রেলওয়ে

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

রেলওয়ে  উনিশ শতকে প্রবর্তিত হয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপ্লবের সূচনা করে। জর্জ স্টিফেনসনের যুগান্তকারী প্রচেষ্টায় ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বের প্রথম রেলওয়ে ইংল্যান্ডের স্টকটন থেকে ২৬ কিমি দূরবর্তী ডার্লিংটন পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উদ্বোধন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেলওয়ের প্রথম উদ্বোধন হয় মোহাওয়াক থেকে হাডসন পর্যন্ত ১৮৩৩ সালে। জার্মানিতে এর প্রথম উদ্বোধন হয় ১৮৩৫ সালে নুরেমবার্গ থেকে ফুর্থ পর্যন্ত, ইতালিতে হয় ১৮৩৯ সালে, ফ্রান্সে ১৮৪৪ সালে, স্পেনে ১৮৪৮ সালে এবং সুইডেনে ১৮৫৬ সালে। রেলওয়ের প্রবর্তনে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাও পিছিয়ে ছিল না।

রেলপথ বিকাশের ইতিহাস  উনিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় উপনিবেশিক বাংলায় রেলওয়ে স্থাপনের জন্য প্রাথমিকভাবে ইংল্যান্ডে চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা হতে থাকে। এরূপ পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও কৌশলগত সুবিধাদিসহ বাণিজ্যিক স্বার্থ বিবেচনা।

ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডালহৌসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক পর্ষদের কাছে ভারতবর্ষে রেলওয়ে স্থাপন কাজ শুরু করার জন্য অনেকগুলি প্রস্তাব পাঠান। ১৮৪৪ সালে আর.এম স্টিফেনসন কলকাতার সন্নিকটে হাওড়া থেকে পশ্চিম বাংলার কয়লাখনি সমৃদ্ধ রানীগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি গঠন করেন।

কমলাপুর রেলস্টেশন, ঢাকা

তবে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেতে ও সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। ইতোমধ্যে, ১৮৫০ সালে গ্রেট ইন্ডিয়ান পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানি মুম্বাই থেকে থানা পর্যন্ত ৩৩ কিমি দীর্ঘ রেললাইন স্থাপন করতে থাকে। লাইনটি উদ্বোধন করা হয় ১৬ এপ্রিল ১৮৫৩ সালে। এটিই ছিল ব্রিটিশ ভারতে রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিমি রেললাইনের উদ্বোধন হয় ১৮৫৪ সালে এবং এর মাধ্যমে চালু হয় বাংলার প্রথম রেললাইন।

বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ব্রিটিশ আমলেই বিবেচনা করা হয়েছিল। ১৮৫২ সালে কর্নেল জে.পি কেনেডি গঙ্গা নদীর পূর্বতীর ধরে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেললাইন বসানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু এর মধ্যেই ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ সরকার বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) দখল করে। বার্মাকে সরাসরি ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার রাজনৈতিক এবং কৌশলগত কারণেই কলকাতা ও বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগের প্রশ্নটি প্রকট হয়। ১৮৫৫ সালে বাংলায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের মেজর অ্যাবার ক্রমবি মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। এতে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামে একটি কোম্পানি গঠনের সম্ভাব্যতা উলে­খ করা হয়। পরবর্তী দুই বছরে প্রবীণ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার পুর্ডন-এর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার রূপ নেয়।

হার্ডিঞ্জ রেলসেতু

১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে  কলকাতা থেকে রাণাঘাট পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করে। এই লাইনকেই বর্ধিত করে ১৫ নভেম্বর ১৮৬২ সালে দর্শনা থেকে জগতী পর্যন্ত ৫৩.১১ কিমি ব্রডগেজ (১,৬৭৬ মিমি) রেললাইন শাখা উন্মোচন করা হয়। সে সময় কুষ্টিয়া ছিল প্রান্তিক স্টেশন, কিন্তু ১৮৬৭ সালে পদ্মা ভাঙনের কারণে তা স্থানান্তরিত হয় গড়াই নদীর পাড়ে এবং পরবর্তী বছরে আদি কুষ্টিয়া স্টেশন পরিত্যক্ত হয়। কুষ্টিয়া থেকে পদ্মার পাড়ে (পদ্মা ও যমুনার সংযোগস্থলের নিচে) অবস্থিত অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর গোয়ালন্দ পর্যন্ত ৭৫ কিমি দীর্ঘ রেললাইন উদ্বোধন করা হয় ১ জানুয়ারি ১৮৭১ সালে।

১৮৭৪ সাল থেকে ১৮৭৯ সালের মধ্যে নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নামে ব্রিটিশ সরকার একটি নতুন ২৫০ কিমি দীর্ঘ মিটারগেজ (১,০০০ মিমি) রেললাইন স্থাপন করে। লাইনটি পদ্মার বামতীর ঘেঁষে সারা থেকে চিলাহাটি হয়ে হিমালয়ের পাদদেশস্থ ভারতের শিলিগুড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই লাইন পূর্বে পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া এবং পশ্চিমে পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত দীর্ঘ। একই সময়ে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে সারা-র উল্টোদিকে পদ্মার ডান পাশে অবস্থিত দামুকদিয়া থেকে পোড়াদহ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেললাইন সংযোজন করে। এতে রেলওয়ে নিয়ন্ত্রিত স্টিমারের পক্ষে ফেরিতে পদ্মা নদী পারাপারে সুবিধা হয়। মাঝপথে একমাত্র পদ্মা নদীর এই প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত যাত্রা ছিল সরাসরি। ১৮৮৪ সালে ১ জুলাই ব্রিটিশ সরকার, কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়েকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং এর নতুন নামকরণ করে ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে।

