রীট পিটিশন

রীট পিটিশন  যেকোন কর্তৃপক্ষ বা নিম্ন আদালতের বিধি বহির্ভুত বেআইনী কর্মকান্ডের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উচ্চ আদালতের একটি আইনী হাতিয়ার হলো রীট পিটিশন। পাঁচ ধরনের রীট আপীল বা আবেদনপত্রের বিধান রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: তলবীপত্র, হেবিয়াস কর্পাস বা কারণ দর্শানোর আবেদনপত্র, ম্যান্ডামাস বা হুকুমনামা, নিষেধাজ্ঞা এবং গ্রেফতারের বা ডিক্রি জারির পরোয়ানা। রীট পিটিশন প্রয়োগ প্রথম চালু হয় ইংল্যান্ডে। আবেদনের প্রেক্ষিতে রীট আদেশ প্রদান করতেন রাজসভার বিচারকরা এবং এটি ছিল রাজার পক্ষ থেকে ঐ আদালতের বা রাজসভার বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০২নং অনুচ্ছেদে রীট পিটিশনের বিধান রয়েছে এবং তার নিশ্চয়তাও বিধান করা হয়েছে। সেখানে অবশ্য রীটসমূহ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে পৃথক কোনো বর্ণনা নেই। ১০২ অনুচ্ছেদের ১নং উপ-অনুচ্ছেদের ধারা (ক) তে নিষেধাজ্ঞা ও নিম্ন আদালতের প্রতি হুকুমনামা জারির মতো রীট পিটিশনের বিধানের কথা বর্ণিত রয়েছে। একই অনুচ্ছেদের ধারা (ক)-এর ২ক ধারায় তলবপত্র আপীলের বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১০২-এর উপ অনুচ্ছেদের খ ধারার ১নং উপধারায় বন্দীত্বের কারণ প্রদর্শনে রীট পিটিশনের বিধান উল্লেখ করা হয়েছে এবং একই ধারার ২ উপধারায় সমন জারির বিরূদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা সম্পর্কিত রীট আবেদনের বিধান দেওয়া হয়েছে।

তলবীপত্র   বলতে কোনো নিম্ন আদালত বা ট্রাইব্যুনালের প্রতিবিধান ব্যবস্থা তদন্তের মাধ্যমে উচ্চ আদালত কর্তৃক সুপারিশ প্রদান বোঝায়। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ বিচারকার্যের বৈধতা বা অন্য যেকোন প্রতিবিধান পরখ করার জন্য যেকোন প্রতিপক্ষ বা আদালতকে, এমনকি ট্রাইব্যুনালে সম্পাদিত বিচারকার্য বা স্থগিত বিচারকার্যের নথিপত্র তলব করতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০২নং অনুচ্ছেদের ক-ধারার ২ উপধারায় এ ধরনের ব্যবস্থাকে শুধু আইনগত বৈধতাই দেওয়া হয়নি, আইনেও পরিণত করা হয়েছে। এতে যেকোন ব্যক্তির প্রজাতন্ত্রের কোনো বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত বা স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যুক্ত যেকোন  ঘটনা সম্পর্কে আইনগত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের বিধান লঙ্ঘিত হলে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ উল্লেখিত আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। ২নং উপধারায় বর্ণিত প্রতিবিধান তলবনামা বা রীট পিটিশনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তলবনামা রীটের ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালত যখন কোনো নিম্নতর আদালত বা ট্রাইব্যুনাল তার আওতার বহির্ভুত বা তার বিদ্যমান আওতার অতিরিক্ত কোনো তৎপরতা ঘটায় অথবা যেসব ক্ষেত্রে নিম্ন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল তার আওতাধীন ক্ষেত্রে বিচার সম্পাদনে ব্যর্থ হয় সেসব ক্ষেত্রে তলবনামা রীট আবেদন প্রযোজ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পক্ষগুলোর মধ্যে শুনানী অনুষ্ঠানের সুযোগ না দিয়ে বিচারের স্বাভাবিক নীতি উপেক্ষা বলে বা এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়ায় বিষয় সম্পর্কে রেকর্ডভুক্ত করার ক্ষেত্রে ভ্রান্ত ধারনার সৃষ্টি করা হলে সেক্ষেত্রে তলবী আপীল প্রযোজ্য হয়। সংবিধানের ১০২নং অনুচ্ছেদের ক ধারার ২নং উপধারায় এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে বহির্ভুত উভয় ধরনের ব্যক্তি বা কতৃপক্ষের জন্য প্রযোজ্য অর্থে বিচারের আওতাভুক্ত হাইকোর্ট বিভাগকে এরূপ ঘোষণা দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

