রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান (Public sector enterprise) সরকার প্রতিষ্ঠিত এবং সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, যা নিজের উৎপাদিত পণ্য বা সেবামূলক ব্যবসায় থেকে অর্জিত আয় এবং সরকারি বরাদ্দের অর্থে পরিচালিত। ইংরেজিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে public sector enterprise নামে চিহ্নিত করে সরকারি অন্য দুই ধরনের সংস্থা public institution এবং government institution থেকে পৃথক করা গেলেও এই তিন শ্রেণির প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে বোঝানোর জন্যে বাংলায় যুৎসই কোন নাম নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মূলধনের অধিকাংশ প্রত্যক্ষভাবে সরকারের বা সরকার পরিচালিত কোন সংস্থার মালিকানায় থাকে এবং সরকার তার নিয়োগকৃত বা মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। সাংগঠনিক কাঠামোর দিক থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সাধারণত তিন ধরনের: (ক) বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান (departmental undertaking), (খ) বিধিবদ্ধ কর্পোরেশন এবং (গ) যৌথ মূলধনি (রাষ্ট্রায়ত্ত) কোম্পানি।
বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান সরকারের আইন প্রণয়নকারী সংস্থার বিধান অনুসারে না হয়ে, কোন একটি সরকারি সংস্থার প্রয়োজনে তার নির্বাহী নির্দেশে সৃষ্টি হয়। এ জাতীয় সংস্থার সুনির্দিষ্ট কোন মূলধন কাঠামো বা বাজেট থাকে না। যে সরকারি সংস্থার অধীনে এদের সৃষ্টি করা হয় সেই সংস্থা থেকেই এগুলিকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে তাদেরকে নির্ধারিত দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পাদন করতে বলা হয়। তবে এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্মকর্তা দ্বারাই পরিচালিত এবং এদের আয়-ব্যয় সরকারের বাজেটীয় নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষার অধীন। বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে তার মাধ্যমে সরকার মূলত রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত কার্যাবলি এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে ন্যায্য মূল্যে পৌর সুবিধাদির ও সেবামূলক উপযোগের সরবরাহ সম্পাদন করে। বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি উদাহরণ হচ্ছে: বাংলাদেশ রেলওয়ে, ডাক বিভাগ, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সমরাস্ত্র কারখানা, বহুমুখী নদীশাসন প্রকল্প, শুল্ক বিভাগ, রাজস্ব বোর্ড ইত্যাদি। এসব বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের প্রায় সকলেই এক ধরনের একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে।
বিধিবদ্ধ কর্পোরেশন গঠিত হয় আইনের বিধান (অধ্যাদেশ, সংসদ প্রণীত আইন) অনুসারে এবং এগুলি সাধারণত অর্থনৈতিক বা পণ্য উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত থাকে। সরকারিভাবে সৃষ্টি হলেও এগুলি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং এদের অবস্থান সরকারি শাসন কাঠামোর বাইরে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন ও সাধারণ বীমা কোম্পানি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, বিআরটিসি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন ইত্যাদি এ জাতীয় কর্পোরেশন। সরকার এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মূলধনের মালিক হয়ে এদের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। এরা যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে তার আওতায় এদের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলি নির্দিষ্ট আইন এবং বিধিবদ্ধভাবে প্রণীত নিয়মকানুন দ্বারা সুনির্ধারিত করা থাকে। তবে এদের ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থসংস্থানের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় কোষাগারের নয় বলে এরা নিজেদের মুনাফা দিয়ে সংরক্ষিত তহবিল গড়তে পারে এবং সংবিধি অনুযায়ী তা ব্যয় করতে পারে। আইন দ্বারা গঠিত বিধিবদ্ধ কর্পোরেশনকে পরিস্থিতি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ইচ্ছামতো ঢেলে সাজানো যায় না, এর কোন পরিবর্তন আনতে হলে তা শুধু আইন পরিবর্তনের পরই করা সম্ভব।