বিশ্বজুড়ে পাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য প্রধান পাট উৎপাদনকারী এলাকা ঢাকা এবং ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা বন্দরে পাট সরবরাহ করার জন্য উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮৮৫ সালে মূলত কাঁচা পাট নদীপথে কলকাতায় আনার জন্য ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নামে খ্যাত ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিমি দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইন স্থাপন করা হয়। ক্রমান্বয়ে এটিকে ময়মনসিংহ থেকে জামালপুর হয়ে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট এবং পরবর্তীকালে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। ১৮৮৭ সালে আরও ভাল ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে নর্দান বেঙ্গল রেলওয়ে এবং ঢাকা স্টেট রেলওয়েসহ কাউনিয়া থেকে কুড়িগ্রাম (ধরলা) পর্যন্ত ন্যারোগেজের (৭৬২ মিমি) রেললাইনকে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করা হয়। একই কারণে ১৮৮২-৮৪ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল রেলওয়ে নামে পরিচিত বনগাঁ-যশোর-খুলনা ব্রডগেজ রেললাইন এবং ১৮৯৯ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে শান্তাহার থেকে ফুলছড়ি (তিস্তামুখ ঘাট) পর্যন্ত ৯৪ কিমি মিটারগেজ লাইন চালু করা হয়েছিল। এ দুটি লাইনকে যথাক্রমে ১৯০৪ সালে ১ এপ্রিল এবং একই বছর ১ জুলাই ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের সঙ্গে আত্মীকরণ করা হয়। ১৯০৫ সালে কাউনিয়া ও বোনারপাড়ার মধ্যে ৪৪ কিমি মিটারগেজ রেল লাইন চালু হয়। এভাবে ঢাকা এবং রাজশাহী বিভাগের ব্যাপক এলাকায় রেলপথ বিস্তার লাভ করে।

কলকাতা থেকে উত্তরবঙ্গ এবং আসামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের জন্য পদ্মার উপরে সেতু নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়ে। ১৯১৪ সালে পদ্মার উপরে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রকল্প বাস্তবায়ন উপলক্ষে সারা থেকে শান্তাহার পর্যন্ত মিটারগেজ লাইনকে ব্রডগেজ লাইনে রূপান্তর করা হয়। কলকাতা থেকে দিলি­, মাদ্রাজ ও মুম্বাই পর্যন্ত প্রধান রেলপথগুলি ছিল ব্রডগেজ মাপের। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ দুই লেনবিশিষ্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেল চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হয়। ১৯২৪ সালের জুলাই মাসে শান্তাহার থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ৯৫ কিমি এবং ১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ#

আন্তঃনগর ট্রেন

পার্বতীপুর থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত ৬৭ কিমি রেলপথ মিটারগেজ থেকে ব্রডগেজে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি থেকে চিলাহাটি হয়ে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য স্থানে মালামাল সরবরাহ ও যাত্রী চলাচল গাড়ি বদল ছাড়াই সম্ভব হয়ে ওঠে। ১৯১৫ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে নাম থেকে সরকারিভাবে ‘স্টেট’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।

ব্রিটিশ সরকার তিন প্রকার গেজের (প্রস্থের) রেলপথ প্রবর্তন করে, যথা: ব্রড (১,৭৬৭ মিমি), মিটার (১,০০০ মিমি) এবং ন্যারো (৭৬২ মিমি)। নিকটতম নদীবন্দর অথবা প্রধান প্রধান রেলপথের মাঝে সংযোগ স্থাপনের জন্য স্বল্প দূরত্বের রেললাইন স্থাপন করা হয়। অধিকতর সম্ভাবনাপূর্ণ এলাকার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য রেলপথের পরিবর্ধনও করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী গাড়িবদল ব্যতিরেকে রেলযোগাযোগ আরও সুসঙ্গত করার লক্ষ্যে রেলপথ রূপান্তরের কাজও অব্যাহত থাকে।

১৯২০ সালে রেলওয়ে ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দ্বারা পরিচালিত ৮৮ কিমি বেসরকারি রেললাইন রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। ১৯১৫-১৬ সালে স্থাপিত ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ৮০ কিমি রেলপথটি ব্রিটিশ সরকার ১ অক্টোবর ১৯৪৪ সালে কিনে নেয়। ১৯১৬ সালে ভেড়ামারা থেকে রায়তা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন খোলা হয়। ১৯১৮ সালে জুন নাগাদ ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে রূপসা (খুলনা) থেকে বাগেরহাট ৩২ কিমি রেলপথটি নির্মাণ করে, কিন্তু ১৯৪৮ সালে তা সরকারি আওতায় আনা হয়। ১৯১৯ সাল নাগাদ সরকার ও কোম্পানি কর্তৃক সর্বমোট ১,৮০৬.১৬ কিমি রেলপথ নির্মিত হয়।

বেসরকারি রেলওয়ে কোম্পানিগুলি নির্দিষ্ট চুক্তি অনুযায়ী কাজ করত। চুক্তিপত্রের শর্তাদিতে ছিল জমি, সরকারি সাহায্য, মুনাফা বহন, ভাড়ার হার ছাড়াও বিশেষ দায়িত্ব পালন, যেমন চিঠিপত্র, সৈন্যসামন্ত, পুলিশ, সরকারি অফিসার-কর্মচারী বা সরকারি টাকা পয়সা ও বহন সরকারি মালামাল পরিবহণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে।

বাহাদুরাবাদ থেকে জামালপুর (সিংহজানি) পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইন চালু হয় ১৯১২ সালে। ১৯২৮-২৯ সালে তিস্তা-কাউনিয়া ন্যারোগেজের রেললাইন মিটারগেজে রূপান্তর করা হয়। ১৯৩০ সালে আব্দুলপুর থেকে আমনুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন নির্মিত হয়। এর একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল আম ও আখ পরিবহণ এবং সেন্ট্রাল বেঙ্গল থেকে রোহনপুর হয়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। পরিবহণ ব্যবস্থার প্রবল চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৭ সালে আগস্ট মাসে দর্শনা থেকে পোড়াদহ পর্যন্ত দুই লেনের রেলপথ (double line) স্থাপন করা হয়। এরপর দুই লেনের ব্রডগেজ লাইন স্থাপিত হয় পোড়াদহ-ভেড়ামারা (১৯০৯ সালে), ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী (১৯১৫ সালে) এবং ঈশ্বরদী-আব্দুলপুরে (১৯৩২ সালে)।

ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে চায়ের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি চীন থেকে চা আমদানি শুরু করে। ১৮৩০ সালে বিভিন্ন কারণে চীন থেকে চা আমদানি বন্ধ হওয়ায় ব্রিটিশ কোম্পানিগুলি হিমালয়ের দক্ষিণাংশে আসাম (সিলেট) ও উত্তরবঙ্গে (দার্জিলিং ও কুচবিহার/আলীপুর দুয়ার) চা বাগান স্থাপনের কাজ শুরু করে। চা বাগানগুলির উৎপাদন বাজারজাত করার জন্য ১৯০২ সালে বেঙ্গল ডুয়ার্স ন্যারোগেজের রেলপথটি কাউনিয়ার উত্তরে নর্থ বেঙ্গলের কুচবিহার পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে ১৯৪১ সালে প্রশাসনিক ভাবে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এর দক্ষিণাংশ বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতায়। কেবল বাহাদুরাবাদ-ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লাইন ছাড়া ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের পুরো অংশটাই ছিল ব্রহ্মপুত্র নদীর পশ্চিম পাশে। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতার শিল্প, বাণিজ্য ও শহরতলি এলাকার চাহিদা পূরণের জন্য এমনভাবে বিস্তার লাভ করে যে পুরো রেলওয়ে ট্র্যাকের বিন্যাস কলকাতামুখী হয়ে ওঠে।

১৮৩০ সালের দিকে মূলত আসাম অঞ্চলের সিলেট এলাকায় চা কোম্পানিগুলির স্থাপনা শুরু হয়। যেসব চা উৎপাদনকারী কোম্পানি আসামের চা বাগানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯১ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে স্থাপন করা হয়েছিল। এর প্রধান দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। আসামসংলগ্ন সমৃদ্ধশালী জেলাগুলিতে চা এবং অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা নিতে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়ে। এই বন্দর থেকেই আবার ব্রিটিশ বাংলার ঢাকা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, ত্রিপুরা (কুমিল্লা) এবং চট্টগ্রাম জেলার পাট, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কাঁচামাল বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। ১৮৯২ সালে ইংল্যান্ডে গঠিত আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এদেশে রেলপথ নির্মাণের দায়িত্ব নেয়। ১৮৯৫ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম থেকে কুমিল­া ১৫০ কিমি মিটারগেজ লাইন এবং লাকসাম থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৬৯ কিমি রেললাইন জনসাধারণের জন্য খোলা হয়। ১৮৯৬ সালে কুমিল্লা-আখাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ স্থাপন করা হয়। কিন্তু কলকাতা বন্দর এবং আশপাশের নদীভিত্তিক এলাকার কিছু স্বার্থান্বেষী স্টিমার কোম্পানি চট্টগ্রামে সমুদ্র বন্দরের স্থাপনা ও উন্নতি সাধনে বাদ সাধে। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৭ সালে প্রচন্ড প্রতিরোধের মুখেও, ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম বন্দরে জেটি নির্মাণ অনুমোদন করে। বন্দর প্রশাসন স্বয়ং ভিন্ন প্রশাসন হওয়া সত্ত্বেও, বন্দর নির্মাণ কজের ভার দেওয়া হয় আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কোম্পানির ওপর।

বিভিন্ন রেলপথের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংযোগপথের অংশগুলিতে রেল যোগাযোগের কাজ চলতে থাকে। ১৯০৩ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের পরিচালনায় বেসরকারি লাকসাম-নোয়াখালী রেল শাখা চালু হয়। ১৯০৫ সালে এই লাইনটি সরকার কিনে নেয়, এবং ১৯০৬ সালে ১ জানুয়ারি আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করে দেয়। টঙ্গী এবং আখাউড়ার মধ্যে রেললাইন স্থাপিত হয় ১৯১০ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে, সিলেট এবং কুলাউড়ার মধ্যে ১৯১২ থেকে ১৯১৫ সালে, শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ লাইন ১৯২৮ সালে, শায়েস্তাগঞ্জ-বেল্লা এবং ফেনী-বেলুনিয়ার মধ্যে ১৯২৯ সালে, চট্টগ্রাম-ষোলশহর লাইন ১৯২৯ সালে, ষোলশহর-নাজিরহাট লাইন ১৯৩০ সালে, ষোলশহর এবং দোহাজারী লাইন ১৯৩১ সালে।

১৯১২-১৯১৮ সালের মধ্যে ময়মনসিংহ-ভৈরববাজার রেলওয়ে কোম্পানি ময়মনসিংহ-গৌরীপুর, গৌরীপুর-নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ, শ্যামগঞ্জ-জারিয়া-ঝঞ্চাইল, গৌরীপুর-ভৈরববাজার রেললাইন স্থাপন করে। এই শাখাগুলি ১৯৪৮-৪৯ সালের মধ্যে সরকার অধিগ্রহণ করে। ময়মনসিংহ-গৌরীপুর-ভৈরব রেললাইন ছিল আসাম-বেঙ্গল রেল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাধীনে। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগের জন্য ১৯৩৭ সালে ৬ ডিসেম্বর মেঘনা নদীর উপর রেলসেতু উদ্বোধন করা হয়। ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে অধিগ্রহণ করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত করে এবং এর নতুন নামকরণ হয় বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্তির পর বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পায় ২,৬০৬.৫৯ কিমি রেললাইন এবং তা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর) নামে পরিচিত হয়। ১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এর নতুন নামকরণ হয় পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে। ইবিআর পায় প্রায় ৫০০ কিমি ব্রডগেজ এবং ২,১০০ কিমি মিটারগেজ লাইন, কিন্তু ব্রডগেজ রেল ইঞ্জিন বা ব্রডগেজ রেললাইনের উপরে চলাচল করার উপযুক্ত রেলযানসমূহ মেরামত করার কোন কারখানা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। তবে, পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে সৈয়দপুরে একটি মিটারগেজ রেল কারখানা পেয়েছিল। ইবিআর রেল পরিচালনার ক্ষেত্রে কতগুলি মারাত্মক অসুবিধা ও সমস্যার সম্মুখীন হয়, যেমন, সংযোগবিহীন রেললাইন, যানান্তরকরণের অসুবিধা, যমুনা নদীর দুই ধারে নাব্যতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফেরিঘাটসংলগ্ন রেললাইনের নিত্য স্থানান্তর সমস্যা ইত্যাদি। উপরন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেললাইনের উপর দিয়ে প্রবল ধকল যায়। দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত সেগুলি সঠিকভাবে মেরামত করা সম্ভব হয়নি।

