শংকরাচার্য

শংকরাচার্য  ভারতের ইতিহাসবিদ ও দার্শনিকদের প্রায় সবাই মনে করেন আচার্য শংকর বা শংকরাচার্য ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক। তাঁর জন্মকাল নিয়ে কিছুটা মত পার্থক্য আছে। যেমন ভেঙ্কটেশ্বর মনে করেন, শংকরের জন্ম ও মৃত্যু যথাক্রমে ৮০৫ এবং ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ৯২ বছর বেঁচে ছিলেন। তবে যাঁরা মনে করেন যে, শংকরের জন্ম ও মৃত্যু যথাক্রমে ৭৮৮ ও ৮২০ খ্রিস্টাব্দে তাদের সমর্থক শুধু অধিকাংশই নয়, বলা যেতে পারে, প্রায় সবাই। এঁদের মধ্যে আশুতোষ ভট্টাচার্য, আর জি ভান্ডারকার, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। শংকরাচার্য ভারতের কেরালা প্রদেশের ব্রাহ্মণ পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শিবগুরু এবং মাতার নাম বিশিষ্টা। অতি অল্প বয়সেই ধর্ম সম্পর্কিত বিভিন্ন বিদ্যায় তিনি পারদর্শী হন। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি আচার্য গোবিন্দপাদের নিকট সন্যাস গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ১২ বছর পর্যন্ত বেদ-উপনিষদ ও ভারতীয় দর্শনশাস্ত্র  অধ্যয়ন করেন।

শংকরাচার্যের মতে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং এ জগৎ মিথ্যা ও মায়াময়। শংকরের দর্শন অনেক নামে পরিচিত। এ নামগুলো: বিশুদ্ধ অদ্বৈতবাদ, কেবল অদ্বৈতবাদ, বিবর্তনবাদ, মায়াবাদ, অনির্বাচ্যবাদ এবং নির্বিশেষবাদ। তাঁর বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সাংখ্য বিবর্তনবাদ, বৌদ্ধ ক্ষণিকত্ববাদ, জৈন স্যাৎবাদ, বৈশেষিক পরমাণুবাদ ইত্যাদি মতবাদ খন্ডন করেন। অদ্বৈত বেদান্তের সিদ্ধান্তকে পূর্ণরূপ দেওয়ার জন্য তিনি ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্যের ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুন্ডক, মান্ডূক্য, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক এই দশটি উপনিষদের ভাষ্য এবং গীতা-ভাষ্য, বিষ্ণু সহস্রনাম-ভাষ্য প্রভৃতি ভাষ্যগ্রন্থ রচনা করেন। ভাষ্যগ্রন্থ ছাড়াও তিনি আত্মবোধ, বিবেকচূড়ামনি, উপদেশসাহস্রী প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। শংকরাচার্য মাত্র ৩২ বছর বেঁচে ছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কীভাবে এতগুলো ভাষ্য এবং গ্রন্থ রচনা করেন এ কথা ভেবে অনেকে বিস্মিত হন। সে কারণে কেউ কেউ (যেমন ভেঙ্কটেশ্বর) মনে করেন যে তিনি ৯২ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ভেঙ্কটেশ্বরের বক্তব্য কোনো মহলেরই সমর্থন পায়নি।

শংকর মনে করেন, ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা  জীবো ব্রহ্মৈব নাপর: অর্থাৎ একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর মতে একমাত্র ব্রহ্মেরই সত্তা আছে। ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কোনো কিছুর সত্তা নেই। ব্রহ্ম নিত্য-শুদ্ধ, নিত্য-বুদ্ধ এবং নিত্য-মুক্ত। ব্রহ্ম দেশ কালাদি ভেদশূন্য। সেখানে তিন ধরণের ভিন্নতা লক্ষণীয়: সমজাতীয় ভিন্নতা, অসমসত্ত্ব ভিন্নতা ও অভ্যন্তরীণ ভিন্নতা। কিন্তু ব্রহ্মের অনুসারিরা এরূপ পার্থক্যের উর্ধ্বে। তাঁর মতে ব্রহ্মই শুদ্ধ অভিন্নতার একমাত্র উদাহরণ। ব্রহ্ম নির্গুণ। অজ্ঞানতার কারণে নির্গুণ ব্রহ্মকে সগুণ মনে হয়।

শংকরের মতে ব্রহ্মই সত্য তাঁর এই মত প্রমাণ করতে তিনি সত্যের সন্দেহাতীত মানদন্ডের কথা বলেছেন। যেমন; ১. সত্য সব রকম পরিবর্তনের উর্ধ্বে ২. সত্য অবশ্যই প্রত্যক্ষণযোগ্য ৩. সত্য অবশ্যই যেকোনো অসঙ্গতির উর্ধ্বে। তিনি মনে করেন, ব্রহ্মের চেয়ে কোনো কিছুই পরিবর্তনের উর্ধেব নয়, কোনো কিছুই নিজ অস্তিত্বের উর্ধ্বে নয় এবং কোনো কিছুই কোনো অসঙ্গতির উর্ধ্বে নয়। একারণে ব্রহ্মই একমাত্র সত্য। আবার জগতের অসত্যতা প্রমাণ করতে শংকর অনেকগুলো যুক্তি উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে দুটি যুক্তি প্রধান। (১) যা কিছু পরিবর্তনশীল তা সত্য নয়। জগতের সব কিছু পরিবর্তনশীল। তাই জগতের কোনো কিছু সত্য নয়। (২) যা কিছু প্রত্যক্ষণযোগ্য, তাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জগৎ প্রত্যক্ষণযোগ্য। তাই জগতের সব কিছু ধ্বংসযোগ্য। আবার যা কিছু ধ্বংসযোগ্য, তা সত্য নয়। জগতের সব কিছু ধ্বংসযোগ্য। কাজেই জগতের কোনো কিছুই সত্য নয়।