যৌথ মূলধনি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় কোম্পানি আইনের বিধান অনুসারে। কাজের ধরন বাণিজ্যিক হলে সেখানে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে সহজ। যৌথ মূলধনি কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কর্মকান্ড মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ না করলেও এদের বাজেট সরকার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এসবের ব্যবস্থাপনায় থাকে একটি পরিচালকমন্ডলীর বোর্ড এবং এগুলির হিসাব কোম্পানি আইনের আওতায় নিরীক্ষিত হয়। সরকারই সম্পূর্ণ মূলধন দিয়ে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করে। তবে কোন কোন সময় মিশ্র মালিকানায়ও এসবের প্রতিষ্ঠা হতে পারে। এগুলি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত; বিনিয়োগ, অর্থসংস্থান, কর্মচারি ব্যবস্থাপনা ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে এদের নিজেদের সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কয়েকটি যৌথ মূলধনি কোম্পানি হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ইত্যাদি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্য নিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছিল। বর্তমানে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান প্রায় সকল খাতে বিদ্যমান এবং এগুলি বিপুল পরিমাণ পরিসম্পদ ব্যবহার করে থাকে। ১৯৮০-৮১ সালে দেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগকৃত মোট ৪৩৮.৫ কোটি টাকার তিন-চতুর্থাংশই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ব্রিটিশ ভারতে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্প্রচার, ডাক ও তার, টেলিফোন, সড়ক, রেলপথ ও প্রতিরক্ষা খাত ইত্যাদির প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত ছিল। পরিবহণ ও ব্যাংকিং খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের তেমন তৎপরতা ছিল না। পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় খাতের জন্যে কোন শিল্প সংরক্ষিত ছিল না, তবে অন্যান্য খাতে সরকারি উদ্যোগসমূহের ভূমিকা শিল্পপতিদের বিকাশ ও তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের অনুকূল ছিল। এক সময় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে কিছু ব্যবসায় গড়ে তুলে পরবর্তীকালে সেগুলি ব্যক্তিখাতে হস্তান্তরের নীতি গ্রহণ করে। পাকিস্তান সরকার খোলাবাজার অর্থনীতি অনুসরণ করে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসমূহে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে এবং বেসরকারি খাতকে উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম বিবেচনা করে সরকারি খাতকে সংকীর্ণ গন্ডিতে সীমিত রাখে।
পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ এই মেয়াদে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কিছুটা বিকাশ ঘটায়, তবে সেটুকু কাজে লাগায় মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে। পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকলেও তা স্থানীয় বেসরকারি খাতের বিকাশে সামান্যই অবদান রেখেছিল। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরে অর্থাৎ ১৯৪৭-১৯৫০ সালে পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রধান প্রধান খাত ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, সেচ, প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক সেবা।
১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর শিল্প, ব্যবসায় ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকানা কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকার দেশে শিল্প পরিসম্পদের ৮৬%-এর নিয়ন্ত্রণ করায়ত্ত করে। পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালি অন্যান্য মালিকদের পরিত্যক্ত কলকারখানা এবং বস্ত্র, পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদি, চিনি ইত্যাদি খাতে সরকার বাংলাদেশি নাগরিকদের মালিকানাধীন মাঝারি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিগ্রহণ করে। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে সরকার বেসরকারি খাত কর্তৃক বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয়। কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ধরা হয় ২৫ লক্ষ টাকা, পরবর্তীকালে তা বাড়িয়ে পুনর্বিনিয়োগকৃত মুনাফাসহ ৩৫ লক্ষে উন্নীত করা হয়। একইসঙ্গে সরকার প্রয়োজনে যেকোন শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার অধিকারও সংরক্ষণ করে। কৌশলটি খুব বেশি সফল ছিল না। জাতীয়করণের দু-তিন বছরের মধ্যে দেখা গেল, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সব প্রতিষ্ঠান মূলত ব্যবস্থাপনাগত অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং উচ্চাভিলাষী নীতিনির্ধারক, ব্যবস্থাপক ও কর্মচারিদের ব্যক্তিগত লোভ ও জাতীয় স্বার্থের মধ্যে আদর্শগত সংঘাতের কারণে দ্রুত উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে এবং সেগুলি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে। পরিস্থিতির আরও অবনতি রোধ করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে সরকার বিনিয়োগ নীতি সংশোধনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বেসরকারি উদ্যোগের কর্মতৎপরতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সংশোধিত নীতি অনুযায়ী ১৮টি খাত সরকারি বিনিয়োগের জন্যে সংরক্ষিত থাকে এবং অন্যান্য সকল খাত বেসরকারি বিনিয়োগের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, বিনিয়োগ সীমা তিন কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। একইসঙ্গে দেশে বিদেশি বিনিয়োগেরও অনুমতি দেওয়া হয়। তাছাড়া দশ বছরের মধ্যে নতুন জাতীয়করণ স্থগিত রাখার মেয়াদ ১৫ বছর করা হয় এবং জাতীয়করণ করা হলে সংশি¬ষ্ট প্রতিষ্ঠানের মালিককে ক্ষতিপূরণ পরিশোধের বিধান চালু করা হয়।
