শঙ্খশিল্প

শঙ্খশিল্প  লোকশিল্পের একটি প্রাচীনতম ও উল্লেখযোগ্য শাখা। নানা পৌরাণিক অনুষঙ্গ এবং ঐতিহাসিক উপাদান এ শিল্পের প্রাচীনতার স্বাক্ষর বহন করছে। দাক্ষিণাত্যে প্রায় দুহাজার বছর পূর্ব থেকে এ শিল্পের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। তামিলনাড়ুর প্রাচীন রাজধানী কোরকাই এবং কায়েলের ভগ্নস্তূপ থেকে শঙ্খশিল্পের প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। Maduraikkanchi ও Silappathikaram (আনু. ১ম শতক) নামে তামিল ভাষার দুটি কাব্য থেকে জানা যায় যে, কোরকাই ও গুজরাটের নানা শহরে শঙ্খশিল্প বিকশিত হয়েছিল। মাদ্রাজ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত শঙ্খশিল্পের নিদর্শন দেখে জেমস হরনেল বলেন যে, খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতকেই মহীশূর, হায়দ্রাবাদ, গুজরাট, কাথিয়াবার প্রভৃতি অঞ্চলে শঙ্খশিল্প বিকাশ লাভ করেছিল। পরে শঙ্খশিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এবং ক্রমে ঢাকা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে শঙ্খশিল্পের প্রধান কেন্দ্র।

শঙ্খসামগ্রী

কোরকাই থেকে ঢাকা শহরে শঙ্খশিল্প কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণ হিসেবে হরনেল মনে করেন, মালিক কাফুর কর্তৃক চতুর্দশ শতকে টিনেভেলি জেলায় হিন্দুরাজ্য ধ্বংসের পর সে অঞ্চলের শঙ্খশিল্পীরা ঢাকায় চলে আসে। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেনের মতে ঢাকায় স্বাধীনভাবেই শঙ্খশিল্পের বিকাশ ঘটে। তিনি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে বঙ্গনারীদের শঙ্খের ব্যবহার লক্ষ্য করেই এরূপ মন্তব্য করেছেন।

ঢাকায় বল্লাল সেনের (১২শ শতক) আমল থেকে শঙ্খশিল্পের প্রচলন হয় বলে অনুমান করা হয়। শাঁখারি সম্প্রদায় প্রথমে বিক্রমপুরে বসতি স্থাপন করে।

সতেরো শতকে মুগলরা ঢাকায় এলে শাঁখারীদের এখানে আনা হয় এবং তারা ব্যবসায়ের উপযুক্ত একটি এলাকা নির্ধারণপূর্বক বসতি স্থাপন করে, যার বর্তমান নাম শাঁখারী বাজার।

শঙ্খশিল্পের প্রধান উপকরণ সমুদ্রের বিশেষ কয়েক প্রজাতির শঙ্খ, যা শ্রীলঙ্কার জাফনা ও ভারতের মাদ্রাজের তিতপুরে পাওয়া যায়। শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য যেসব প্রজাতির শঙ্খ ব্যবহূত হয় সেগুলি: তিতপুটি, রামেশ্বরি, ঝাঁজি, দোয়ানি, মতি-ছালামত, পাটি, গারবেশি, কাচ্চাম্বর, ধলা, জাডকি, কেলাকর, জামাইপাটি, এলপাকারপাটি, নায়াখাদ, খগা, সুর্কিচোনা, তিতকৌড়ি, জাহাজি, গড়বাকি, সুরতি, দুয়ানাপটি ও আলাবিলা। এগুলির মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সর্বোৎকৃষ্ট, তারপরেই জাডকি ও পাটি শঙ্খের স্থান; আলাবিলা সর্বনিকৃষ্ট। ১৯১০ সালে ১৫০টি তিতকৌড়ি শঙ্খের মূল্য ছিল ৪০-৪৫ টাকা, ১৯৯৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৪০০০-৩০০০০ টাকা।

বিভিন্ন মাপের শঙ্খবলয় তৈরিতে ২.৫-৪ ইঞ্চি ব্যাসের শঙ্খ ব্যবহূত হয়। শঙ্খের অলঙ্কারাদি নির্মাণে অন্য যেসকল উপকরণ প্রয়োজন সেগুলি-করাত, তেপায়া টুল, হাতুড়ি, নরুন ইত্যাদি। বর্তমানে শঙ্খ কেটে বলয় বের করার জন্য প্রাচীন আমলের করাতের পরিবর্তে বিদ্যুৎচালিত এক ধরনের গোলাকার করাত ব্যবহূত হয়।

ভালো আকৃতির একটি শঙ্খ থেকে মাঝারি ধরণের সর্বোচ্চ ৪টি, আর সরু ধরণের ১০টির মতো শাঁখা পাওয়া যায়। শাঁখা কেটে বের করার পর সেগুলির ভেতর ও বাইরের দিক মসৃণ করে তাতে বিভিন্ন নকশা তোলা হয়। সেসব নকশার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, ধানের শীষ, মাছ, পাখি ইত্যাদি মোটিফ। সর্বমোট বারোটি ধাপে শাঁখা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়।