দেশ বিভাগের পরপরই সঙ্গত কারণে সৈয়দপুর কারখানায় ব্রডগেজ রেল ইঞ্জিন ও যানবাহন মেরামতের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দর্শনা থেকে যশোর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ বিহীন এলাকায় ৬৯.২৩ কিমি একটি অসংযুক্ত ব্রডগেজ লাইন দ্রুত নির্মাণ করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ২১ এপ্রিল ১৯৫১ সালে। রেলওয়ের ট্র্যাকের প্রয়োজনীয় পাথর সরবরাহ করার জন্য সিলেট-ছাতক লাইনে ৩৩.৮ কিমি রেলপথ উন্মুক্ত করা হয় ১৯৫৪ সালের ১৫ অক্টোবর। ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ভোলাগঞ্জের নদীবক্ষ থেকে ছাতক বাজার পর্যন্ত সংগৃহীত শিলা ও নুড়িপাথর সরবরাহের জন্য ১৮.৫১ কিমি মনোরেল রোপওয়ে স্থাপনা সক্রিয় করা হয়। এই ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৬০ টন পাথর বহন করা সম্ভব হয়। ১৯৭০ সাল নাগাদ রূপসা-বাগেরহাট ন্যারোগেজ রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তর করা হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে  স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের পর এদেশের রেলওয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে, যা উত্তরাধিকারসূত্রে পায় ২,৮৫৮.৭৩ কিমি রেলপথ ও ৪৬৬টি স্টেশন। স্বাধীনতা যুদ্ধে রেলওয়ে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ফলে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে অনেক বছরে সেগুলি মেরামত করতে হয়। উল্লেখ্য ১৯৫০-এর দশকে সরকার রেলপথের বিস্তার ও পরিবর্ধনের জন্য যে সমীক্ষা চালায়, সে অনুযায়ী ডাবল লাইন ও শাখা রেলপথ তৈরি করার উদ্যোগ গৃহীত হয়।

১৯৬০-এর দশকে ঢাকা-টঙ্গী ও চট্টগ্রাম-চিনকি আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাকের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যে সেই সব ডবল লাইন পর্যায়ক্রমে খোলা হয়েছিল। পুনঃস্থাপন প্রকল্পের আওতায় ঘনবসতিপূর্ণ ও ঘিঞ্জি এলাকা ফুলবাড়িয়া থেকে কমলাপুরে ঢাকা রেলস্টেশন স্থানান্তরের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালের শেষের দিকে এবং তা চালু হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ১ মে তারিখে। ১৯৮৭ সালে ১১ এপ্রিল এই স্টেশনের সংলগ্ন এলাকায় দেশের প্রথম অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো উদ্বোধন করা হয়। ১৯৬৭ সালে ২৩.৬ কিমি রুহিয়া-পঞ্চগড় ও ২৮.৫৫ কিমি কুড়িগ্রাম-চিলমারী ব্রডগেজ রেললাইন খোলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৭০-এর দশকের প্রথম দিকে বন্যায় চিলমারী স্টেশন যমুনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় এবং বর্তমানে শুধু রমনা বাজার স্টেশন পর্যন্ত রেলগাড়ী চলাচল করে।

১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে নরসিংদী-মদনগঞ্জ ৪৬.৬৯ কিমি লাইন খোলা হয়। ট্রাফিক চলাচলের স্বল্পতার দরুন এই লাইন চালু রাখা মোটেই লাভজনক হয়নি, তাই ১৯৭৭ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই কারণে ১৯৯০ সালে ফরিদপুর-পুকুরিয়া এবং ভেড়ামারা-রায়তা লাইন বন্ধ হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে ১৯৯৬ সালে লালমনিরহাট-মোগলহাট এবং ১৯৯৭ এ রূপসা-বাগেরহাট, ফেনী-বেলুনিয়া ও কালুখালী-ভটিয়াপাড়া ঘাট শাখাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

১৯৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল। চার লেন সড়কপথ ও এক লেন ডুয়ালগেজ (পাশাপাশি ব্রডগেজ ও মিটারগেজ) রেলপথবিশিষ্ট এই সেতুর উপরে আছে বৈদ্যুতিক সংযোগ, গ্যাস লাইন ও টেলিফোন লাইনের বন্দোবস্ত। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন সেতু উদ্বোধন করা হয়। রেলওয়ে গেজ পদ্ধতিকে সুসঙ্গত করার জন্য যমুনা সেতুর পূর্ব প্রান্ত থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১১৫ কিমি ডুয়ালগেজ লাইন নির্মিত হচ্ছে এবং জয়দেবপুর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ৩৫ কিমি ব্রডগেজ লাইনকে ডুয়ালগেজ/ব্রডগেজে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছে। ২৪৫ কিমি দৈর্ঘ্য পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী-জামতৈল ব্রডগেজ রেলপথ যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে মিলেছে। সেটিকে ডুয়ালগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। যমুনা সেতুর উপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তে রেল সংযোগ স্থাপনের পর পরিবহণ ব্যবস্থায় গাড়ি বদলের অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে সব রেললাইনকে ক্রমান্বয়ে ব্রডগেজ লাইনে রূপান্তরের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়েকে বাস্তব কর্মপন্থা ও নীতি অবলম্বন করতে হবে।

ব্যবস্থাপনা  রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত কারণে বিভিন্ন সময়ে সরকারি আইন ও বিধান মোতাবেক বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি অনুযায়ী অতীতে ব্রিটিশ-বাংলার সমস্ত রেলওয়ে ব্রিটিশ প্রণীত কাঠামোর আওতায় কাজ করে যাচ্ছিল। রেলওয়ের ওপর সরকারি কর্তৃত্ব ছিল আইনানুগ, শর্তসাপেক্ষ এবং কার্যনির্বাহভিত্তিক। কোম্পানির পরিচালকগণ রেলওয়ের সব কাজকর্ম সার্বিকভাবে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত নীতিমালা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করত। ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রেলওয়ে শুল্কের বিভিন্ন ধারার ওপর আইন প্রণীত হয়। এই আইনে রেলভাড়া কত হবে, বিনা টিকেটে ট্রেনে ওঠার পরে কিভাবে টিকেট দেওয়া হবে, প্রতারণামূলক অপচেষ্টা, অনধিকার প্রবেশ এবং বিঘ্ন সৃষ্টি করা, মালামাল পরিবহণে রেলওয়ের দায়িত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে দায়বদ্ধতামূলক বিভিন্ন ধারা সংযোজিত হয়। বহু বছর ধরেই রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণ, দুর্ঘটনা, অনুপ্রবেশ, পরিদর্শন, জনগণের নিরাপত্তা ও রেল অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আইনের প্রণয়নও প্রয়োগ হয়ে আসছিল। তাই, অনেকদিন থেকেই রেলওয়ের জন্য একটা সার্বিক ও সুসমন্বিত বিধান তৈরি করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। পূর্বের সব আইন বাতিল করে ব্রিটিশ পার্লামন্টে ১৮৯০ সালে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে অ্যাক্ট নং-৯ পাশ করা হয়। ১৯৩৫ সালে ভারত সরকার এই আইনে কিছু সংশোধনী আনে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর উত্তরাধিকারসূত্রে পাকিস্তান রেলওয়ে সার্বিক কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ একইভাবে ঐ দায়িত্ব গ্রহণ করে ১৯৭১ সালে।

