শক্তি, এনার্জি

শক্তি, এনার্জি  কাজ করার ক্ষমতা। শক্তিকে সুপ্ত শক্তি (পটেনশিয়াল এনার্জি) অর্থাৎ অবস্থান থেকে উদ্ভূত শক্তি (যেমন টানা স্প্রিং-এর ইলাস্টিক এনার্জি), রাসায়নিক শক্তি (বাতাসের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে কয়লা বা পেট্রোল পোড়ানোর ফলে  উৎপন্ন শক্তি), বৈদ্যুতিক বা পারমাণবিক শক্তি, গতিশক্তি (চলমান বস্ত্ত দ্বারা উৎপন্ন শক্তি) ইত্যাদি রূপে ভাগ করা হয়। আর্থনীতিক ক্যাটাগরি হিসেবে এনার্জি হচ্ছে রূপান্তরযোগ্য শক্তির সংগ্রহ। এ পরিপ্রেক্ষিতে এনার্জিকে নবায়ন-অযোগ্য (জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন: কয়লা, তেল, গ্যাস ও পরমাণুর ফিউশন জ্বালানি) এবং নবায়নযোগ্য (যেমন বায়ু, স্রোত, ভূত্বকের তাপ) শক্তি হিসেবে বিভক্ত করা হয়।

২০০১ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু এনার্জি ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২০০ কেজি তেলের সমপরিমাণ। শক্তি ব্যবহার ক্রমতালিকায় এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শেষদিক থেকে কম্বোডিয়া ও নেপালের পরই তৃতীয়। অপরদিকে মাথাপিছু ব্যবহূত শক্তির সিংহভাগ (৬৫.৫%) অবাণিজ্যিক জ্বালানি। এই অবাণিজ্যিক জ্বালানির মূল উপাদান বায়োমাস যা গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থালি কাজে ও কারখানায় বিভিন্নভাবে ব্যবহূত হয়। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই রান্নার কাজে খোলা চুলা (স্টোভ) ব্যবহূত হয় এবং সেগুলিতে শুকনা পাতা, জ্বালানি কাঠ, কৃষিবর্জ্য, ধানের তুষ এবং ঘুঁটে পোড়ানো হয়। অনেক বিত্তবান গ্রামবাসী আজকাল কেরোসিনের চুলা এবং যেখানে বিদ্যুৎ শক্তির সরবরাহ আছে সেখানে রান্নার কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। কিছু কিছু বাড়িতে আমদানিকৃত কয়লা এবং সামান্য কিছু বাড়িতে স্থানীয়ভাবে তৈরি বায়োগ্যাস প­ান্টের গ্যাস রান্নার কাজে ব্যবহূত হয়। প্রায় ৪% গ্রামবাসী সন্ধ্যার পর আলোর সরবরাহ পেতে কেরোসিন বাতি এবং বহুসংখ্যক কৃষক সেচের জন্য পাম্প চালাতে ডিজেলকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। দেশের পূর্বাঞ্চলের স্বল্পসংখ্যক নগর ও শহরে পাইপ লাইনের সাহায্যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষকে জ্বালানি কাঠ দিয়েই গৃহস্থালি প্রয়োজন মেটাতে হয়। বছরে কেবল রান্নার প্রয়োজনেই দেশে ৪০ মিলিয়ন টন কাঠ ব্যবহূত হয়। এর ফলে দেশের বনাঞ্চল দ্রুত উজাড় হচ্ছে যা প্রতিবেশ ভারসাম্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার বাংলাদেশে নতুন ঘটনা নয়। মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন কাজে বায়ু ও  সৌরশক্তি ব্যবহার করে আসছে। কাপড়, কৃষিপণ্য, মাছ, লবণ ইত্যাদি শুকানোর কাজে সৌরশক্তি ব্যবহূত হয়। পালতোলা নৌকার জন্য বায়ুশক্তির প্রয়োগ ঘটে। কিন্তু পানির পাম্প বা বায়ুশক্তি চালিত টারবাইন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো বায়ুশক্তির আধুনিক ব্যবহার এখনও বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় নি। বিভিন্ন সংস্থা দেশের উপকূল অঞ্চলে বিভিন্ন সম্ভাবনাময় স্থান নির্বাচন ও বায়ুশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা পানি পাম্প করার সম্ভাবনা যাচাই করেছে।

