লাঙ্গলবন্দ

লাঙ্গলবন্দ ঢাকা থেকে প্রায় ২০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোল ঘেঁষে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে অবস্থিত একটি জনপদ। প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে এই স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নানার্থে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তপ্রাণের আগমন ঘটে। ভক্তগণের বিশ্বাস এ সময় ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান খুবই পুণ্যের, এ স্নানে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভ করে পাপমোচন হয়। এই স্নানই অষ্টমী স্নান নামে অভিহিত। অধিকাংশ স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, চৈত্রের শুক্লাষ্টমীতে জগতের সকল পবিত্র স্থানের পুণ্য ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়। নদীর জল স্পর্শমাত্রই সকলের পাপ মোচন হয়। যে এই পবিত্র জলে স্নান করে সে চিরমোক্ষ লাভ করে।

লাঙ্গলবন্দে স্নানরত ভক্তগণ

স্নান উপলক্ষে লাঙ্গলবন্দের ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই তীর্থস্থানটি বিভিন্ন বয়সের ধর্মপ্রাণ ও পুণ্যার্থী মানুষের কলকোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ এলাকা জুড়ে তিন-চার দিনবাপী এক বিরাট মেলা বসে। এ মেলায় লোকজ ও কারুশিল্প থেকে শুরু করে সব রকম জিনিস পাওয়া যায়। মেলায় আশপাশের অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন সওদা করতে আসে।

লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান সম্পর্কে একটি দীর্ঘ পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। কোন এক দূর অতীতে জমদগ্নি মহামুনির রেনুকা নামে এক রাজবংশীয় পরমাসুন্দরী স্ত্রী ছিল। তাদের ছিল পাঁচ পুত্র। সর্বকনিষ্ঠের নাম ছিল পরশুরাম। ঘটনাক্রমে মার্তিকাবর্ত দেশের রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে আশ্রমবাসিনী রেণুকা কামস্পৃহ হয়ে পড়েন এবং নিজের পূর্ব-রাজকীয় জীবন সম্পর্কে স্মৃতিবিষ্ট হন। মুনি স্ত্রীর এই আসক্তি দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে পাঁচ পুত্রকে তাদের মাতাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কোন পুত্রই মাতৃহত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতে রাজি হলো না। তখন মুনি তার প্রিয় পুত্র পরশুরামকে আদেশ দিলে পরশুরাম এক কুঠারের আঘাতে মাকে হত্যা করেন।

মাকে হত্যা করে পরশুরাম পরম পাপী হিসেবে চিহ্নিত হন। পাপের শাস্তি হিসেবে কুঠারটি তার হাতে আটকে থাকে। শত চেষ্টা করেও তা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারলেন না। তখন পিতা তাকে বিভিন্ন তীর্থস্থানে গিয়ে পাপমুক্ত হতে বলেন। মাতৃহত্যার ভয়াবহ পাপের অনুশোচনা নিয়ে তিনি তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরে বেড়ান।

দেবতা ব্রহ্মপুত্র তখন হিমালয়ের বুকে হ্রদরূপে লুকিয়ে ছিলেন। দৈবক্রমে পরশুরাম ব্রহ্মপুত্রের মাহাত্ম্যের কথা জানতে পারেন। তিনি খুঁজে পেলেন হিমালয়ে লুক্কায়িত ব্রহ্মপুত্র হ্রদ এবং প্রার্থনা জানালেন যেন এর পবিত্র জলে তার পাপ মুক্ত হয়। তিনি হ্রদের জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আটকে থাকা কুঠারখানা খসে পড়ে। এভাবে তিনি মাতৃহত্যার প্রায়শ্চিত্ত থেকে মুক্ত হলেন। ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পাপহরণকারী জল যাতে সাধারণ মানুষের উপকারে আসে এ উদ্দেশ্যে পরশুরাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তিনি কুঠারখানা লাঙলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময় ও পথ পরিক্রমায় পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তিনি ব্রহ্মপুত্রের জলধারাকে বিভিন্ন জনপদ ঘুরিয়ে অবশেষে বর্তমান লাঙ্গলবন্দে এসে ক্লান্ত হয়ে থেমে যান এবং লাঙল চষা বন্ধ করে দেন। তার লাঙলের ফলকে তৈরি পথ ধরে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হতে থাকে। সেই থেকে এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ এবং তা হয়ে ওঠে হিন্দুধর্মের মানুষের জন্য পরম পুণ্যস্থান।

