রাষ্ট্র ও ধর্ম
রাষ্ট্র ও ধর্ম বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এটি ছিল আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক। এমন কি ব্রিটিশ শাসকগণ যারা লোকদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না, তারাও এদেশের ধর্মীয় অনুভূতিকে মান্য করতেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র মুসলমানদের বাসভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও তা অন্যান্য ধর্মালম্বীদের জীবনযাত্রার উপর হস্তক্ষেপ সমীচীন বিবেচনা করেনি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বত্রই এদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মের সুস্পষ্ট প্রাধান্য দেখা যায়। প্রাচীনকালে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মগুরুরা সাধারণত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করত। শাসকগণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও যাজকশ্রেণীকে ভূমি, অর্থ বা সম্পত্তি, বৃত্তি ইত্যাদির মাধ্যমে সাহায্য প্রদানকে তাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন। স্বাভাবিক কারণেই শাসকগণ নিজ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত দেখাতেন এবং রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের অভাবে অন্যান্য ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেত। গুপ্ত শাসকরা ব্রাহ্মণ থাকার সুবাদে তাদের শাসনামলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার ঘটে। কিন্তু পাল আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পতন ঘটতে থাকে, কেন না পাল শাসকরা ছিলেন তান্ত্রিক বৌদ্ধ। পাল আমলেই বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহারগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। সেন রাজাদের সময় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটে। এ সময় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে এবং ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে দৃশ্যত অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন কখনও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার ছিল না, কেননা এ পরিবর্তনে তৃণমূল পর্যায়ে বা সমাজের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটত না। বিদ্যমান ধর্মগুলোর মূল কাঠামো এবং জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই দেবদেবীদের উত্থান-পতন ঘটেছে। এমনকি একটি জনমতও প্রচলিত ছিল যে সঙ্গত কারণেই যুগে যুগে ধর্মের পরিবর্তন ঘটেছে। অন্যকথায়, বেদ অনুসারী সত্যযুগে ধর্মের যে রূপ ছিল, ত্রেতাযুগে (রামায়ণ যুগে) ও দাপর যুগে (মহাভারতের যুগে) সেসব রূপের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এসব যুগে কোনো সময় ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে কোনো বিরোধ বা উত্তেজনা দেখা যায় নি।
‘হিন্দু’ শব্দটির প্রচলন শুরু হয় সিন্ধু অঞ্চলে আরব শাসন এবং পরবর্তীকালে বাংলাসহ উত্তর ভারতে তুর্কি-আফগান শাসন প্রতিষ্ঠার পর। মুসলিম শাসকগণ এখানকার স্থানীয় নাম ‘হিন্দ’ ভিত্তিতে হিন্দুস্থানের অধিবাসীদের মুসলমানদের বিপরীতে হিন্দু বলে অভিহিত করতে থাকেন। রাজনৈতিকভাবে এখানকার অধিবাসীদের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, তান্ত্রিক, শৈব ইত্যাদি পূর্বপরিচয় কালক্রমে অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। এরা সবাই হিন্দুধর্ম নামে একটি বৃহৎ ধর্মীয় গন্ডির মধ্যে একীভূত হয়ে যায়। এভাবে ভারতীয়রা সমষ্টিগতভাবে একটি সাধারণ ধর্মীয় নাম লাভ করে। ভারতীয় অভিজাত শ্রেণি খুব দ্রুত এ নামের তাৎপর্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয় এবং তারা এটি সানন্দে গ্রহণ করে। ‘হিন্দু’ নামটি তাদের জন্য ছিল একটি নতুন পরিচিতি।