ব্রিটিশ আমলের প্রথম দিকে রেলওয়ের ওপর সার্বিক সরকারি কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রিত হতো একটি মিলিটারি বোর্ডের মাধ্যমে। এরপর ব্রিটিশদের স্বার্থে স্টেট রেলওয়ে ও কোম্পানি রেলওয়ের আনুকূল্যে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কখনও সেন্ট্রাল পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট, কখনও স্থানীয় সরকার, কখনও রেলওয়ে ডিরেক্টরেট, আবার কখনও রেলওয়ে বোর্ড নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এর দরুন ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলে রেলওয়ে ব্যবস্থাপনার উচ্চ স্তরে বহুবার পরিবর্তন ঘটে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রেলওয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়ে। সেই অনুসারে ১৯৭৩ সালে রেলওয়ে কমিশন রিপোর্ট, ১৯৭৬ ও ১৯৮২ সালে মার্শাল ল’ অর্ডিন্যান্স, এবং ১৯৯৫ সালে সরকারি আদেশ-এর (জিও) পরিপ্রেক্ষিতে রেলওয়ের উঁচু পর্যায়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আবারও অনেক পরিবর্তন সাধন করা হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে সরকারি সংস্থা হিসেবে সরকারি সহায়তায় এবং ব্যবস্থাপনায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে রেলওয়ে ডিরেক্টরেট-এর কার্যক্রম চলছে। মহাপরিচালকের অধীনে কয়েকটি স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে, যেমন অবকাঠামো, গাড়ি বহর, বিপণন ও পরিকল্পনা, পরিচালন এবং অর্থসংস্থান। দেশের সাধারণ রাজস্বের সাথে রেলওয়ের রাজস্ব সম্পৃক্ত করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ শাখা সরাসরি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবের অধীনে কাজ করে, হিসেব নিরীক্ষণের কাজ পরিচালিত হয় কম্পট্রোলার এবং অডিটর জেনারেলের অধীনে। পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়েকে যমুনা নদীর উভয়পার্শ্বে পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই জোনে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি জোনের কাজ-কর্ম পরিচালিত হয় একজন মহাব্যবস্থাপকের অধীনে, যাকে সাহায্য করেন কয়েকজন বিভাগীয় বিশেষজ্ঞ।

১ জুলাই ২০০০ সালে বাংলাদেশে মোট ২,৭৬৮ কিমি রেললাইন ছিল, তার মধ্যে পশ্চিম জোনে ৯৩৬ কিমি ব্রডগেজ, ৫৫৩ কিমি মিটারগেজ (১৫ কিমি ডুয়েলগেজসহ) এবং পূর্ব জোনে ১,২৭৯ কিমি মিটারগেজ। সমস্ত রেলওয়েতে আছে ৩৯৫টি বড় সেতু, ৩,১৩৯টি ছোট সেতু, ৪৫৫টি স্টেশন, ১,৫২২টি লেভেল ক্রসিং, ৬০,৬৩৩ একর জমি। প্রায় ৯৫% রেললাইন হচ্ছে এক লেনবিশিষ্ট। ব্রডগেজ লাইন ৯০ পাউন্ড রেল এবং মিটারগেজ লাইন ৭৫ পাউন্ড ও ৬০ পাউন্ড রেল দিয়ে সাধারণত তৈরি।

রেল পরিচালনা ও নিরাপত্তা  নিরাপদ ও সুসংহতভাবে রেল পরিচালনা করা এবং লাইনের পরিবহণ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সমগ্র রেল ব্যবস্থাপনায় যথাযথ সাংকেতিক ব্যবস্থা ও টেলিযোগাযোগের বিন্যাস করা হয়। নিরাপত্তা আরও জোরদার করার জন্য Absolute block working system অনুযায়ী রেলওয়ের পরিবহণ ব্যবস্থা চালিত হয়। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে আধুনিক রিলে ইন্টারলকিং-এর সঙ্গে টোকেনলেস ব্লক ওয়ার্কিং এবং কালার লাইট সিগন্যালিং ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম ব্রডগেজ লাইনে সবচেয়ে দ্রুত ট্রেন ঘণ্টায় ৮০ কিমি বেগে চলে। ময়মনসিংহ থেকে গৌরীপুর-ময়মনসিংহ সেকশনে ১৯৭০ ও ১৯৭৭ সালের মধ্যে রিলে ইন্টারলকিং ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯৫-৯৭ সালে ময়মনসিংহ-জামালপুর লাইনের ৬টি স্টেশনে এই ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৮০-৮৫ সালে ৩টি বড় বড় ব্রডগেজ স্টেশনে (পার্বতীপুর, শান্তাহার এবং ঈশ্বরদীতে) একই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী-খুলনা ব্রডগেজ লাইনে দ্রুতগতিতে ঘণ্টায় ৯৫ কিমি বেগে ট্রেন চলাচল করে। অন্যান্য স্টেশনগুলিতে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক সাংকেতিক ব্যবস্থাপনায় রেল পরিবহণ পরিচালনা করা হয়।

বাংলাদেশের অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় রেলওয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোটামুটি ভাল। ১৯৯৯ জুলাই থেকে জুন ২০০০ সালের মধ্যে মোট ৪৫৬টি রেল দুর্ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে ৬টি হয় মুখোমুখি সংঘর্ষে, ৪০৫টি সংঘটিত হয় লাইনচ্যুত হয়ে, ১টি অগ্নিকান্ডে, ৪৪টি অন্যান্য কারণে। এইসব দুর্ঘটনায় ২০ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ২৩৩ জন এবং আর্থিক মূল্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৫.৫০ লক্ষ টাকা। রেল পরিচালনায় দক্ষতা এবং নিরাপত্তা আরও বৃদ্ধি করার জন্য ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে প্রায় ৩০০ রেলস্টেশনের সঙ্গে ২,৭৬৮ কিমি-এর মধ্যে ১,৮০০ কিমি রেলপথের ওপর সর্বাধুনিক সমন্বিত অপটিক্যাল ফাইবার টেলিযোগাযোগ স্থাপন করা হয়। এই ব্যবস্থায় ৩০টি ড্রপ ইনসার্ট এবং মাল্টিপে­ক্সিং স্টেশন আছে। নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও সার্বিক পরিদর্শনের জন্য ১,৮৯০ সালে প্রণীত রেলওয়ে অ্যাক্ট এবং পরবর্তী আদেশানুক্রমে সরকারি রেলওয়ে পরিদর্শককে রেললাইনের উপর দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের যোগ্যতা, রেললাইন, সেতু, সিগন্যাল ও রোলিং স্টকসমূহের উপযুক্ততা, বিশেষ দুর্ঘটনার তদন্ত করা এবং আরও অনেক আনুষঙ্গিক কাজ পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়।