শঙ্খ দিয়ে নানা জিনিস তৈরি হয়। হাতের  শাঁখা হলো শঙ্খশিল্পের প্রধান দিক; এ ছাড়াও কানের টপ, খোঁপার কাঁটা, চুলের ক্লিপ, শঙ্খের মালা, ঘড়ির চেন, আংটি, বোতাম, ব্রুশ, ব্যাংগেল, ব্রেসলেট প্রভৃতি অলঙ্কারও তৈরি হয়। ইদানীং শঙ্খের সাহায্যে কিছু নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীও তৈরি হচ্ছে, যার মধ্যে আতরদানি, ফুলদানি, এসট্রে, সেপটিপিন, পেপারওয়েট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ।

বিশেষ এক প্রকার শঙ্খ হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও জলের দ্রবণের সাহায্যে উজ্জ্বল করে তার গায়ে বিভিন্ন নকশা অাঁকা হয়, যাকে বলে জলশঙ্খ। হিন্দুদের পূজানুষ্ঠানে জলশঙ্খে পবিত্র গঙ্গাজল রাখা হয়। আর এক ধরণের শঙ্খ ব্যবহূত হয়  বাদ্যযন্ত্র হিসেবে। এই শঙ্খে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ফুঁ দিয়ে মাঙ্গলিক ধ্বনি করা হয়; পূজা-বিবাহাদি অনুষ্ঠানে এরূপ শঙ্খধ্বনি অত্যাবশ্যক।

যুগভেদে হাতের শাঁখার বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়, যথা: প্রাচীন যুগ গাড়া (২-৪০ গাছা পর্যন্ত); মধ্যযুগ সাতকাণা, পাঁচদানা, তিনদানা, বাচ্চাদার, সাদাবালা, আউলাকেশী ইত্যাদি; বর্তমান যুগ সোনা বাঁধানো, টালি, চিত্তরঞ্জন, পানবোট, সতীলক্ষ্মী, জালফাঁস, হাঁইসাদার, দানাদার, সাদাশাঁখা, শঙ্খবালা, ইংলিশপ্যাঁচ, ভেড়াশঙ্খ, শিকলি বালা, নেকলেস বালা, লতাবালা, ধানছড়ি, চৌমুক্ষি, হাসিখুশি, তারপেঁচ, জয়শঙ্খ, পাথুরহাটা, মোটালতা, মুড়িদার, আঙ্গুরপাতা, বেণী, বাঁশগির, গোলাপবালা, নাগরী বয়লা ইত্যাদি। নিকট অতীতেও বিবাহিত হিন্দু নারীরা এগুলি ব্যবহার করতেন; এমনকি অনেক মুসলিম নারীও শখের বশে বিভিন্ন ধরণের শঙ্খ পরিধান করতেন। বর্তমানে এসবের ব্যবহার কমে গেছে।

বহু বছর পূর্ব থেকেই ঢাকার শঙ্খবলয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হতো। সতেরো শতকে নেপাল, ভুটান, চীন, বার্মা প্রভৃতি দেশে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ টাকার শাঁখা রপ্তানি হতো বলে জানা যায়। বর্তমানে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী দেশের মধ্যেই বিক্রি হয়। ঢাকার শাঁখারী বাজার শঙ্খ কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্র। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, ঝালকাঠী ও গৌরনদীতেও শঙ্খব্যবসা প্রচলিত। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঢাকা থেকে শাঁখা কিনে নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি করে। এছাড়া বিভিন্ন পূজা-পার্বণ ও মেলা উপলক্ষেও শাঁখার অলঙ্কার বিক্রি হয়।

সামাজিক অবস্থা ও মানুষের রুচিবোধের পরিবর্তনের ফলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির অবদানে এখন নানা ধরণের চুড়ি ও বালা তৈরি হচ্ছে, যা অতি অল্প মূল্যে ক্রেতারা কিনতে পারে। এই চুড়ি বা বালা শাঁখার তুলনায় টেকসই ও মনোহর। প্রায় শতবর্ষ পূর্বে হরনেল লিখেছিলেন, বিলেতি বেলোয়ারি চুড়ি ও বিদেশী প্যাটার্নের গহনার প্রতি অনুরাগ বেড়ে যাওয়ার কারণে বাঙালি ঘরের মেয়েরা ক্রমশই শাঁখার প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে।

কেবল ক্রেতার রুচিবোধের পরিবর্তনই নয়, শাঁখারি সম্প্রদায়ের তরুণ সদস্যদের রুচি ও চিন্তায়ও আধুনিকতার স্পর্শ লেগেছে। পূর্বপুরুষের পেশা ত্যাগ করে অনেকেই এখন ভিন্ন পেশার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে শিল্পীর সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। শঙ্খের অপ্রতুলতাও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।  [শিপ্রা সরকার]

গ্রন্থপঞ্জি  দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ (২য় খন্ড), কলকাতা, ১৯৩৫; তোফায়েল আহমদ, আমাদের প্রাচীন শিল্প, ঢাকা, ১৯৬৪; James Hornell, ‘The Chank-Bangle Industry: Its Antiquity and Present Condition’ in Memoirs of Asiatic Society Journal (Vol. 3), Calcutta, 1912; James Taylor, Sketch of the Topography and Statistics of Dacca, Calcutta, 1940.