সম্ভবত মুসলিম শাসকগণ রাষ্ট্রশাসনের কোনো বাস্তব সমস্যার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই সকল ভারতবাসীকে একটিমাত্র ধর্মীয় নামে অর্থাৎ হিন্দু বলে অভিহিত করেন। তেরো শতকের প্রথমভাগে দেশীয় শাসকদের বিতাড়িত করে অভিজাত তুর্কি-আফগান শাসকশ্রেণী যে-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তাকে তারা মুসলিম রাজ্য বলেই মনে করতেন, যদিও তারা ছিলেন একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। তারা বুঝতে পারেন যে একটি অমুসলিম সমাজকে ইসলামি অনুশাসনে শাসন করতে গেলে অবশ্যই বাধার সম্মুখীন হতে হবে। এ কঠিন বাস্তবতার কারণে মুসলিম শাসকগণ রাষ্ট্রশাসনের জন্য দুই ধরনের আইনের প্রবর্তন করেন, একটি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য, অন্যটি হিন্দুদের জন্য। প্রথাগতভাবে মুসলমান ব্যতীত অন্য সবাইকে হিন্দু হিসেবে গণ্য করা হতো। হিন্দুরা হিন্দু আইন এবং মুসলমানরা মুসলিম আইন দ্বারা শাসিত হতো।
অতএব তুর্কি-আফগান শাসন হিন্দুপ্রথার কোন আপদ হয়ে ওঠে নি। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল মূলত শাসকের পরিবর্তন, ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন নয়। এ শাসনব্যবস্থায় অভিজাত সমাজের কাঠামোতেও কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে নি। ভূমি ও দেশের অন্যান্য সম্পদের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সব সময়েই অক্ষুণ্ণ থেকেছে। স্থানীয় প্রশাসন এদের হাতেই পুরোপুরি ন্যস্ত ছিল। পূর্ববর্তী শাসকদের কাছ থেকে ধর্মীয় সংগঠন এবং শিক্ষা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ যেসব সুযোগ-সুবিধা ও বিশেষ অধিকার ভোগ করত, পরবর্তীকালেও তা অব্যাহত থেকেছে। মুসলিম রাষ্ট্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল, কিন্তু অমুসলিম নাগরিকগণ জিজিয়া নামে কর প্রদানের বিনিময়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ থেকে অব্যাহতি লাভ করত। তবে তুর্কি-আফগান শাসকেরা অনেকগুলো যুদ্ধে লিপ্ত হলেও তারা হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর আরোপ থেকে বিরত থাকেন।
সুলতানগণ তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন পদ ও অবস্থানের নামের পরিবর্তন করলেও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো ও কার্যক্রমের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটান নি। তারা স্থানীয় হিন্দু অভিজাত শ্রেণিকে অংশীদারিত্ব প্রদান করে এবং মহাপাত্রাধিপাত্র ইত্যাদি বিভিন্ন উচ্চ উপাধিতে ভূষিত করেন। এছাড়া সুলতানি শাসকগণ স্থানীয় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান এবং কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি সাধনের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করতেন। সুলতান খলিলুলাহ্ বা আল্লাহর প্রতিনিধি উপাধি ধারণ করলেও তিনি নিজেকে হিন্দু প্রতিষ্ঠানসমূহের পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও বিবেচনা করতেন। প্রাক-মুগল শাসনামলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মৈত্রী ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। কোরআন ও সুন্নাহ্র নিয়মনীতি এবং পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্রের বিধানসমূহ পাশাপাশি সুসামঞ্জস্যভাবে কার্যকর ছিল।
মুগলদের অনুসৃত ধর্মীয় নিরপেক্ষতার দরুন মুগল বাংলায় রাষ্ট্র ও ধর্মের পরিস্থিতি অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ রূপ পরিগ্রহ করে। মুগল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় হিন্দু অভিজাত শ্রেণি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের এই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ হিন্দু অভিজাত শ্রেণি রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। সুলতানদের মতো মুগল শাসকরাও হিন্দু ও মুসলিম আইন দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। রাষ্ট্র তখন ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের লোকের প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করত।