১৯৭৬ সালে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলে আরও পরিবর্তন এনে বেসরকারি খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকাশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সূচনা করা হয়। শিল্পনীতি নতুনভাবে আবার সংশোধন করে স্থানীয় ও বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের রেয়াত সুবিধার বিধান তৈরি করা হয়। সরকারি বিনিয়োগের জন্য সংরক্ষিত অধিকাংশ খাত বেসরকারি খাত এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। জাতীয়করণ স্থগিত রাখার ক্ষেত্রে যে মেয়াদসীমা নির্ধারণ করা ছিল তা তুলে নেওয়া হয় এবং বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগ, সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করার নীতি প্রণয়ন করা হয়। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত খাতসমূহ সংস্কার করে কোন কোনটিকে পাবলিক কর্পোরেশন এবং নতুন কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। বেসরকারি খাত পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যসমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, কার্যকর আমদানি প্রতিস্থাপন, রপ্তানিযোগ্য পণ্যের অধিকতর উৎপাদন, উৎপাদনে একচেটিয়া কারবারের সীমিতকরণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দক্ষ কর্মী ও প্রযুক্তির বিকাশ। এসব বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৮২ সালে নতুন শিল্পনীতি প্রণীত হয়। এই নীতিতে সরকার বেসরকারিকরণ বা বিলগ্নীকরণে তার আগ্রহের বিষয়টি সুষ্পষ্টভাবেই প্রকাশ করে।
১৯৮০-৮৫ সালের জন্যে প্রণীত দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা বেসরকারি খাত উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৮০-৮১ সালে শিল্পখাতে মোট বরাদ্দের ২৫% বেসরকারি খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠানাদির জন্যে নির্ধারণ করে দেয় এবং ১৯৮১-৮২ সালের জন্যে এই বরাদ্দ করা হয় ৫৯.৪%। বিমান, পরিবহণ, টেলিযোগাযোগ, পারমাণবিক শক্তি, বিদ্যুৎ এবং প্রতিরক্ষা খাতই শুধু সরকারি খাতের জন্য সংরক্ষিত থেকে যায়। অন্য সকল খাত বিনিয়োগে কোন ঊর্ধ্বসীমা ছাড়া বেসরকারি খাতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রধান প্রধান পুঁজিঘন শিল্পণ যেমন পাট, বস্ত্র, চিনি, কাগজ, ইস্পাত, জাহাজ নির্মাণ, ভারি বিদ্যুৎসামগ্রী, খনিজ দ্রব্যাদি, তেল, গ্যাস ইত্যাদি খাত সবই বেসরকারি বা সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সরকার শিল্প, বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের ৩৯০টি প্রতিষ্ঠান বিলগ্নীকরণ করে। দেশের শেয়ার বাজার সম্প্রসারণের জন্য এবং বিনিয়োগের মূলধন সংগ্রহের লক্ষ্যে সরকার বেশ কয়েকটি সরকারি কোম্পানির ৪৯% পর্যন্ত শেয়ার সাধারণের নিকট বিক্রয়ের জন্য বাজারে ছেড়ে দেয়। উত্তরা ও পূবালী দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে এদের পূর্বতন বাংলাদেশি মালিকদের নিকট প্রত্যর্পণ করা হয়। এর পাশাপাশি সরকার বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠারও অনুমতি দেয়। ১৯৮২ সালেই সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে তিনটি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে দেশের সামরিক ও বেসামরিক সব সরকারই বেসরকারি খাত উৎসাহিতকরণের অনুকূলে প্রয়োজনীয় নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে যুদ্ধাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি, পারমাণবিক শক্তি, বন আবাদ ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যন্ত্রের সাহায্যে বৃক্ষকর্তন, সিকিউরিটি মুদ্রন ও টাকশাল এবং রেল ও বিমান পরিবহন সরকারি খাতের জন্যই সংরক্ষিত থেকে যায়। অবশ্য বিমানে মালামাল পরিবহণ ও অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের বিধিনিষেধ অল্প সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
বিনিয়োগ ও শিল্পনীতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন আনয়ন এবং শিল্পখাত বিকাশে সরকারের নতুন নতুন বিধান সৃষ্টির পাশাপাশি ১৯৮৯ সালে দেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সরকার বিনিয়োগ বোর্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে। বোর্ডকে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনার কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন এবং বিদ্যমান শিল্প-কারখানার কার্যচালনায় প্রয়োজনীয় সেবা-সহায়তা সংস্থানের অনুকূল সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথাযথ কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিনিয়োগ বোর্ড এখন বাজারে সরকারি কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার কাজও সম্পাদন করে। সরকারের বিলগ্নীকরণ নীতি কাগজে কলমে যথেষ্ট সুদূরপ্রসারী এবং ১৯৯৯ সনের নতুন শিল্পনীতি স্পষ্টভাবেই নির্দেশ করে যে, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহকে সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে বিবেচনা করে।