় ঊর্ধ্বাকাশে যাত্রা। যাত্রা পথে প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত ও কুশল বিনিময় হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁকে পরামর্শ প্রদান করেন ও তাঁর কল্যাণের জন্য দু‘আ করেন।

অতঃপর তিনি বায়তুল মামুরে পৌঁছান। বায়তুল মামুর ফিরেশতাদের নামায আদায়ের স্থান। বায়তুল মামুরে তাঁর সামনে হাজির করা হয় এক পাত্র মদ, এক পাত্র দুধ ও এক পাত্র মধু। তার মধ্য হতে তিনি দুধ গ্রহণ করেন (এবং তা পান করেন)। তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম তাঁকে বলেন, এটা ফিত্বরাত-এর (স্বভাব-ধর্মের) নিদর্শন। আপনি এবং আপনার উম্মত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবেন।

এরপর তাঁকে মহাকাশের প্রান্তসীমা বা সপ্তম আকাশের সর্বশেষ সীমানা সিদরাতুল মুনতাহায় নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সেখানে চারটি নদী দেখতে পান। যার দুটি প্রকাশ্য ও দুটি অপ্রকাশ্য। অপ্রকাশ্য দুটি নদী জান্নাতের আর প্রকাশ্য নদী দুটি হলো নীল ও ফোরাত। সর্বশেষে মহানবী (সা.) আরশে আজিমে গমন করেন এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করেন। সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত জিবরীল (আ.)-এর গমণের অনুমতি রয়েছে। সেখান থেকে একাকী মহানবী (সা.) রফরফ নামক বাহনে আরোহণ করে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ করেন।

মহান আল্লাহ মিরাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তিনটি উপহার প্রদান করেন। ১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত। ২. সূরাহ আল বাক্বারার শেষ কয়েকটি আয়াত এবং ৩. নবী (সা.) -এর উম্মতের মধ্য হতে যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি, তাদের ক্ষমা করার প্রতিশ্রুতি। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবী (সা.)-এর উম্মতের জন্য প্রথমে ৫০ ওয়াক্তের নামায ফরজ হওয়ার নির্দেশ হয়। ক্রমান্বয় তা কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেওয়া হয়।

মিরাজ রজনীতে মহানবী (সা.)-কে জান্নাত, হাউযে কাউসার, জাহান্নাম, জাহান্নামে বিভিন্ন পাপের শাস্তি, মহান আল্লাহর নূরের জগৎসহ আরও অসংখ্য নিদর্শন দেখানো হয়।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মতো বাংলাদেশের মুসলমানরাও এ রাতটিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে উদযাপন করে থাকেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাতীয়ভাবে এ দিবস উদযাপন করা হয়। এর পাশাপাশি মসজিদে মসজিদে, পাড়ায়-মহল্লায় শবে মিরাজের ঘটনা ও শিক্ষা বিষয়ে আলোচনা সভা, মিলাদ ও দু‘আ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ রাতে অধিক পরিমাণে নফল ইবাদাত পালন করে থাকেন, অসহায় দরিদ্রদের মাঝে খাবার বণ্টন করে থাকেন। [মোহাম্মদ আবদুর রশিদ]

তথ্যসূত্র আল কুরআন, সুরা-১৭; ইসরা-বনি ইসরাইল, আয়াত: ১; আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, আস সহীহ, হাদিস নং ৩৪২; মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আন নিশাপুরী, আস সহীহ, হাদিস নং ৩০৮; আবু আবদির রহমান ইবনে শোয়াইব আন নাসায়ী, আস-সুনান, হাদিস নং ৪৫১; আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, আস সহীহ, হাদিস নং ৩৪৯; আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, আস সহীহ, হাদিস নং ৩৬৭৪; শায়েখ ওয়ালীউদ্দীন, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং ৫৮৬২; মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আন নিশাপুরী, আস সহীহ, হাদিস নং ৩২৮; শায়েখ ওয়ালীউদ্দীন, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং ৫৮৬২; আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, আস সহীহ, হাদিস নং ৩৪৯; শায়েখ ওয়ালীউদ্দীন, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং ৫৮৬৫; আবু ঈসা মুহাম্মদ বিন ঈসা আত তিরমিযী, আস-সুনান, হাদিস নং ২১৩; আবু ঈসা মুহাম্মদ বিন ঈসা আত তিরমিযী, আস-সুনান, হাদিস নং ৩১৪৭; মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আন নিশাপুরী, আস সহীহ, হাদিস নং ১৬৫; আল কুরআন, সুরা-১৭; ইসরা-বনি ইসরাইল, আয়াত: ১ ও সুরা-৫৩; আন-নাজম, আয়াত: ১-১৮