মুগল শাসনামলে বাংলায় ব্যাপক ইরানি অভিবাসন ঘটে। এসব অভিবাসীদের মধ্যে সুফি সাধকরাও ছিলেন এবং তাঁদের অনেকেই বাংলার গ্রামাঞ্চলে বসবাস ও বাঙালিদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। বলা যায়, বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রসার সুফিদের এক অনন্য অর্জন। ইসলাম প্রচারে সুফিরা একটি সমন্বয়বাদী রীতি অনুসরণ করেন। তারা সুফীবাদী ইসলামের সঙ্গে স্থানীয় পুরাকথা ও আচার-অনুষ্ঠানের সংমিশ্রণ ঘটান। উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে তারা ইসলামের মূলসূত্রগুলো অনুপুঙ্খ অনুসরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেননি এবং স্থানীয় ধর্মাচরণের মধ্যেও সদ্গুণ খুঁজে পান। সুফিদের খানকাগুলো মুসলিম ও অমুসলিম সকল ধর্মানুরাগীদের আকৃষ্ট করে। অনেক অমুসলিমের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার ব্যাপারটি অবশিষ্ট স্বধর্মীদের মধ্যে বিশেষ কোনো বিক্ষোভ সৃষ্টি করত না, কারণ এর ফলে প্রচলিত জীবনযাত্রায় বৈষয়িক কোনো পরিবর্তন ঘটত না।
মুগল প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছিল রাজস্ব বিভাগ। রাজস্ব সংগ্রহের জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল জমিদারি ব্যবস্থা। জমিদাররা রাষ্ট্রের পক্ষে খাজনা আদায় করতেন এবং গ্রামীণ জনগণের পক্ষে স্থানীয় সমস্যাগুলো সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করতেন। তারা রাষ্ট্র ও জনগণ উভয়েরই প্রতিনিধি ছিলেন। মুগল সরকার হিন্দু অভিজাত শ্রেণির মধ্য থেকেই অধিকাংশ জমিদার নিয়োগ করেন। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে নবাবি আমলে গ্রামাঞ্চলে হিন্দু জমিদারদেরই প্রাধান্য ছিল। মুগলরা হিন্দু অভিজাতদের মধ্য থেকেই অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় আমলা এবং মুৎসুদ্দি (সরকারি কর্মকর্তা) নিয়োগ করতেন। ব্যাঙ্কিংসহ গোটা ব্যবসা ও বাণিজ্য হিন্দুদের একচেটিয়া দখলে চলে আসে। এগুলো ছিল রাষ্ট্রপরিচালনায় সমন্বয়বিধান ও অংশীদারিত্বের মুগল নীতির ইঙ্গিতবহ।
প্রশাসনিক ও সামাজিক জীবনে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই অভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতো। হিন্দু মুসলমান যে তখনও সাম্প্রদায়িক আচরণের দিকে ঝুঁকে পড়েননি তার প্রমাণ হলো পলাশীর যুদ্ধসহ মুর্শিদাবাদের সকল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে হিন্দু ও মুসলমান আমীররা দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থেই বিভক্ত হন, ধর্মবিশ্বাসে নয়। সেসময় অনেক হিন্দু নেতা সিরাজউদ্দৌলাহ্কে সমর্থন দিয়েছিলেন, অপরদিকে অনেক মুসলমান নেতাও সিরাজউদ্দৌলাহ্র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে শরিক হয়েছিলেন।
আঠারো শতকের শেষভাগে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের শুরুতে রাষ্ট্র ও ধর্ম এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। এ সময়ে কোম্পানি সরকার পূর্ববর্তী সরকারের নীতিমালা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। কোম্পানির কর্মকর্তা নিজেরা ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান হলেও এবং কলকাতা ফোর্ট উইলয়ামে এবং সমুদ্রে তাদের জাহাজগুলোতে উপাসনাস্থল থাকলেও ভারতে ধর্মপ্রচারের কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল বলে মনে হয় না। কোম্পানীর শাসনাধীন এলাকায় কোনো মিশনারীকে প্রবেশ ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অনুমতি দেওয়া হতো না। কেরী ও ওয়ার্ড শ্রীরামপুরের দিনেমার বসতি থেকে ধর্মপ্রচার চালাতেন। হিন্দুধর্ম অথবা ইসলাম সম্পর্কে কোম্পানি ছিল সম্পূর্ণ নিস্পৃহ। ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত কোম্পানির কর্মকর্তাগণ হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবেই যোগদান করতেন। কিন্তু কর্নওয়ালিসের প্রশাসন কোম্পানির কর্মকর্তাদের এসব অনুষ্ঠানে যোগদান এজন্য নিষিদ্ধ করে যে এসব অনুষ্ঠান ছিল কোম্পানির কর্মকর্তাদের দুর্নীতির উৎস কেননা তারা আমন্ত্রণকারীদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে নগদ অর্থ বা দ্রব্যসামগ্রী গ্রহণ করতেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের জন্য ভারতের দ্বার উন্মুক্ত রাখার ব্যাপারে কোম্পানী কখনই খ্রিস্ট্রধর্ম মিশনারীদের কাছে নতি স্বীকার করেনি, লন্ডন থেকে ক্রমবর্ধমান চাপ সত্ত্বেও। কোম্পানির এলাকায় মিশনারিদের গতিবিধির প্রতি সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখা হত এবং ধর্মপ্রচারের কাজে তারা কোনো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লাভ করত না। ১৮৩৩ সাল থেকে মিশনারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি লাভ করে, কিন্তু কখনই রাষ্ট্রীয় সহায়তা পায়নি। তারা যেসব ব্রিটিশ সংস্থা থেকে সাহায্য লাভ করত সেগুলো হলো ব্রিটিশ ও বিদেশি বাইবেল সোসাইটি, ব্যাপটিস্ট্ মিশনারি সোসাইটি, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ও ওয়েসলিয়ান মেথোডিস্ট মিশনারি সোসাইটি।