রোলিং স্টক  ১৯৫৩-৫৪ সালে রোলিং স্টক-এর (রেল ইঞ্জিন, যাত্রী ও মালবাহী গাড়ি এবং অন্যান্য রেলগাড়ি) আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ায় বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিন ক্রমান্বয়ে বাতিল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১০টি ডিজেল ইলেকট্রিক রেল ইঞ্জিন চালু করা হয়। ১৯৮৪-৮৫ সালের শেষদিকে সমস্ত বাষ্পচালিত রেল ইঞ্জিন বাতিল ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে রেলওয়ের মোট ২৬৮টি রেল ইঞ্জিন আছে। এগুলি দুই ধরনের, যথা- ডিজেল ইলেক্ট্রিক ও হাইড্রো ইলেক্ট্রিক। জুন, ২০০০ সাল পর্যন্ত রেলওয়ের মোট ২৩১টি ডিজেল ইলেক্ট্রিক (ব্রডগেজ ৫৫ এবং মিটারগেজ ১৭৬) ও ৩৭টি ডিজেল হাইডো্রলিক (ব্রডগেজ ১১, মিটারগেজ ২৬) রেল ইঞ্জিন চালু রয়েছে। একই সময়কালে বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট ১,৪১৯টি কোচ ছিল তার মধ্যে ১,২৮২টি (ব্রডগেজ ২৬২, মিটারগেজ ১,০২০) যাত্রী পরিবহণের জন্য এবং বাকি ১৩৭টি (ব্রডগেজ ১৩, মিটারগেজ ১২৪) মালামাল, তথা ডাক, পার্সেল বহন ও বিভাগীয় অন্যান্য কাজ করার জন্য। যাত্রী যানবাহনে বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির মিড-অন-জেনারেশন ব্যবস্থা চালু করা হয়। মালামাল পরিবহণের জন্য রেলওয়ের মোট ১০,৯২৯টি ওয়াগন আছে (ব্রডগেজ ২,৩৪৭, মিটারগেজ ৮,৫৮২), এর মধ্যে ২২০টি হচ্ছে মূল্যবান মাল বহনকারী কন্টেইনার ওয়াগন। এসব হিসাব জুন ২০০২ পর্যন্ত প্রযোজ্য।

রেল কারখানা  বাংলাদেশ রেলওয়ের আছে ৬টি কারখানা: ১টি সৈয়দপুরে, ২টি পাহাড়তলীতে, ২টি পার্বতীপুরে ও ১টি ঢাকায়। সবচেয়ে বড় কারখানা সৈয়দপুরে। এখানে উভয়প্রকার গেজের রেলকোচ এবং ওয়াগনের বড় ধরনের মেরামতের কাজসহ নতুন রেলকোচ ও ওয়াগন সন্নিবেশ (assembly) করা হয়। পাহাড়তলীতে দুটি কারখানার মধ্যে ১টিতে সম্পন্ন হয় মিটারগেজ রেলযান ও ওয়াগন মেরামত ও সমাবেশ, অন্যটিতে মেরামত করা হয় মিটারগেজের ডিজেল ইলেকট্রিক রেল ইঞ্জিন। ১৯৯২ সালে পার্বতীপুরে ক্রমবর্ধমান ডিজেল রেল ইঞ্জিনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য ১টি কেন্দ্রীয় ডিজেল কারখানা স্থাপন করা হয়। এটি হচ্ছে ইঞ্জিনের সব ধরনের বড় মেরামত এবং ওভারহলিং-এর প্রধান ও আধুনিক কারখানা। পার্বতীপুরে অন্য আরেকটি কারখানায় ব্রডগেজ ডিজেল রেল ইঞ্জিনের সাধারণ মেরামতের কাজ চলে এবং ঢাকা ওয়ার্কশপে মিটারগেজ রেল ইঞ্জিনের সাধারণ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

রেলওয়ে ফেরি সার্ভিস  যমুনা নদী পারাপারের জন্য জুন ২০০০ সাল নাগাদ রেলওয়ের যে ৩৪টি নৌবহর ছিল তার মধ্যে ৩টি ছিল প্যাসেঞ্জার স্টিমার, ৫টি টাগ, ৫টি ওয়াগন-ফেরি বার্জ, ৬টি পল্টুন র‌্যাম্প এবং ১৫টি ফ্লাট। এর মধ্যে, নৌযান রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১টি ভাসমান নৌযান মেরামত কারখানা রয়েছে।