বাংলাদেশে গ্রীষ্ম ও শীতকালে প্রতি বর্গমিটার এলাকায় গড়ে সৌরশক্তির বিকিরণের পরিমাণ ৫.০৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা। কিছু কিছু সংগঠন মূল্যবান পণ্য, যেমন মসলা ও সবজি সূর্যের আলোতে শুষ্ককরণের সীমিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরীক্ষাগুলি আর্থিকভাবে লাভজনক প্রমাণিত হয় নি। কিন্তু দুর্গম গ্রাম এলাকাগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ফটোভোল্টাইক সিস্টেম ক্রমশই গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছে।  পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড  (নরসিংদী পাইলট প্রজেক্ট) ও গ্রামীণ শক্তি ফটোভোল্টাইক সিস্টেম-এর সাহায্যে সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানো এবং টিভি ও রেডিও চালানোর শক্তি যোগান দেবার মতো প্রাথমিক চাহিদা পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে। তদুপরি কাপ্তাইয়ে বৃষ্টির পরিমাণ নিরূপণ কেন্দ্র ও আরিচার পূর্ব-পশ্চিম বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের সংযোগস্থানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-এর (বিপিডিবি) দুটি প্রধান ফটোভোল্টাইক সিস্টেম দিয়ে সৌরশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরের স্থাপনা রয়েছে। কিছু  কিছু বৈদ্যুতিক সঞ্চালন টাওয়ারে, যেমন চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর সংযোগস্থলে সৌরশক্তি রূপান্তরের ফটোভোল্টাইক সিস্টেমের মাধ্যমে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিপিডিবি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলায় সৌরশক্তি ব্যবহারের আর্থিক সম্ভাব্যতা জরিপ সম্পন্ন করেছে। ইতোমধ্যে ওই তিন জেলার ২৫টি উপজেলার মধ্যে ২১টিতে বৈদ্যুতিক গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। অন্য অঞ্চলগুলিতে ডিজেল জেনারেটর দিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুতের আংশিক সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশে কর্মরত বেসরকারি এলপিজি মার্কেটিং কোম্পানিগুলির হিসাবমতে ২০০১ সালে দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদার পরিমাণ আড়াই থেকে তিন লক্ষ টন। সরকারি মালিকানাধীন চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড বছরে প্রায় ১৬,০০০ টন এবং সিলেটের কৈলাসটিলায় অবস্থিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-এর (বিপিসি) এলপিজি সংরক্ষণ, বোতলজাতকরণ ও বিতরণ প­ান্ট বছরে আরও ৫,০০০ টন এলপি গ্যাস উৎপাদন করে। ইস্টার্ন রিফাইনারি ও কৈলাসটিলা প­ান্টে উৎপাদিত এলপিজি বিপিসির বিপণন কোম্পানিগুলির মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে এলপিজি আমদানি, সংরক্ষণ, বোতলজাতকরণ ও বিপণনের অনুমতি দেওয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ১১টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি থেকে এলপিজি আমদানি, সংরক্ষণ, বোতলজাতকরণ ও বিপণনের লাইসেন্স পেয়েছে। এরূপ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন এলপি গ্যাস লিমিটেড, ‘বসুন্ধরা এলপি গ্যাস’ নামে বছরে ৩৬,০০০ টন এলপি গ্যাস দেশে আমদানি, সংরক্ষণ, বোতলজাতকরণ ও বিপণনের অবকাঠামো গড়ে তুলেছে এবং বছরে প্রায় ৮,০০০ টন এলপি গ্যাস বিপণন করছে। অনুমতিপ্রাপ্ত আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল মার্কেটিং, যমুনা স্পেসটেক জয়েন্ট ভেনচার লিমিটেড, মবিল-যমুনা ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়েসফার্মারস-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গঠিত এলপিজি মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ লিমিটেড উলে­খযোগ্য। সামিট বছরে ৬০,০০০ টন, যমুনা স্পেসটেক ২৫,০০০ টন ও এলপিজি মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ লিমিটেড আড়াই লক্ষ টন এলপিজি আমদানি ও বিপণনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