কিন্তু কোম্পানি সরকারের কিছু কার্যক্রম কোম্পানির ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে স্থানীয়দের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে। ব্যাপকভাবে লাখেরাজ বা রাজস্বহীন জমি দখলের সরকারি নীতি এবং এসব জমি ভোগ দখলকারীদের সরকারকে খাজনা প্রদানে বাধ্যকরণ লাখেরাজদারদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। লাখেরাজ জমি দাবির অনুকুলে তাদের সঠিক দলিলপত্র উপস্থাপন করতে বলা হয় এবং বৈধ কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে তাদের জমি পুনরায় সরকারি দখলে চলে যেত। লাখেরাজদারগণ দাবী করেন যে এসব মঞ্জুরি তারা পূর্ববর্তী সরকারের আমলে আইমা (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা জন্য),পীরোত্তর (মুসলমান সাধকদের দরগাহ্ রক্ষণের জন্য), দেবোত্তর এবং ব্রহ্মোত্তর (মন্দির সংরক্ষণ এবং ব্রাহ্মণ পন্ডিতের ভরণপোষণের জন্য) হিসাবে পেয়েছিলেন। সরকার যেসব লাখেরাজ স্বত্ব বৈধ বিবেচনা করে সেগুলোকে স্বীকৃতি দেয় এবং যেগুলো অবৈধ মনে করে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু অবৈধ স্বত্বের সংখ্যা এত বেশি ছিল এবং স্বত্ব বাতিল করার ফলে এযাবৎ শাসনকার্যে নিয়েজিত ও বিশেষ সুবিধাভোগী পরিবারের সংখ্যা এত বিরাট ছিল যে সরকারের লাখেরাজ সম্পত্তি অধিগ্রহণের নীতি স্থানীয় অভিজাতদের মধ্যে ভীতিসঞ্চার করে। তাদের কাছে এটি ছিল দেশের ধর্মীয় ব্যাপারে একটি বড় ধরনের হস্তক্ষেপ। ১৮২৭ সালের সতীদাহপ্রথা বিলোপ আইন এ সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবনে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থকার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি আবেদন প্রেরণ করা হয়। সিপাহীদের শ্মশ্রুমুন্ডনে, বিদেশযাত্রা এবং ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে এক ভবনে বসবাস ও আহার গ্রহণ এবং উর্দি পরিধানে বাধ্যকরণ ধর্মীয় ব্যপারে হস্তক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়। মিশনারীরা কার্যক্রম, সরকারি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ, রেলপথ নির্মাণ, জাহাজ চলাচল ও টেলিগ্রাফ যোগাযোগ ব্যবস্থা, এদেশীয় স্থানীয়দের পরিবর্তে এককভাবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অসনদী চাকুরিতে নিয়োগ দান এবং আরও অনেক বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করে তারই পরিণতি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ।
কোম্পানির কলকাতা ও লন্ডনস্থ সরকার নিশ্চিত হয়েছিল যে রাষ্ট্র ধর্মের ব্যাপারে কঠোর নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারলে সিপাহী বিদ্রোহের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হতো। উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী অনুধাবন করে যে উপনিবেশিক শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে রাষ্ট্রকে ধর্ম সম্পর্কে অবশ্যই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতের শাসনভার গ্রহণের সময় রানী ভিক্টোরিয়া ঘোষণা করেন, ‘আমরা এটাকে আমাদের রাজকীয় সংকল্প ও আনন্দ বলে ঘোষণা করছি যে ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মাচরণের জন্য কাউকে কোনভাবে আনুকূল্য প্রদর্শন করা হবে না, কাউকে পীড়ন বা উদ্বিগ্ন করা হবে না, সকলেই তা সমানভাবে উপভোগ করবে, আমাদের অধীনস্থ কর্মচারীরা প্রজাদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে, অন্যথা তা হবে খুবই দুঃখজনক ও পরিতাপের ব্যাপার।