এরপর পরশুরাম এ পবিত্র ব্রহ্মপুত্র নদের অলৌকিক শক্তি ও মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণে যান। কিন্তু যেখানে এসে ব্রহ্মপুত্র থেমে গেলেন তার কাছাকাছি দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের এক সুন্দরী নদী শীতলক্ষ্যা। ব্রহ্মপুত্রের কাছে সুন্দরী শীতলক্ষ্যার রূপ-যৌবনের কথা পৌঁছালে শক্তিশালী ও পবিত্র ব্রহ্মপুত্র প্রচন্ড বেগে সুন্দরী শীতলক্ষ্যার দিকে ধাবিত হলেন। ব্রহ্মপুত্রের এই ভয়ঙ্কর ও বিশাল মূর্তি দেখে সুন্দরী শীতলক্ষ্যা তার সমস্ত সৌন্দর্য আড়াল করে বৃদ্ধার রূপ গ্রহণ করেন এবং নিজেকে বুড়িগঙ্গারূপে উপস্থাপন করেন। ব্রহ্মপুত্র বুড়িগঙ্গারূপী শীতলক্ষ্যার এই কুৎসিত চেহারা দেখে মর্মাহত হন, রেগে গিয়ে তার অবগুণ্ঠন উন্মোচনের পর লক্ষ্যার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন ও তার সঙ্গে মিলিত হন। এরপর দুজনের মিলিত স্রোতধারা একই সঙ্গে প্রবাহিত হতে থাকে।

এদিকে পরশুরাম তীর্থভ্রমণ শেষে ফিরে এসে দেখেন, যে ব্রহ্মপুত্রকে তিনি মানুষের উপকারার্থে সমতল ভূমিতে নিয়ে এসেছিলেন, যাকে তিনি জগতের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম নদরূপে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তিনি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। পরশুরাম দুজনকে অভিশাপ দিলেন। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র পরশুরামের যে উপকার করেছিলেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইলেন। পরশুরামের মনে দয়ার উদ্রেক হলে তিনি ব্রহ্মপুত্রের পাপ মোচনের অলৌকিক শক্তি হরণ করে নিয়ে শুধু বৎসরের একটি দিনেই তার অলৌকিক শক্তি অক্ষুন্ন রাখেন। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতেই থাকে সেই অলৌকিক শক্তি। তাই প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে লাঙ্গলবন্দে স্নান অনুষ্ঠিত হয়।

সমাগত ভক্তবৃন্দের জন্য স্নান সম্পন্ন করাকে সহজ করার জন্য বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি ঘাট নির্মাণ করেন। বর্তমানে এমন ১৩টি বাঁধানো ঘাট আছে। এই ১৩টি ঘাট হলো প্রেমতলা ঘাট, অন্নপূর্ণা ঘাট, রাজঘাট, বরদেশ্বরী ঘাট, গান্ধীঘাট, জয়কালী ঘাট, পাঠানকালী ঘাট, শ্রীরামপুর ঘাট, কালীবাড়ী ঘাট, কালীদহ ঘাট, শঙ্কর ঘাট, শিখরী ঘাট ও রক্ষাকালী ঘাট। এই ঘাটগুলির পাশাপাশি সেখানে রয়েছে ১০টি মন্দির ও কয়েকটি আশ্রম। স্নানের সময় ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এখানে অসংখ্য মানুষ আসে।  [মোফাজ্জল হোসেন]