রোভার স্কাউট
রোভার স্কাউট স্কাউট আন্দোলনের শাখা। এ শাখা খোলা হয় ১৯১৮ সালে যুবকদের (১৭-২৫ বয়সী) নিয়ে। ইংল্যান্ডের লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল (বিপি) ১৯০৭ সালে ২১ জন বালক (১১-১৭ বয়সী) নিয়ে ইংল্যান্ডের ব্রাউনসী দ্বীপে ক্যাম্প অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্কাউট আন্দোলনের সূচনা করেন। স্কাউটিংয়ের মূলমন্ত্র এবং প্রশিক্ষণের নীতিমালা তুলে ধরে ব্যাডেন পাওয়েল ১৯০৮ সালে স্কাউটিং ফর বয়েজ নামে বই প্রকাশ করেন। বইটি তাৎক্ষণিকভাবে বালকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে, ১৯০৯ সালের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্কাউটিং ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েরাও এগিয়ে এলে ব্যাডেন পাওয়েল ১৯১০ সালে শুরু করেন গার্লস গাইড। বালকদের (৬-১১ বয়সী) আগ্রহে ব্যাডেন পাওয়েল শুরু করেন কাব স্কাউট। কাবদের প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ১৯১৬ সালে প্রকাশ করেন দি উলফ কাব হ্যান্ডবুক এবং রোভারদের আত্মোন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি ১৯২২ সালে রোভারিং টু সাকসেস বইটি প্রকাশ করেন। এভাবেই স্কাউটিংয়ের তিনটি শাখা: কাবিং, স্কাউটিং এবং রোভারিং চালু হয়, সারাবিশ্বে যার সদস্যসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২.৮ কোটি। বর্তমানে ২১৬টি রাষ্ট্র ও অঞ্চলে স্কাউটিং চালু রয়েছে। স্কাউটিং পরিচালনার জন্য ১৯২০ সালে জেনেভায় স্থাপিত হয় বিশ্ব স্কাউট সংস্থা। এর রয়েছে মহাদেশভিত্তিক ৬টি অঞ্চল। বর্তমানে এ সংস্থার সদস্যসংখ্যা ১৫৫। বাংলাদেশ প্যাসিফিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। গার্লস গাইড পরিচালনার জন্য ১৯৩০ সালে গঠিত হয় ‘বিশ্ব গার্লস গাইড ও গার্ল স্কাউট অ্যাসোসিয়েশন’ যার রয়েছে চারটি সেন্টার।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে স্কাউটিং শুরু হয় (যদিও এ অঞ্চলে পূর্ব থেকে স্কাউটিং চালু ছিল)। ১৯৭৪ সালে ১০৫ নং সদস্যদের হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব সংস্থার স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ জাতীয় স্কাউটস এর চিফ স্কাউট হলেন রাষ্ট্রপতি। একজন নির্বাচিত সভাপতি এবং প্রধান জাতীয় কমিশনার এটি পরিচালনা করে থাকেন। বাংলাদেশ স্কাউট ১২টি অঞ্চলে বিভক্ত, যার মধ্যে রোভার অঞ্চল একটি। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুক্তদলসহ রোভার অঞ্চল গঠিত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে স্কাউটদের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ, যার মধ্যে ৪০ হাজার রোভার।
ব্যাডেন পাওয়েলের ভাষায় রোভার হচ্ছে মুক্তাঙ্গনে সেবার আদর্শে ভ্রাতৃত্ব। রোভারিং হচ্ছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়ন ও সেবার লক্ষ্যে আজীবন আত্মনিয়োগ। রোভারিং এমন একটি অভিজ্ঞতা যার মাধ্যমে সে সুনাগরিকত্ব অর্জন করে সমাজসেবা ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজে অংশ নেয়।
রোভারিং পরিচালনার জন্য ব্যাডেন পাওয়েল তার বইগুলিতে লিপিবদ্ধ করেন একটি প্রোগ্রাম (সিলেবাস) এবং কিছু নিয়মাবলি। রোভারদল পরিচালনার জন্য একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোভার স্কাউট লিডার থাকেন। রোভারদলের জন্য একটি ডেন (অফিস) থাকে যেখানে দলের জন্য প্রোগ্রামভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। রোভার প্রোগ্রামের সময়কাল সাড়ে তিন বছর (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছর)। রোভার কার্যক্রম ৪টি স্তরে বিভক্ত রোভার সহচর, সদস্য, প্রশিক্ষণ এবং সেবা স্তর। এসব স্তরে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ প্রশিক্ষকদের মাধ্যমে রোভারদেরকে পর্যায়ক্রমে স্কাউট আন্দোলন, সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজে দক্ষতা অর্জনে ট্রেনিং দেওয়ার পর এদেরকে আর্ত-মানবতার সেবা ও সমাজ উন্নয়নে কাজে লাগানো হয়। রোভারিংয়ের মূলনীতি হচ্ছে স্কাউট আইন ও প্রতিজ্ঞা পালন করা। প্রতিজ্ঞায় সে সৃষ্টিকর্তা ও দেশের প্রতি কর্তব্যপালন, সর্বদা অপরকে সাহায্য করতে এবং স্কাউট আইন মেনে চলতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে। স্কাউট আইন ৭টি: স্কাউট আত্মমর্যাদায় বিশ্বাসী, সকলের বন্ধু, বিনয়ী ও অনুগত, জীবের প্রতি সদয়, সদাপ্রফুল্ল, মিতব্যয়ী এবং চিন্তা, কথায় ও কাজে সে নির্মল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মুক্ত দলে রোভারগণ নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে স্কাউট পদ্ধতিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন।
স্কাউট পদ্ধতির মূল কথা হচ্ছে ক্রমোন্নতি ব্যবস্থা যার মধ্যে রয়েছে স্কাউট আইন ও প্রতিজ্ঞা, নিজে কাজ করে শেখা, উপদল ব্যবস্থা, পরিবেশ সংরক্ষণ, ক্যাম্প এবং হাইকিং, পাইওনিয়ারিং এবং প্রাথমিক প্রতিবিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন এবং সমাজসেবা ও সমাজ উন্নয়নে অংশগ্রহণ। প্রতিটি দক্ষতা অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট ব্যাজ রয়েছে। যেমন সেবা প্রশিক্ষণ ব্যাজ, পরিভ্রমণকারী ব্যাজ (৫ দিনে ১০০ মাইল পায়ে হেটে ভ্রমণ বা র্যাম্বলিং), স্কাউট কুশলী ব্যাজ, প্রকল্প ব্যাজ (৬ মাস কোনো একটি লাভজনক অ্যাওয়ার্ড হচ্ছে ‘প্রেসিডেন্ট রোভার স্কাউট অ্যাওয়ার্ড’ অর্জন। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১১ জন এই অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে, যার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ১৮ জন।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২২০০টি রোভারদল রয়েছে, যার মধ্যে ঢাকা জেলাতেই রয়েছে ২০৭টি। এসব দলের মধ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৭১টি এবং মুক্তদলের সংখ্যা হচ্ছে ৩৬টি। বাংলাদেশে স্কাউট কার্যক্রম অত্যন্ত শক্তিশালী। বিশেষ করে দেশটি দরিদ্র, জনবহুল ও দুর্যোগপ্রবণ হওয়ায় এখানে রোভার কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রসারলাভ করেছে এবং দেশ ও বিশ্বাঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, স্কাউটের সংখ্যা, কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ও গুণগত মান বিচারে বাংলাদেশ বিশ্ব স্কাউট আন্দোলনের শীর্ষ ৫টি দেশের মধ্যে অন্যতম। [মো. রমজুল হক]