ট্রাফিক  রেলভ্রমণের সুযোগ-সুবিধার যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটলেও দেশে সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের ফলে রেলের পরিবর্তে সড়কে ভ্রমণ করার প্রবণতা বেড়ে যায়। জুলাই ১৯৯৭ থেকে জুন ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতি আর্থিক বছরে ৩৭.৭২ লক্ষ যাত্রী রেলপথে যাতায়াত করেছে। তুলনামূলকভাবে দ্রুত ও উত্তম সার্ভিসের জন্য, গুদাম থেকে গুদামে সহজে যাতায়াতের কারণে মালামাল পরিবহণে রেলপথের চেয়ে সড়কপথই বেশি প্রাধান্য পায়। মূল্যবান মালামাল বহনের জন্য রেলওয়েকে খুব কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া গড়ে না ওঠার কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মালবাহী রেলগাড়িগুলির (wagons) যাতায়াত একমুখী হয়ে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালবাহী গাড়ি গন্তব্যস্থলে মালামাল খালাস করার পর খালি ফিরে আসে। অপরদিকে, জাতীয় পরিবহণ মাধ্যমের অঙ্গ হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়েকে অপরিহার্য দ্রব্যাদি, যেমন খাদ্যশস্য, সার, পাট,সিমেন্ট, কয়লা, লোহা, ইস্পাত, পাথর, পেট্রোলিয়াম, লবণ, চিনি ইত্যাদি স্বল্পমূল্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে হয়। জুলাই ১৯৯৭ থেকে জুন ২০০০ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৩.১১২ মিলিয়ন মেট্রিক টন মালামাল বাংলাদেশ রেলওয়ে বহন করেছে। ওয়াগন এবং কার্গোর চলাচল কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা একটি নতুন ও আধুনিক সংযোজন। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৩৫টি যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করে থাকে (এর মধ্যে ৫০টি আন্তঃনগর ট্রেন যেগুলির অবদান যাত্রীখাতে মোট আয়ের ৭৫ ভাগ) এবং ৪৮টি মালবাহী ট্রেন। যাত্রীপিছু গড় যাতায়াত দূরত্ব ১০১.৪ কিমি এবং প্রতিটন মালামালের ক্ষেত্রে গড়ে ২৬৫.২ কিমি। যমুনা নদীর দুই পাড়ে দুই ধরনের রেলওয়ে গেজ ও যমুনা নদী পারাপারে গাড়িবদল এবং যমুনা নদীর ঘাটগুলির ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেন পরিচালনায় প্রধান সমস্যা। এসব বাধাবিঘ্ন যাত্রী ও মালামাল পরিবহণের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।

অর্থায়ন  রেলযাত্রার জন্য ভাড়া আদায় ব্যয়-উশুল ভিত্তিক নয়। বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে রেলভাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ রেলওয়েকে অলাভজনক রুটে যাত্রী পরিবহণ, সাধারণ শুল্ক অপেক্ষা কম শুল্কে সামরিক সরঞ্জাম পরিবহণ, বিনা খরচে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ত্রাণ পরিবহণ, কর্মচারীদের জন্য কল্যাণমূলক ব্যয়, যেমন চিকিৎসা খরচ, শিক্ষা খরচ, বাড়িভাড়া প্রদান এবং রেলওয়ে পুলিশের ব্যয়ের বোঝা ইত্যাদি বহন করতে হয়। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ এই তিন অর্থবছরের বাৎসরিক গড় পরিচালন আয় ৩,৫৫৫ মিলিয়ন টাকা, পরিচালন ব্যয় ৪,৫৪৮ মিলিয়ন টাকা এবং নীট পরিচালন ক্ষতি ৯৩৩ মিলিয়ন টাকা টাকা হয়েছে। ১৯৯৩ সাল থেকে সরকার প্রতিবছর গড়ে ভর্তুকি বাবদ ১,০১২ মিলিয়ন টাকা রেলওয়েকে প্রদান করেছে।

কর্মসংস্থান  একটি জাতীয় সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ২০০০ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ রেলওয়েতে নিয়মিত কর্মচারী/কর্মকর্তা ছিল ৩৭,৪৩৯ জন, যার মধ্যে ৪৯৫ জন কর্মকর্তা (১ম শ্রেণী ও ২য় শ্রেণীভুক্ত) পদে এবং ৩৬,৯৪৪ জন ৩য় শ্রেণী ও ৪র্থ শ্রেণীভুক্ত কর্মচারী। বাংলাদেশ রেলওয়ের সকল কর্মকর্তা এবং পরিচালনাকারী স্টাফকে চট্টগ্রামে অবস্থিত রেলওয়ে প্রশিক্ষণ একাডেমী থেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। গড়ে প্রতিবছর কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য খরচ হয় ২,১৯০ মিলিয়ন টাকা যা মোট পরিচালন ব্যয়ের ৪৮ ভাগ। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে রেলওয়ে প্রশাসনের গোল্ডেনহ্যান্ডশেক (এককালীন সার্বিক সুবিধা) নীতির মাধ্যমে প্রায় ১০,০০০ কর্মচারী স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছে। কর্মচারী কমানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। বর্তমানে একান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেই শুধু নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।

রেলওয়ে ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন  ১৮৬০ সালে দি এমপ্লয়ার্স অ্যান্ড ওয়ার্কমেন’স (ডিসপিউট) আইন প্রবর্তন করা হলেও এই আইনটি বাস্তব ক্ষেত্রে নিয়োগকারীর স্বার্থই রক্ষা করত। ১৯২৫ এবং ১৯৩২ সালে এই আইনের কিছু ধারা পরিবর্তন করা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত রেলওয়েতে কোন ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকারিতা ছিল না। ১৯২১ সালে প্রায় ১,১০০ সদস্য নিয়ে প্রথম গঠিত হয় পূর্ববাংলা রেলওয়ে ভারতীয় শ্রমিক সংস্থা (Eastern Bengal Railway Indian Employees Association)। এর প্রধান কার্যালয় ছিল রেলওয়ে-জেলা লালমনিরহাটে। প্রশাসন এই সংস্থার কার্যক্রমকে স্বাগত জানালেও ১৯২৪ সালে প্রশাসনের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে এর স্বীকৃতি সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়। তবে তা ছিল খুব স্বল্প সময়ের জন্য। ১৯২২ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের শ্রমিকদের জন্য জেলা কল্যাণ সমিতি গঠন করা হয়। ১৯২১ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কর্মচারীরা চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সংহতি ঘোষণা করে ধর্মঘট ডাকে। এই ঘটনার মধ্যে দিয়েই দেশের রাজনীতিবিদদের সাথে রেলওয়ে কর্মচারীদের সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। ১৯২৬ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আইনের বিধান অনুযায়ী যেকোন ট্রেড ইউনিয়ন বহিরাগত ব্যক্তিদের সদস্যপদ দান করতে পারত, কিন্তু এ জাতীয় সদস্যের সংখ্যা হতে পারত সর্বোচ্চ শতকরা ৫০ ভাগ। শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক, এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে রেলওয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯২৯ সালের ট্রেড ডিসপিউট আইনটি ১৯৩২ সালে কিছুটা পরিবর্তন করা হয় এবং সে  অনুযায়ী কোর্ট স্থাপন করে বিবাদ মীমাংসার ব্যবস্থা রাখা হয়। ১৪ দিনের পূর্ব-ঘোষণা ব্যতীত যেকোন ধরনের ধর্মঘট এবং লকআউট ঘোষণা নিষিদ্ধ করা হয়। এই আইন ১৯৩৮ সালে আরও পরিবর্তন করা হয়। ১৯৪২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ধর্মঘট এবং লকআউটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ১৯৪৭ সালের শিল্প বিরোধ আইন মারফৎ ১৯২৯ সালের আইনকে পরিবর্তন করা হলেও, ধর্মঘটকে অবৈধ ঘোষণা করার বিধানটিকে অপরিবর্তিত রেখে দেওয়া হয়। তবে প্রশাসন ও কর্মচারীদের প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত ওয়ার্কস কমিটিকে সংবিধিবদ্ধ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিল। নতুন আইনে বিচারক হবার যোগ্যতাসম্পন্ন এক বা একাধিক সদস্যসম্বলিত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। ১৯৫২-৫৩ সালে ওয়ার্ক কমিটিকে প্রশাসন ও কর্মচারীদের কল্যাণ ও পারস্পরিক স্বার্থরক্ষা এবং সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে স্থানীয় সংস্থায় পরিণত করার ১৯৫২-৫৩জন্য নতুন নিয়ম প্রণয়ন করা হয়। ১৯৬০ সালের ট্রেড ইউনিয়ন অর্ডিন্যান্সের দ্বারা সর্বপ্রথম ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয় এবং এই স্বীকৃতি প্রদানের শর্ত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