বাংলাদেশের জনসাধারণের ২০% শতাংশেরও কমসংখ্যক মানুষের বাণিজ্যিক জ্বালানি ও প্রায় ৮% শতাংশের হাইড্রোকার্বন (তরল জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপিজি) ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। বছরে মাথাপিছু বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহের পরিমাণ আনুমানিক ১১০ কিলোওয়াট ঘণ্টা। দেশের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা অত্যন্ত সীমিত। এখন পর্যন্ত একমাত্র কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাকে বাড়িয়ে সেখানে আরও দুটি ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিট স্থাপনের বিষয়টি বিবেচনাধীন রয়েছে। এছাড়াও ক্ষুদ্রাকার কিছু জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সম্ভাব্যতা বিষয়ে জরিপ চালানো হয়েছে।

বাংলাদেশে তেলের (কনডেনসেট-সহ) প্রমাণিত মজুত আনুমানিক ৬৫ মিলিয়ন ব্যারেল। দেশের বাণিজ্যিক জ্বালানির প্রাথমিক উৎসে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত প্রায় ২৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) যার মধ্যে প্রকৃত আহরণোপযোগী মজুত আনুমানিক ১২.১৯ টিসিএফ। ১৯৫৫ সালে প্রথম গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের পর থেকে ২০০০ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের মোট উৎপাদন ছিল ৪.১০ টিসিএফ। সম্প্রতি সরকার প্রণীত গ্যাস খাতের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ বিবরণীতে উলে­খ করা হয়েছে যে, ২০১০ সাল নাগাদ কমপক্ষে ৫ টিসিএফ ও ২০২০ সালের মধ্যে আরও অন্তত ৭ টিসিএফ গ্যাস অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন হবে। গত বছরে ৩৩০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং গত দশ বছরে ২.৪ টিসিএফ গ্যাস ব্যবহূত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বছরে গড়ে ৮-১০% শতাংশ হারে গ্যাস ব্যবহার বেড়েছে। দেশে মোট ব্যবহূত গ্যাস সম্পদের আনুমানিক প্রায় ১১% গৃহস্থালি খাতে ব্যবহূত হয়। সাম্প্রতিককালে যমুনা নদীর উপর নির্মিত সেতুর মাধ্যমে গ্যাসপাইপ লাইন দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রসারিত হওয়ায় সামগ্রিকভাবে গৃহস্থালি ও অন্যান্য খাতে গ্যাসের ব্যবহার দ্রুত হারে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। রক্ষণশীল অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে যে, দেশে আগামী ৫০ বছরে গ্যাস চাহিদা দাঁড়াবে কমপক্ষে ৬৫.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজন হবে অন্তত ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট ও সার উৎপাদনে ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এ প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিপুল বিনিয়োগ অবধারিত হয়ে পড়েছে।

দেশের পিট ও কয়লার সঞ্চয় রয়েছে মূলত মাটির গভীরে এবং অবস্থানগত দিক থেকে দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে। সে কারণে পিট ও কয়লা সম্পদ উন্নয়নও জটিল। এখন অবধি বছরে এক মিলিয়ন টনের সীমিত বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাসহ পেট্রোবাংলা দেশের একমাত্র বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি নির্মাণ করছে যার উৎপাদন দিয়ে প্রধানত একই স্থানে ২৫০ মেগাওয়াট শক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

দেশে বর্তমানে ৬০০ মেগাওয়াট বেসরকারি (আইপিপি) বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসহ মোট স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩,৮০৩ মেগাওয়াট। মূলত তহবিল সংকটের কারণে এবং বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় ব্যতিরেকে অন্যান্য সময়ে বিপিডিবি বিদ্যুৎ ব্যবহার চাহিদার সীমাবদ্ধতার জন্য কোন কোন আইপিপি-র অধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্র (প্রধানত বার্জমাউন্টেড) তার উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে নিচে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাধ্য হচ্ছে।

সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে যে দেশের মোট জ্বালানি চাহিদার দশ ভাগের প্রায় সাত ভাগ প্রচলিত জ্বালানি উৎস, যেমন বায়োমাস, কাঠ, ছোবড়া ইত্যাদি জ্বালিয়ে পূরণ করা হয়। অবশিষ্টের প্রায় ৭০% শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস এবং বাকি অংশ তেল পুড়িয়ে যোগান দেওয়া হয়। দেশে এখন প্রতিদিন প্রায় ১,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহূত হয় যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সার উৎপাদনে এবং প্রায় অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত হয়। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল প্রধানত যানবাহনের জ্বালানি (পেট্রোল ও ডিজেল) এবং সামান্য অংশ (কেরোসিন) রান্না ও আলো জ্বালাতে ব্যবহূত হয়। এছাড়াও পেট্রোলিয়াম শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং এভিয়েশন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত হয়। বিদ্যুতের ব্যবহারকারী খাত বিবেচনায় ৪৩% গৃহস্থালি, ৪২% শিল্প, ১১% বাণিজ্যিক এবং প্রায় ৪% কৃষি কাজে (মূলত সেচ কাজে) ব্যবহূত হয়। বাণিজ্যিক জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেলের আনুপাতিক বণ্টন হচ্ছে ৭০:৩০।

সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কাঠামো ছাড়াও শিল্প কারখানাগুলির ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার (ক্যাপটিভ জেনারেশন) অধীনে প্রায় ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ২০০০ সনে প্রায় ৮৫% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। কিন্তু এখনও দেশে প্রকৃত মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন (প্রতিদিনের গড়) ২,৬৫০-২,৮০০ মেগাওয়াট-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

বাংলাদেশে এখনও বাণিজ্যিক জ্বালানির বিপুল পরিমাণ সরবরাহ ঘাটতি বিদ্যমান। সহজলভ্য সরবরাহের সিংহভাগই মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এখনও সীমিত পরিমাণ জ্বালানি গ্যাস সরবরাহকেন্দ্রিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তা অন্যতম প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশ বছরে প্রায় ৬৪২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ জ্বালানি তেল (পেট্রোলিয়াম) আমদানির জন্য ব্যয় করে। দেশের পল্লী বিদ্যুৎ কর্মসূচির অধীনে প্রতিবছর প্রায় দুই লক্ষ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ হারে সংযোগ দিতে থাকলে বিদ্যমান পল্লী বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংখ্যা দ্বিগুণ করতেই ২০১০ সন পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। উল্লেখ্য, দেশের ৮০% মানুষই এখনও বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ ছাড়াই বসবাস করছে।

বিশ শতকের নববইয়ের দশকে বিশ্বের অর্থনীতির গতি ও প্রবণতার আলোকে বাংলাদেশেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৯৭-৯৯ সময়কালে বেসরকারি খাতে ৩৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার বার্জমার্ডন্টেড বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ জাতীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের মূল্য বিশ্বব্যাপী গড় ৬.৫ মার্কিন সেন্ট/কিলোওয়াট ঘণ্টার বিপরীতে বাংলাদেশে বেসরকারি বার্জমাউন্টেড বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারিত হয়েছে প্রায় ৫.১ মার্কিন সেন্ট/কিলোওয়াট ঘণ্টা। সম্প্রতি বেসরকারি খাতে আরও ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে যার ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের মূল্য হবে প্রায় ২.৭৫ মার্কিন সেন্ট/কিলোওয়াট ঘণ্টা।

