লুসাই

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:৫৯, ১১ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

লুসাই  নৃ-গোষ্ঠী বার্মা থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয় এবং তারা নিজেদের মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর বংশধর বলে পরিচয় দেয়। কিংবদন্তী অনুসারে চীন দেশের রাজা চিনলুং তাঁর বাবার সাথে মতের অমিল থাকার কারণে তাঁর অনুসারিদের নিয়ে বার্মায় (মিয়ানমার) চলে আসেন এবং সেখানে গ্রাম তৈরি করে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে উক্ত রাজার বংশধররা চিনহিলস, মনিপুর, কাছাড়, মিজোরাম, সাতিকাং (চিটাগাং) অঞ্চলে প্রায় দুশত বছর রাজত্ব করেন। এই রাজার উত্তরসূরী যাম্হুয়াকার রাজত্বকালে তাঁরা বঙ্গ দেশের রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লুসাইদের মোট সংখ্যা ৬৬২ জন। এছাড়াও ভারতের মিজোরামে অনেক লুসাইয়ের বসবাস রয়েছে।

লুসাইদের ঐতিহ্যবাহী চের-লাম নাচ

লুসাইদের প্রধান খাদ্য ভাত ও শাকসবজি। তারা জুমচাষ-এর মাধ্যমে ধান, শাকসবজি ইত্যাদি উৎপাদন করে। লুসাইদের প্রিয় খাবারের মধ্যে ‘সা-উম-বাই’ (শূকরের তেল, শাকসবজি ও কাঁচামরিচ দিয়ে তৈরি তরকারি) অন্যতম। মাছ, মাংস দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখার উদ্দেশ্যে লুসাইরা মাচার উপর আগুনের তাপে ঝুলিয়ে রাখে এবং পরে রান্না করে খায়।

লুসাইরা অতীতে পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরিধান করতো। পরবর্তীকালে তুলা থেকে উৎপন্ন সুতা দিয়ে তৈরি ‘হ্নখাল’ নামে একধরণের চাদর প্রথমে লুসাই পুরুষরা এবং পরে নারীরা ব্যবহার শুরু করে। সময়ের পরিবর্তনে মহিলারা কোমর-তাঁত দিয়ে ‘পুয়ানফেল’ (থামি), ‘করচুং’ (টপস/ব­াউজ) প্রভৃতি এবং পুরুষরা ‘করচুর’ (শার্ট) ও পুয়ানবি (লুঙ্গি) তৈরি করে ব্যবহার করতে শুরু করে। এছাড়া লুসাই নারীরা বিভিন্ন ধরনের থামি যেমন পুয়ান রৌপুই, পুয়ান চেই, পুয়ানদুম, ঙৌতে খের পরিধান করেন। লুসাই নারীরা বিভিন্ন ডিজাইনের অলংকার দিয়ে নিজেদের সাজাতে পছন্দ করেন। তারা দামী পাথরের মালা পরেন।

উনবিংশ শতকের শেষার্ধে দুজন আর্থিংটন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি রেভা এফ.ডব্লিউ সেভিডজ ও রেভা জে.এইচ লরেইন এর প্রচেষ্টায় রোমান অক্ষরের অনুকরণে লুসাই বর্ণমালা তৈরি করেন। যুবকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষাকেন্দ্র নির্মাণ করেন। আস্তে আস্তে লুসাইরা পড়াশুনায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রায় ৯৬% লুসাই শিক্ষিত এবং বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে।

লুসাইরা খুবই সংস্কৃতিমনা এবং নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষার ব্যাপারে সচেতন। নিজস্ব ঐতিহ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, অলংকার ইত্যাদির ব্যবহার এখনও প্রচলিত আছে।

অতীতে লুসাইরা যার যার গ্রামে একেক নিয়মে দেবদেবীর পূজা করতো। পরে লুসাইদের মধ্যে খ্রিস্টানধর্ম বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে শতভাগ লুসাই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় উৎসব পালন ছাড়াও বছরে তারা প্রধান তিনটি উৎসব পালন করে থাকে: ১. চাপচারকূত (বসন্ত উৎসব) ২. মীমতূত (মৃত আত্মাদের স্মরণে) এবং ৩. পলকূত (শস্য কাটার উৎসব)।

লুসাইদের মধ্যে জেঠাতো বা কাকাতো ভাইবোনের বিয়ে হতে পারে না। তবে মামাতো ও খালাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে হয়। বর্তমানে খিস্টধর্ম গ্রহণের পরে বিয়ের ব্যাপারে কোনো বাধা না থাকায় অতীতের রীতিনীতি অদ্যাবধি পালিত হয়। অভিভাবক বা যুবক যুবতীর নিজের পছন্দে বিয়ে হলে প্রথম ‘পালাই’ (মধ্যস্থতাকারী) হিসেবে ছেলেপক্ষের কেউ মেয়েপক্ষের নিকট প্রস্তাব পাঠাবে। মেয়ের পিতামাতা ও নানানানী রাজি হলে আলোচনার মাধ্যমে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়।

লুসাই সমাজে বিয়েতে পণ প্রথা বিদ্যমান। অতীতের রীতিনীতি অনুসারেই কনে বিয়ের ২/১ দিন আগেই পিতামাতা আত্মীয়স্বজনসহ প্রথমে পালাই-এর বাড়িতে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। পালাই শুকর কেটে তাদের ভোজের ব্যবস্থা করে। বিয়ের দিন বরপক্ষ পালাই-এর বাড়ি থেকে কনেকে নিয়ে এসে প্রথমে বরের বাড়িতে এবং পরে গীর্জায় গমন করে। গীর্জায় তাদের বিবাহকার্য সম্পন্ন হওয়ার পরে বরের বাড়িতে সকল আত্মীয়স্বজন যায় এবং সেখানে ভোজের আয়োজন করা হয়। ঐদিন কনে বরের বাড়িতেই অবস্থান করে। ২/১ দিন পরে কনে পালাই-এর বাড়িতে যায় এবং তার সমস্ত জিনিসপত্রসহ বরের বাড়িতে ফিরে আসে। লুসাই সমাজের প্রথা অনুযায়ী আগস্ট মাসে বিবাহ অনুষ্ঠান করা হয় না। অতীতে লুসাই বিবাহ অনুষ্ঠানে বর জামা ও লুঙ্গি এবং কনে ব­াউজ ও থামি পরলেও বর্তমানে বর শার্ট-প্যান্ট এবং কনে সাদা গাউন পরিধান করে। লুসাইদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ও বিধবাবিবাহ বিদ্যমান।

খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর থেকে মৃতদেহ সৎকারে লুসাইদের নানা আচার এবং মৃত আত্মাদের নিয়ে বিভিন্ন বিশ্বাস এখন আর নেই। খ্রিস্টান ধর্মানুযায়ী প্রার্থনার পর মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়। যুবকরা কবর প্রস্তুত করে এবং একটি পাথরে মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ এবং তার গ্রাম ইত্যাদি লিখে কবরের উপর মাটিতে পুঁতে রাখে।  [খন্দকার ফাতেমা জোহরা]