রূপজালাল

রূপজালাল  নওয়াব ফয়জুননেসা (১৮৩৪-১৯০৩)-র গদ্য ও পদ্য ছন্দে রচিত (১৮৩৪-১৯০৩) আত্মজীবনী ও কল্পকাহিনীমূলক একটি গ্রন্থ। এটি ১৮৭৬ সালে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এটি সম্ভবত বাংলার একজন মুসলিম মহিলা কর্তৃক প্রথম রচিত একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম।

ফয়জুন্নেসার নিজের একটি লাইব্রেরি ছিল। সেখানে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য ও ধর্মবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করতেন। তাঁর স্বোপার্জিত জ্ঞানের প্রতিফলন লক্ষ করা যায় উক্ত প্রতীকাশ্রয়ী গ্রন্থটিতে। পুথি ও জারিগানের মিশ্র ধারায় লিখিত এ গ্রন্থটি শুরু হয়েছে আল্লাহর প্রশংসা এবং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। সমকালীন বাংলায় মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ফয়জুন্নেসা তাঁর লেখায় অনেক আরবি, ফার্সি ও উর্দু শব্দ ব্যবহার করেছেন।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা কেবল সাহিত্য রচনায় সীমাবদ্ধ থাকেননি, নারী শিক্ষার প্রতিও তিনি যত্নশীল ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি নারী সমাজের জন্য স্কুল, মাদ্রাসা, বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র এবং নানাবিধ দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সামাজিক ও জনসেবামূলক কর্মকান্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৮৮৯ সালে তিনি রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছ থেকে সম্মানসূচক নওয়াব উপাধি লাভ করেন। ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম এ উপাধিতে ভূষিত হন।

সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে ফয়জুন্নেসার কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও রূপজালাল গ্রন্থকার হিসেবে তিনি সমধিক পরিচিত। এটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম। সিপাহী যুদ্ধোত্তরকালে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম সমাজ নানাভাবে অধিকার বঞ্চিত হন। এ গ্রন্থে একজন মুসলিম বীরপুরুষ চরিত্রের রূপদানের মাধ্যমে ফয়জুন্নেসা তাঁর সময়ের মুসলিম সমাজকে হতাশা ও নৈরাশ্য থেকে মুক্ত করে আশা ও  প্রেরণা জোগাতে প্রয়াসী হন।

গ্রন্থটি মূলত রাজপুত্র জালালের দেহজ বাসনা এবং বীরত্বসূচক মানসিকতার বিবরণ। সেসঙ্গে রূপবানো এবং হুরবানোর সঙ্গে জালালের বিবাহবিষয়ক আলাপ-আলোচনা। এ দিক বিবেচনায় গ্রন্থটি নারীর নিষ্কণ্টক যৌনকর্ম, যৌন স্বাধীনতা এবং যৌন আনন্দের একটি অসাধারণ শিল্প আখ্যান। তাছাড়া এটাকে পাশ্চাত্যের মুসলিম সমাজ নিয়ে পাশ্চাত্যে রচিত সাহিত্যের একটি প্রতিবাদ হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়। তৎকালীন পাশ্চাত্যের সাহিত্যকর্মে মুসলিম পুরুষদের পুরুষত্বহীন, ভীতু ও কাপুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। আর মুসলিম নারীদের চিত্রায়িত করা হতো পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান বীরদের লালায়িত রমণী হিসেবে। এর প্রতিবাদস্বরূপ এ গ্রন্থটিতে ফয়জুন্নেসা মুসলিম নারীদের স্বপ্ন-পুরুষরূপে পৌরুষদীপ্ত একজন সাহসী মুসলিম পুরুষের বর্ণনা দিয়েছেন।

গ্রন্থটির আরো একটি বিষয় বহুবিবাহ। রূপজালাল-এর ভূমিকায় ফয়জুন্নেসা উল্লেখ করেন, তাঁর নিজের বৈবাহিক জীবনের দুঃখ লাঘব করার আকাঙ্ক্ষা থেকে গ্রন্থটি রচিত হয়। তাঁর স্বামী মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী নাজমুন্নেসার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো ছিল না। এটা বহুবিবাহের কারণ। রূপজালাল-এ কাহিনির ক্রমবিকাশের ধারায় বহুবিবাহের প্রতি ফয়জুন্নেসার একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। ফয়জুন্নেসা দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে থাকার চেয়ে একাকী থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। যদিও হুরবানু নির্দ্বিধায় তাঁর স্বামী জালালের প্রথম স্ত্রী রূপবানুকে মেনে নিয়েছেন। ফয়জুন্নেসার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না, কিন্তু রূপজালাল এ তিনি জালাল ও তাঁর দুই স্ত্রীর বিবাহিত জীবনের একটি সুখকর ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। রাজপুত্র জালাল রূপবানু ও হুরবানুর প্রতি সমান দৃষ্টি দিয়েছেন এবং দুই স্ত্রীকে তিনি স্বতন্ত্র জায়গায় রেখে সুখের জীবন প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করেছেন।

মোহাম্মদ গাজী ফয়জুন্নেসাকে তাঁর প্রথম স্ত্রী নাজমুন্নেসার সঙ্গে একই বাড়িতে জীবনযাপনে বাধ্য করে ফয়জুন্নেসার সঙ্গে তাঁর বিবাহের চুক্তি লঙ্ঘন করেন। এর প্রতিশোধ হিসেবে ফয়জুন্নেসা তাঁর স্বামীর নীতিবিরুদ্ধ বহু বিবাহের সমালোচনা করেন। তবে বহুবিবাহের অনিবার্যতায় ইসলাম যেসব শর্ত পূরণের নির্দেশ দিয়েছে তিনি তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ফয়জুন্নেসা এ গ্রন্থে নারীর অধিকারচেতনা ও বহুবিবাহবিষয়ক আলোচনার পাশাপাশি নারীর আত্মমর্যাদার বিষয়টিও তুলে ধরেন। রাজা যমযম তাঁর কন্যা নূরবানুকে হত্যা করেন কারণ নূরবানু অন্য পুরুষের যৌনদৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ফয়জুন্নেসা একজন প্রতিবাদী রাণী চরিত্র চিত্রায়িত করে এ রীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। রূপজালাল গ্রন্থটি নারীদের প্রতি সমাজের প্রচলিত ধারণার একটি অসাধারণ প্রতিবাদস্বরূপ। [মোঃ মাহমুদুল হাসান]

গ্রন্থপঞ্জি Amin, Sonia Nishat (1996), The World of Muslim Women in Colonial Bengal, 1876-1939. Leiden: Brill; Hasanat, Fayeza S. (2009). Nawab Faizunnesa’s Rupjalal. Leiden: brill.