হেবিয়াস কর্পাস  বলতে সশরীরে বন্দীর প্রদর্শনকে বোঝায়। ইংল্যান্ডে এই রীট আবেদনের প্রয়োগ বেশি দেখা যায়। ১৬৪০ সালে বন্দী প্রদর্শন সংক্রান্ত একটি আইন পাশের পর থেকে সরকারি বা বেসরকারি বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কোনো পক্ষ তার অবৈধ আটকাদেশের বিরুদ্ধে এই রীট আবেদন দাখিল করতে পারেন। কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে আটক করা হয়েছে কিনা সেই বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য রাজকীয় বেঞ্চ থেকে হেবিয়াস কর্পাস ইস্যু করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ২ উপ-অনুচ্ছেদের খ ধারার ১নং উপধারার আওতায় হাইকোর্ট বিভাগ কোনো আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ ব্যক্তিকে আইনানুগভাবে বা আইন বহির্ভুতভাবে আটক করা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আদালতকে সন্তুষ্ট করার জন্য হাইকোর্ট ঐ আটককৃত ব্যক্তিকে আদালতের সামনে সশরীরে হাজির করানোর আদেশ দিয়ে থাকে। যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে কর্তৃপক্ষ ঐ ব্যক্তিকে আইন বহির্ভূতভাবে আটক করে রেখেছে তবে আদালত ঐ আটকাদেশকে আইন বহির্ভুত বলে ঘোষণা করতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯১ ধারাতেও হাইকোর্ট বিভাগকে হেবিয়াস কর্পাস প্রকৃতির রীট আবেদনের ক্ষেত্রে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ঐ নির্দেশে সরকারি বা বেসরকারি হাজতে আটক ব্যক্তিকে আইন বহির্ভুত বা অবৈধভাবে আটক করা হয়েছে কিনা সে ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণের জন্য আটককৃত ব্যক্তিকে হাইকোর্টের সামনে সশরীরে হাজির করানোর কথা বলা হয়েছে। যদি হাইকোর্টের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, এ ধরনের কোনো ব্যক্তি হাজতে আইন বহির্ভূত বা অবৈধভাবে আটক আছেন তাহলে হাইকোর্ট আটককারী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে ঐ আটককৃত ব্যক্তিকে মুক্তিদানের নির্দেশ দিতে পারেন।

ম্যান্ডামাস  বলতে উচ্চ আদালত কর্তৃক নিম্ন আদালতের উপর হুকুমনামাকে বোঝায়। এ জাতীয় রীট আবেদনের মাধ্যমে উচ্চ আদালত যেকোন ব্যক্তি, কর্পোরেশন, নিম্ন আদালত বা সরকারকে কোনো কিছু করতে বা তাতে সু-নির্দিষ্ট ভাবে কোনো কিছু উল্লেখ করার নির্দেশ দিতে পারেন যা ঐ ব্যক্তি, তাদের অফিস-এর অধিকারভুক্ত এবং যা সরকারি দায়িত্ব পালনের মতো। যখন নিম্ন আদালত বা ট্রাইবুনাল তার এখতিয়ারভুক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে অথবা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ যখন আইনত যা করা প্রয়োজন তা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তখন এ জাতীয় আবেদন ইস্যু করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১০২নং অনুচ্ছেদের ২নং উপ-অনুচ্ছেদের ক ধারার ১নং উপধারায় হাইকোর্ট বিভাগকে প্রজাতন্ত্র বিষয়ক কার্যক্রমের সংগে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পাদন করতে কোনো ব্যক্তি বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আইনে বর্ণিত আবশ্যকীয় বিধানবলী অনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয় না। রীট আবেদনকারীকে অবশ্য প্রমাণ করতে হবে যে, যে ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রীট আবেদন করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বৈধ অধিকার রয়েছে।

প্রহিবিশন  বা নিষেধাজ্ঞা বলতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকা বোঝায়। অন্য কথায়, রীট আবেদন বলতে উচ্চ আদালত কর্তৃক নিম্ন আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা  প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে আইন বহির্ভূত কোনো ক্ষমতা অনুযায়ী কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকা বোঝায়। নিষেধাজ্ঞা একটি নিবৃত্তিমূলক রীট আবেদন এবং কোনো ব্যক্তিকে আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য এখতিয়ারভুক্ত ক্ষমতার অবৈধ ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ইস্যু করা হয়ে থাকে। সংবিধানের ১০২নং অনুচ্ছেদের ২নং উপ অনুচ্ছেদের ক ধারার ১নং উপ ধারায় হাইকোর্ট বিভাগকে প্রজাতন্ত্র বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সম্পর্কিত কোনো কার্যক্রম যা আইনে বর্ণিত বিধানাবলির আলোকে স্বীকৃত নয় তা থেকে বিরত থাকার জন্য হাইকোর্টকে এ রীট আবেদনের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

কো ওয়ারেন্টো  কোনো ধরনের সমন বা ক্ষমতা বোঝায়। এ ধরনের রীট আবেদন অবৈধ দখল অথবা কোনো সরকারি অফিস জবর দখল অথবা তা ভোগ করা অথবা তা অবমুক্ত করার জন্য ইস্যু করা হয়ে থাকে। এ ধরনের রীট আবেদন আবেদনকারীর বৈধতার তদন্তের সুযোগ সৃষ্টি করে। এর ফলে অবৈধ দখলদার কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অবৈধভাবে দখল করা অফিস বা তার ভোগ দখল এবং তার থেকে তাকে উচ্ছেদ করার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তবে অবৈধভাবে দখল করা ঐ অফিসের প্রকৃত মালিককে আদালতে কোন ক্ষমতাবলে তিনি ঐ অফিসটির মালিক তা প্রমাণ করতে হবে। সংবিধানের ১০২নং অনুচ্ছেদের ২নং উপ অনুচ্ছেদের খ ধারার ২নং উপধারায় হাইকোর্টকে উল্লেখিত বিষয়ে প্রতিকারের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা বা ডিক্রি জারি সংক্রান্ত রীট আবেদন ইস্যু করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।  [কাজী এবাদুল হক]