রেলওয়ে কর্মচারীদের আন্দোলনের ফলে প্রধান যেসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে: যেসব রেলওয়ে কর্মচারীদের দিবা-রাত্রির যেকোন সময় কাজ করতে হয়, তাদের দায়িত্বের শ্রেণীবিন্যাস, এবং ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক কাজের সর্বোচ্চ সময় (কর্ম ঘণ্টা) ও সাপ্তাহিক ছুটির দিন নির্ধারণ করা। সরকার ১৯১৯ সালের ওয়াশিংটন কনভেনশন অনুযায়ী দৈনিক ৮ ঘণ্টার ও সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টার কর্মসময় এবং ১৯২১ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটির দিন নির্ধারণ করেছে। এই সূত্র ধরে ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইন পাস করা হয় এবং ১৯৩১ সালে তা রেলওয়েতে প্রযোজ্য হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ১৯৩২ সালে আইনটি বাস্তবায়ন করে। ১৯৩৬ সালে দ্য পেমেন্ট অব ওয়েজেস অ্যাক্ট অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়কালে মজুরি প্রদানের বিধান করা হয়। কর্মচারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইন, ১৮৯১ সালের কারখানা আইন, ১৯২৩ সালে কর্মচারী ক্ষতিপূরণ আইন এবং ১৮৯০ সালে রেলওয়ে আইনের ক্রমধারা অনুযায়ী একাধিক নিয়ম-কানুন প্রণয়ন করা হয়। ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্যান্য সুবিধাগুলি হচ্ছে হাসপাতাল, কেন্টিন, সমবায় বিপণী, সমবায় গৃহায়ণ প্রকল্প, কল্যাণ ট্রাস্ট ও ঋণদান সমিতি, কর্মচারীদের পোষ্যদের জন্য বিদ্যালয়, খেলার মাঠ, স্কাউটিং চালু করা ইত্যাদি স্থাপন ও প্রচলন।

ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রিটিশ এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কর্মচারীরা তুলনামূলকভাবে ভাল সুবিধা ও আচরণ পেত। কিন্তু মুসলমান কর্মচারীদের অবস্থা ছিল খারাপ। ১৯৪৩ সালে কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ গঠন করা হয়। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে লীগ গঠিত হয়। শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক ছিলেন এর প্রেসিডেন্ট। এরপরে গঠিত হয় অন্যান্য ট্রেড ইউনিয়ন। ১৯৪৮ সালে ১ জুলাই রেলওয়ে গেজেটের মাধ্যমে পাকিস্তান রেলওয়ে ওয়ার্কার্স লীগ ও ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই সময়ে অ্যাকাউন্টস এমপ্লয়িজ লীগ নামে আরেকটি সংগঠন পরিচিতি লাভ করে। ১৯৫৩ সালে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে মেডিক্যাল এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে মার্চ মাসে বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়ন, এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ শ্রমিক লীগ, এবং ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ গঠন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে রেলওয়েতে নিবন্ধিত মোট ৮টি ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকর রয়েছে।

রেলওয়ে খাতে সাম্প্রতিক সংস্কার  যাত্রী পরিবহণে রেলওয়ের শেয়ার ষাটের দশকের দিকে ৫০% থেকে নববইয়ের দশকে ১২%-এ নেমে গেছে এবং একই সময়ে মালামাল পরিবহণের ক্ষেত্রে ৪০% থেকে ৭%-এ নেমে আসে। রেলওয়ে খাতে বর্তমানের সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিক সেবা বেসরকারীকরণের উদ্যোগ অব্যাহত আছে। এর ফলে রেলওয়ের অধিকতর আর্থিক স্বয়ংনির্ভরতা অর্জন সম্ভব হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে এমন অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে আছে উন্নততর প্রযুক্তি সংযোজন, নতুন রেললাইন স্থাপন, কর্মচারীর সংখ্যা হ্রাস করা, লোকসানি শাখা লাইনসমূহ বন্ধ করন এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন জমির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা। সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম এই দুই শহরে যানজট নিরসনে গণপরিবহণ মাধ্যম হিসেবে রেল পরিবহণকে ব্যবহারের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছে।

দৈনন্দিন বাণিজ্যিক পরিবহণের প্রয়োজনে বাংলাদেশ রেলওয়ের ওপর দিয়ে ভারতে রেলগাড়ি যাওয়া-আসা করে এবং মাঝে-মধ্যে ভারত হয়ে নেপালেও যায়। এসকাপ-এর (ESCAP) উদ্যোগে প্রবর্তিত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের মাধ্যমে আন্তঃমহাদেশ সরাসরি যোগাযোগের অংশ হিসাবে বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন করার পরিকল্পনা চলছে। এই প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়াকে পশ্চিম-এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে। এতে আন্তঃমহাদেশীয় কন্টেইনার পরিবহণসহ মূল্যবান মালপত্র পরিবহণের সুবিধা ও পর্যটনের সুযোগ বৃদ্ধি সম্ভবনা আছে। ক্রমান্বয়ে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে আরও সম্প্রসারিত হয়ে নতুন নতুন আঞ্চলিক রুট স্থাপিত হবে, যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। [কাজী আবুল ফিদা]