অনেকে শংকরের বক্তব্যকে সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, শংকর জগতের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছেন। এ বক্তব্য সঠিক নয়। শংকর বলেছেন জগৎ মিথ্যা। কিন্তু জগৎ অস্তিত্বহীন অর্থাৎ জগতের কোনো অস্তিত্বই নেই এ কথা তিনি কোথাও বলেননি। অন্যদিকে তিনি বলেন, বন্ধ্যা নারীর সন্তান প্রসব অবাস্তব বা অস্তিত্বহীন। বন্ধ্যা নারী সন্তান প্রসব করেছে- এমন কথা কেউ দাবী করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এটা  যৌক্তিকভাবে পরস্পরবিরোধী। তাঁর এই যুক্তি প্রমাণ করতে তিনি সত্যের পক্ষে মত দিয়েছেন। সত্যকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করেছেন: ব্যবহারিক সত্য এবং পারমার্থিক সত্য। পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য। শুধুমাত্র ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ সত্য।

জাদুকরের ইন্দ্রজালের উদাহরণ দিয়ে শংকর ব্রহ্মের স্বরূপ বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। যারা অজ্ঞ কেবল তারাই যাদুকরের ইন্দ্রজাল প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয় এবং জাদুসৃষ্টিকে সত্য বলে মনে করে। জাদুকরের ফাঁকি তাদের চোখে পড়েনা। অন্যদিকে যারা বুদ্ধিমান তারা কিন্তু জাদুকরের ফাঁকি বুঝতে পারে এবং জাদুকরের জাদুসৃষ্টিকে মিথ্যা বলে উপলব্ধি করতে পারে। অজ্ঞ ব্যক্তিরাই জগৎ ও ঈশ্বর উভয়কে সত্য বলে মনে করে। কিন্তু যারা বিজ্ঞ তারা বুঝতে পারেন, জগৎ অবভাস মাত্র এবং প্রকৃতই কোনো জগৎ-স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই।

শংকরের দর্শনকে অনেকে মায়াবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। কারণ তাঁর মতে জগৎ মায়ার সৃষ্টি। এই মায়ার স্বরূপ সম্পর্কে শংকর বলেন, মায়া এক অনির্বচনীয় শক্তি। মায়া অনির্বচনীয় কারণ মায়া সৎ নয়, আবার অসৎও নয়। মায়া সৎ নয় কারণ তত্ত্বজ্ঞানীর কাছে ব্রহ্মই সত্য, জগৎ নয়। মায়া অসৎও নয়। কারণ মায়ার দ্বারা সৃষ্ট এ জগৎ সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যক্ষের বিষয়। তাই শংকর দাবী করেন, যা সৎও নয় আবার অসৎও নয় তাকে অনির্বচনীয় ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। তিনি বলেন, ঈশ্বর ও মায়া একান্তই অভিন্ন। আগুনের দাহিকা শক্তিকে যেমন আগুন থেকে পৃথক করা যায় না তেমনি ঈশ্বরের মায়া শক্তিকেও কোনোভাবে ঈশ্বর থেকে পৃথক করা যায় না।

ভারতীয় দর্শনের নয়টি সম্প্রদায়ের মধ্যে চার্বাক ছাড়া বাকী আটটি সম্প্রদায় (সাংখ্য, যোগ, বৈশেষিক, ন্যায়, বেদান্ত, মীমাংসা, বৌদ্ধ ও জৈন) মনে করে এ জগৎ দুঃখময়। তাদের মতে, অজ্ঞানতাই এই দুঃখের কারণ। বৌদ্ধ ছাড়া অন্য সাতটি সম্প্রদায় মনে করে, আত্মা বন্দি অবস্থায় আছে বলেই আমরা দুঃখের মাঝে নিপতিত। এই বদ্ধদশা হতে মুক্তি লাভের উপায় কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শংকর  বলেন, আত্মজ্ঞানের উদয় হলে অজ্ঞানতা দূর হয়। এর ফলে জীব আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। জীব যে স্বরূপত: ব্রহ্ম এ উপলব্ধি জন্মায়। ফলস্বরূপ জীব যখন বুঝতে পারে যে, জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন তখনই জীবের মোক্ষ লাভ ঘটে। অর্থাৎ আত্মজ্ঞানই মুক্তির পথ নির্দেশক। শংকরের মতে আত্মজ্ঞান লাভের জন্য চার প্রকার সাধনার প্রয়োজন যথা- (১) নিত্য ও অনিত্য বস্ত্তর ভেদাভেদ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা, (২) ইহলোক ও পরলোকের ফলভোগে অনাশক্তি, (৩) অন্তরিন্দ্রিয় ও বহিরিন্দ্রয় সংযম এবং (৪) মুক্তি লাভের ঐকান্তিক ইচ্ছা। এই চার প্রকার সাধনার ফলে জীব বুঝতে পারে যে,  তাতে এবং ব্রহ্মতে কোনো পার্থক্য নেই। তার উপলব্ধি ঘটে যে, সব কিছুই ব্রহ্মময় বা সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম। তার ধারণা স্পষ্ট হয় তিনি ভাবেন: ‘সোহ্হম’ অর্থাৎ আমিই নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-সত্য স্বভাবরূপ পরমানন্দ অদ্বয় ব্রহ্ম এবং জীব তখন মোক্ষ লাভ করে। [কাজী নূরুল ইসলাম]