কিন্তু উনিশ শতকের সত্তরের পরবর্তী ছয় দশকে একদিকে ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যদিকে জাতীয়তাবাদের উত্থান। এক জটিল ধরনের ধর্মীয় রাজনীতির উদ্ভব ঘটে। জাতীয়তাবাদী পন্ডিতরা মনে করেন যে, কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রতিরোধের জন্য উপনিবেশিক সরকার মুসলমান সম্প্রদায়কে কংগ্রেসের দাবির বিরুদ্ধে একটি বিরোধী শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হয়। সরকারি চাকুরিতে মুসলমানদের জন্য কোটা ব্যবস্থা প্রবর্তন, মুসলমান সম্প্রদায়কে তাদের সাম্প্রদায়িক সমস্যাবলি তুলে ধরার জন্য উৎসাহ যোগান, ১৯০৯ সালের সংস্কার আইনের অধীনে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক নির্বাচকমন্ডলী গঠন এবং সবশেষে ১৯৩৩ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা, এগুলো সবই ছিল মুসলমান সম্প্রদায় এবং অন্যান্য অবহেলিত শ্রেণিসমূহের জন্য কল্যাণকর ব্যবস্থা। কিন্তু জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের নিকট এগুলো ছিল ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতির সুস্পষ্ট সূচক। ১৯১৯ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট প্রবর্তনের পরবর্তী তিন দশকে ধর্ম রাজনীতির প্রধান বিষয় হয়ে উঠে এবং এটা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, ১৯৪৭ সালে দেশটি যখন ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে তখন ব্যাপক রক্ষপাতের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এই বিভাজন ঘটে।
মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের পুরো সময়কালে (১৯৪৭-১৯৭১) ধর্ম ও রাষ্ট্র ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অনেক সমালোচকের দৃষ্টিতে পাকিস্তান ছিল ধর্মরাষ্ট্র। বস্ত্তত ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ও আল্লাহ্কে পাকিস্তানের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ঘোষণা এবং আইন পরিষদের উপর কোরআন ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন বাধ্যতামূলক করা, এগুলোই পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিকতার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ছিল যথেষ্ট উদার। নীতিপ্রণেতারা ইসলামী বিধানের বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না ঘোষণা করলেও বাস্তবে সরাসরি শরীয়া আইন লঙ্ঘন করে প্রায়শই আইন প্রণয়ন করেন। উদাহরণ স্বরূপ ছিল ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ।
পাকিস্তানের বিপরীতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে অনুপ্রেরণা আহরণ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এরূপ ছিল না। বাংলাদেশে সংসদই ছিল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, যা পাকিস্তানে ছিল না। বাংলাদেশের সংসদ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ছিল: বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যার সাথে ধর্মের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর কয়েক বছরের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি ক্রমেই দুর্বল হতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক রাষ্ট্রসংস্থার সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের যোগদান থেকেই এই প্রক্রিয়ার সূচনা। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রথম মৌলিক পরিবর্তন ঘটে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে (১৯৭৭-১৯৮১) যখন বাংলাদেশের সংবিধানে কোরআনের বাণী ‘বিস্মিলাহির রাহ্মানির রাহিম’ সংযোজন এবং সকল রাষ্ট্রীয় কার্যের শুরুতেই এই বাণী পাঠের বিধান চালু হয়। জিয়াউর রহমানের ইসলামী ব্যবস্থাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (১৯৮২-১৯৯০) একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন।
খালেদা জিয়ার প্রশাসনের (১৯৯১-১৯৯৬) বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিহার করে। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা (১৯৯৬-২০০১) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইসলামের পক্ষ সমর্থনের নীতি ঘোষণা করেন। ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ মাদ্রাসা শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর জন্য সরকারি সাহায্য বৃদ্ধি করে। মূলত ইসলাম সমর্থক হলেও বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্প্রদায়িকতাকে সমর্থন করে না এবং ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিরূপভাব প্রদর্শন করে না। [সিরাজুল ইসলাম]