লোকযান
লোকযান লোকসম্প্রদায় কর্তৃক স্থল ও জল পথে ব্যবহূত যানবাহন। সুপ্রাচীন কাল থেকে বাংলার স্থলপথের বাহন হিসেবে হাতি, ঘোড়া, গাধা ও মোষ ব্যবহূত হয়ে আসছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে হাতি রণক্ষেত্রের বাহন হিসেবেও ব্যবহূত হতো। কখনো কখনো রাজা-বাদশাহ এবং আমীর-ওমরাহগণও সৌখিন বাহন হিসেবে হাতি ব্যবহার করতেন। বনাঞ্চলের লোকজীবনের জীবিকার অন্যতম অবলম্বনও ছিল হাতি। এছাড়াও নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে বাহনের ভূমিকায় হাতির গুরুত্ব ছিল সর্বকালে।
অতীতে স্থলপথে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাতায়াতের জন্য ঘোড়ার ব্যবহার ছিল সর্বাধিক। ব্যবসায়ীদের মালামাল বহনের ক্ষেত্রেও ঘোড়ার গুরুত্ব কম ছিল না। বহুকাল আগ থেকেই এ দেশে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষত রাজশাহী অঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। দ্রুতগামী বাহন হিসেবে এককালে ঘোড়ার গাড়ির কোনো বিকল্প ছিল না। আগের দিনে অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষের সৌখিন ভ্রমণের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঘোড়ার গাড়ি। অদ্যাবধি পুরানো ঢাকায় সীমিত পর্যায়ে এর ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
আগের দিনে উত্তরভারত থেকে কিছু কিছু উট আসত বাংলাদেশে। সেগুলি জনসাধারণের স্থানান্তরে গমনাগমনের জন্য ব্যবহূত হতো। উটের পাশাপাশি কিছু গাধাও আসত, যেগুলি হাটে-বাজারে মালামাল বহনকাজে, বিশেষত ধোপা ও ধাঙ্গড় পেশার কাজে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে এ দুটি প্রাণীর ব্যবহার আর লক্ষ করা যায় না।
গাড়ি টানার জন্য গরু-মোষের ব্যবহার চলে আসছে সুদীর্ঘ কাল থেকে। বাংলাদেশের রংপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার অঞ্চলের কৃষক ও রাখালদের বাহন হিসেবেও এক সময় মোষের ব্যবহার ছিল। এখনও স্থানবিশেষে মোষের পিঠে রাখালদের স্থানান্তরে যাতায়াতের দৃশ্য লক্ষ করা যায়। মোষ ও গরুর গাড়ি অদ্যাবধি গ্রামাঞ্চলের মানুষের মালামাল পরিবহণের প্রধান বাহন হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
যাতায়াতের জন্য এক সময় গ্রামাঞ্চলে ডুলি ও পালকির ব্যাপক ব্যবহার ছিল। বাঁশ ও রশি দিয়ে তৈরি ডুলি দুজন বাহক বহন করত। এতে সাধারণত একজন যাত্রী বসতে পারত। পালকির আকৃতি অপেক্ষাকৃত বড়। কাঠ দিয়ে পালকি তৈরি হয় এবং এর দুপাশে দুটি দরজা থাকে। মাঝ বরাবর একটি গোলাকার লম্বা দন্ড থাকে, যা সামনে-পিছনে দুজন বা চারজন লোকে ধরে পালকি বহন করে; এদের বলা হয় বেহারা। অভিজাত পরিবারে এবং গ্রামাঞ্চলে বৈবাহিক অনুষ্ঠানে এক সময় পালকির ব্যাপক প্রচলন ছিল। এ উপলক্ষে ‘পালকির গান’ নামে এক ধরণের গানেরও প্রচলন ছিল। যান্ত্রিক যানবাহন প্রচলনের ফলে এবং গ্রামাঞ্চলে সড়ক পথের উন্নয়ন ঘটায় ডুলি ও পালকির ব্যবহার এখন প্রায় বিলুপ্ত হতে চলেছে।
বাংলাদেশে জলপথে চলাচলের প্রধান বাহন নৌকার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এখনও বর্ষাকালে নিম্নাঞ্চলের মানুষের প্রধান বাহন নৌকা। একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত, মালামাল পরিবহণ এবং সৌখিন ভ্রমণের জন্য নৌকার ব্যবহার হয়। এজন্য বিভিন্ন ধরণের নৌকার প্রচলন আছে।
সাধারণত নৌকাগুলিকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয় বজরা, কোষা ও ডিঙা। বজরা হচ্ছে সৌখিন নৌকা; সাধারণত ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগুলি ব্যবহার করতেন। মধ্যযুগে জলপথে যুদ্ধের জন্য যেসব নৌকা ব্যবহূত হতো সেগুলিকে বলা হতো রণতরী। রণতরীগুলি বিভিন্ন রকমের হতো; লম্বা ও ক্ষীপ্রগামী রণতরীর নাম ছিল কোষা। এছাড়া আর যেসব ছোট ছোট নৌকা সেগুলিকে বলা হয় ডিঙা।
বর্ষাকালে গ্রামের সাধারণ মানুষ বা দরিদ্র জনগণ যাতায়াতের জন্য কলাগাছের তৈরি ভেলাও ব্যবহার করে। মনসামঙ্গল কাব্যে এরূপ ভেলা ব্যবহারের উলেখ আছে। লখিন্দরের মৃতদেহ ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কোনো কোনো অঞ্চলে তালগাছের খোলও জলপথের বাহন হিসেবে ব্যবহূত হয়। প্রাচীন ভারতে রণাঙ্গনে রথের ব্যবহার ছিল, কিন্তু বঙ্গদেশে যানবাহন হিসেবে রথের ব্যবহার ছিল কিনা তা জানা যায় না; তবে জগন্নাথদেবের পূজা উপলক্ষে রথের ব্যবহার আজও দেখা যায়। রথের উপর জগন্নাথদেবের মূর্তি স্থাপন করে রথ টানা হয়, যা রথযাত্রা নামে পরিচিত।
বেশ কিছুকাল আগে থেকেই শহর ও মফস্বল শহরে রিকশা-ভ্যানের ব্যবহার খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজন ও জীবনজীবিকা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এছাড়া শহর ও গ্রামে-গঞ্জে যাতায়াতের জন্য বাই-সাইকেলের ব্যবহারও প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। [মুহম্মদ আব্দুল জলিল]