বাংলাদেশের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প­্যান আগামী ২০ বছরের বিদ্যুৎ চাহিদা হিসাব করেছে। পরিকল্পিত আনুমানিক চাহিদা ২০০৫ সালে ৪,৬০০ মেগাওয়াট, ২০১০ সালে ৬,৮০০ মেগাওয়াট এবং ২০১৫ সাল নাগাদ ১০,০০০ মেগাওয়াট। সরকারের পাওয়ার পলিসি স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ৩,০০০ মেগাওয়াট যা ২০২০ সাল নাগাদ পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৫,০০০ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। ওই পলিসি স্টেটমেন্ট অনুযায়ী সরকার বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২,২৩৮ মেগাওয়াটে সীমিত রাখা সঙ্গত বলে মনে করে। বেসরকারি খাতে ১,১৮৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ইতোমধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং আরও ১,০৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। ২০০৭ সাল নাগাদ সরকারি খাতে ৩,০১৯ মেগাওয়াট এবং মিশ্র খাতে কোম্পানি ২০০৪ সালের মধ্যে (রুরাল পাওয়ার কোম্পানি) অতিরিক্ত ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়াও ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে, যেমন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (১৫ মেগাওয়াট), সন্দ্বীপ পাওয়ার নেটওয়ার্ক লিমিটেড (১০ মেগাওয়াট), নারায়ণগঞ্জ রোলস রয়েস (১০ মেগাওয়াট) এবং রহিম স্টিল লিমিটেড (১০ মেগাওয়াট) অন্তত ৬৫ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ নিকট ভবিষ্যতে উৎপাদনের জন্য কেন্দ্র নির্মাণ করছে।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ সিস্টেমের বিদ্যমান সমস্যা, যেমন: উৎপাদন ঘাটতি, লোড শেডিং, লো ভোল্টেজ ইত্যাদি মূলত সরবরাহ নেটওয়ার্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। অন্যান্য সমস্যার মধ্যে আছে মেরামতহীন ট্রান্সফরমার, সঞ্চালন লাইন ও বিতরণ ব্যবস্থায় ব্যবস্থাপনা ত্রুটি ইত্যাদি। ২০০১ সালের জুন মাসে দেশের ২৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট ৫৮টি উৎপাদন প­ান্টের ৭টি অচল অবস্থায় ছিল। অপরদিকে বিপিডিবি-র বিভিন্ন দূরবর্তী ও দ্বীপাঞ্চলে স্থাপিত অত্যন্ত ব্যয়বহুল ৮টি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাদের প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে এবং অত্যধিক উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওভারহলিং করা আশু প্রয়োজন মনে করলেও সুশৃঙ্খলভাবে তা করতে পারছে না, কেননা এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার কোন রিজার্ভ মার্জিন নেই।

বিপিডিবি-র উৎপাদিত বিদ্যুতের ৩০% প্রতিষ্ঠানটি নিজেই বিতরণ করে, ৫০% বিতরণ করে  ডেসা ও অবশিষ্ট ২০% পল­ী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। বিতরণ পর্যায়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যয় প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টার জন্য দুই টাকার চেয়ে সামান্য বেশি হলেও বিপিডিবি ডেসাকে ১.৯১ টাকা/কিলোওয়াট ঘণ্টা ও পল­ী বিদ্যুৎ বোর্ডকে ১.৮৪ টাকা/কিলোওয়াট ঘণ্টা হারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বিপিডিবি ডেসার কাছ থেকে প্রতিমাসে ২৫ কোটি টাকার কাছাকাছি রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। অপরদিকে বিপিডিবি-র গ্রাহকদের কাছে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা তিন টাকার বেশি হারে বিদ্যুৎ সরবরাহের সরকারি মূল্য নির্ধারিত হলেও ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের জন্য বিপিডিবি ১.৭৫ টাকা হারে আদায় করেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে বিপিডিবি বর্তমানে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। কোন কোন হিসাবে বলা হচ্ছে যে, বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘন ঘন বিঘ্নতার কারণে কেবল শিল্প উৎপাদনের ক্ষতিই দাঁড়াচ্ছে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকার ইতোমধ্যে সিস্টেম লস কমানোর জন্য কিছু সংস্থা গড়ে তুলেছে এবং বেসরকারি খাতে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য অনুমতি দিয়েছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি গঠনের পথে কিছু অগ্রগতি হলেও সামগ্রিকভাবে এক্ষেত্রে অবলম্বিত সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলি সাধারণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০০০ থেকে ২০১০ সময়কালে বিদ্যুৎ খাতে অন্তত ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ দরকার হবে। সরকারি খাত এর সামান্যই যোগান দিতে সমর্থ। সেকারণে সরকার বেসরকারি খাতকে এ খাতে বিনিয়োগের আহবান জানানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বৈদেশিক সহায়তা প্রার্থনাও অব্যাহত রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সংস্কারের আইনগত প্রক্রিয়াকে যথাযথকরণ ও স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইলেকট্রিসিটি অ্যাক্ট ১৯১০-এর স্থলে ইলেক্ট্রিসিটি রিফর্ম অ্যাক্ট তৈরি করা হয়েছে যা জাতীয় সংসদের অনুমোদনের অপেক্ষাধীন।  [মুশফিকুর রহমান]