রিপন, লর্ড

রিপন, লর্ড (১৮২৭- ১৯০৯)  ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় (১৮৮০-৮৪)। ভারতে আসার পূর্বে জর্জ ফ্রেডারিক স্যামুয়েল (আর্ল অব রিপন) ১৮৫২ সাল হতে ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। পার্লামেন্টে থাকাকালে তিনি আন্ডার সেক্রেটারি ফর ওয়ার (১৮৫৯-১৮৬১), আন্ডার সেক্রেটারি ফর ইন্ডিয়া (১৮৬১-১৮৬৩), সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ওয়ার (১৮৬৩-১৮৬৬), সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া (১৮৬৬), লর্ড প্রেসিডেন্ট অব দি কাউন্সিল (১৮৬৮-১৮৭৩) প্রভৃতি পদ অলঙ্কৃত করেন। ১৮৭১ সালে তিনি মার্কুইস মর্যাদা লাভ করেন।

লর্ড রিপন

পার্লামেন্টে গ্ল্যাডস্টোন-এর লিবারেল পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় ব্রিটেনে সরকার পরিবর্তন হয় এবং এর ফলে ভারতের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদেও অনুরূপ পরিবর্তন আসে। ইন্ডিয়া অফিসে দুবার উচ্চ পদে দায়িত্ব পালনকারী লর্ড রিপনকে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় পদে নিযুক্ত করা হয়।

উদারনৈতিকদের মধ্যে চরম উদার লর্ড রিপন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার (৮ জুন ১৮৮০) পর পরই তাঁর সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যপৃত হন। তাঁর সর্বপ্রথম পদক্ষেপ ছিল দীর্ঘস্থায়ী অ্যাংলো-আফগান শক্রতার অবসান ঘটানো। তিনি নতুন আফগান আমীর আব্দুর রহমানের সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেন। ভারত সরকার থেকে একটি বার্ষিক অনুদানের বিনিময়ে নতুন আমীর ভারত সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে তার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করতে সম্মত হন।

স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে লর্ড রিপন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ১৮৮২ সালে তিনি সরকারিভাবে মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত স্থানীয় সরকারের চলমান প্রথা রহিত করেন।

তাঁর ঘোষণা মতে, তাঁর সংস্কার জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করে। অধিকতর দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা অনুযায়ী বিশাল লোকাল বোর্ডসমূহ ভেঙ্গে ছোট ছোট এলাকায় পরিণত করা হয়। স্থানীয় বিষয়সমূহের ব্যবস্থাপনায় জনগণের  অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রচলিত মনোনয়ন প্রথার পরিবর্তে নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থায় বৃটিশ ভারতের আমলাদের আপত্তি ছিল, কেননা এরাঁ মনে করতেন যে স্থানীয় পর্যায়ে ভারতীয়রা নির্বাচন প্রথার জন্য প্রস্ত্তত নয়। এদের বিরোধিতার কারণে রিপন তাঁর আকাঙ্খা অনুযায়ী নির্বাচনী আদর্শসমূহ বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। গ্রামীণ এবং শহুরে স্থানীয় কমিটিসমূহে নির্বাচিত সদস্যদের সঙ্গে মনোনীত সদস্যরাও থেকে যান। রিপনের কৃতিত্ব এই যে, তিনি গ্রামীণ বোর্ডসমূহের জন্য সর্ব প্রথম নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন।

যদিও রিপনের প্রত্যাবর্তনের পর ১৮৮৫ সালের বিখ্যাত বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন গৃহীত হয়, তথাপি এটি ছিল ইতিপূর্বে তাঁরই নিযুক্ত রেন্ট কমিশনের সুফল। দীর্ঘদিন ধরে বাংলার রায়তশ্রেণি জমিদার ও তালুকদারদের নিপীড়নমূলক রাজস্ব আদায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিল। কৃষিবিষয়ক সমস্যাসমূহ পর্যালোচনা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে যথোপযুক্ত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য রেন্ট কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ কমিশনের প্রতিবেদনের ফলশ্রুতি হিসেবে প্রজাদের অধিকার ও দায়িত্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে  আলোচনা পর্যালোচনা হয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৮৮৫ সালে ‘বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন’ প্রণীত হয়। ফলে রায়তগণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হারানো অধিকারসমূহ অনেকাংশে ফিরে পায়।

শিক্ষা ছিল রিপনের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়। গ্ল্যাডস্টোনের উদার সরকারে লর্ড প্রেসিডেন্ট অব দি কাউন্সিল  হিসেবে রিপন শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করেছিলেন। বড় লাট হিসেবে রিপন শিক্ষা, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি WW Hunter-এর নেতৃত্বে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যাসমূহ নির্ণয় করার জন্য ‘ইন্ডিয়ান এ্যাডুকেশন কমিশন’ নামে কমিটি গঠন করেন। হান্টার কমিশন নামে বহুল পরিচিত এ কমিশনের সুপারিশসমূহের ভিত্তিতে প্রাথমিক ও কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব প্রদান করে একটি নতুন শিক্ষানীতি গৃহীত হয়।

চরম বিতর্কিত ‘ইলবার্ট বিল’ এর জন্য রিপনের প্রশাসন বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এদেশে বসবাসকারী ইউরোপীয়দের ওপর স্থানীয় বিচারকদের আইনগত অধিকারের প্রশ্নে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ইউরোপীয়দের ওপর দেশীয় বিচারকদের কোন বিচারিক এখতিয়ার ছিলনা।  আইন সদস্য স্যার কুর্টনি ইলবার্ট শ্বেতাঙ্গদের এই বিশেষ ক্ষমতা  বাতিল এবং স্থানীয় ও অপরাপর সকল প্রজাদের আইনের চোখে সমতা প্রদান করে একটি আইন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় এ প্রস্তাব প্রতিরোধকল্পে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং এর মৌলিক চেতনা ও ধারায় উল্লেখযোগ্য সংশোধনী সন্নিবেশিত করে বিলটি পাস করতে সরকারকে বাধ্য করে।

১৮৮২ সালে রিপন ১৮৭৮ সালের বিতর্কিত ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট বাতিল করলে তাঁর উদারনীতি পুনরায় বাঁধার সম্মুখীন হয়। এই অ্যাক্ট দ্বারা ভারতীয় সংবাদপত্রসমূহের সম্পাদকগণ সরকারবিরোধী কোন বিষয় প্রকাশ করবেন না বলে মুচলেকা দিতে অথবা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ছাপার পূর্বে প্রুফশিট জমা দিতে বাধ্য ছিলেন। ভারতীয় সংবাদপত্র তাঁর পদক্ষেপে জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করে, কিন্তু ভারতীয় সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা প্রদানের বিষয়ে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র ও সম্প্রদায় বিরোধিতা করে। বর্ণ বৈষম্য প্রদর্শন না করে সকল সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা প্রদানের ব্যপারে রিপনের আদর্শ শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়।

১৮৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রিপন ভারত ত্যাগ করেন। রিপনের পূর্বে বা পরে আর কোন গভর্ণর জেনারেল ভারতীয়দের নিকট তাঁর মতো জনপ্রিয় ছিলেন বলে মনে হয় না এবং বিপরীতভাবে সম্ভবত অপর কোন বড় গভর্ণর জেনারেল রিপনের মতো অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের নিকট এতটা ঘৃণিত ছিলেন না।  [সিরাজুল ইসলাম]