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে অ-আর্থিক রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ এবং ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক উদ্যোগ, এভাবেও ভাগ করা যায়। বাংলাদেশে অ-আর্থিক রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ ৪০টি এবং বাংলাদেশের প্রমিত শিল্প শ্রেণিবিভাজন (বিএসআইসি) অনুযায়ী এগুলিকে ৭টি বড় খাতে বিভক্ত করা যায়। শিল্প খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগগুলি যেসব কর্পোরেশনের অধীন সেগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ বনশিল্প সংস্থা এবং বাংলাদেশ পাট শিল্প সংস্থা। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সরবরাহ খাতে আছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ সংস্থা, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ, ঢাকা পানি ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম পানি ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলির নাম: বাংলাদেশ জাহাজ চলাচল সংস্থা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিমান সংস্থা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড এবং মংলা ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড। বাণিজ্য খাতে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম সংস্থা, বাংলাদেশ পাট সংস্থা এবং বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন। কৃষি খাতের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ মৎস্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা। নির্মাণ খাতে রয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আর সেবা খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা, বাংলাদেশ পর্যটন সংস্থা, বাংলাদেশ বেসামরিক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড , বাংলাদেশ সিল্ক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড।
আর্থিক খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আছে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক (অগ্রণী, সোনালী, জনতা, রূপালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড), ৪টি উন্নয়ন অর্থসংস্থান প্রতিষ্ঠান (বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, প্রবাসী কল্যান ব্যাংক এবং বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ অর্থসংস্থান প্রতিষ্ঠান), এবং বীমা উপখাতের জীবন বীমা কর্পোরেশন ও সাধারণ বীমা কর্পোরেশন। ২০১০ সালের জানুযারি হতে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্পঋণ সংস্থাকে একীভূত করে বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক লিমিটেড (Bangladesh Development Bank Limited-BDBL) হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়।
২০১০ সাল পর্যন্ত বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের অ-আর্থিক খাতের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের সংস্কার কর্মসূচি অব্যহত রয়েছে। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সংস্থাসমূহ অদ্যবধি জাতীয় উৎপাদন, মূল্য সংযোজন, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নীট মুনাফার পরিমাণ ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত ঋণাত্বক ছিল যা ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এসে ধনাত্বক হয়। তবে ২০১০ সালে তা আবার ঋণাত্বক হয়, যদিও তা পরিমাণে পূর্ববর্তী বছরসমূহের তুলনায় কম। ২০০১-০২ অর্থবছরে যেখানে নীট মুনাফার পরিমাণ ছিল (-) ১৫৩৩.৫৬ কোটি টাকা তা হ্রাস/বৃদ্ধির মাধ্যমে ২০০৯-১০ অর্থবছরে দাঁড়ায় (-) ১৩০ কোটি টাকার কাছাকাছি। এ খাত হতে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বেশ কিছুটা হ্রাস পায়, যা মূলত বেসরকারিকরণের ফলে ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়। তবে পরিচালনা মুনাফার হার এবং সম্পদের টার্নওভার পর্যালোচনায় সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। এসব প্রতিষ্ঠান সরকারি কোষাগারে ২০০১-০২ অর্থবছরে মোট ১৭০.০৮ কোটি টাকা জমা দেওয়া হয় যার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৪৭৮.৫৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২১ অর্থবছরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে ডিভিডেন্ড ও মুনাফা আকারে সরকারি কোষাগারে ১৬৮৮ কোটি টাকা আহরিত হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল অবাঙালিদের হাতে। ভারত থেকে আগত মোহাজের এবং পাঞ্জাবিদের কয়েকটি গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় নীতির একচেটিয়া সুফল ভোগ করে এবং রাষ্ট্রের আনুকূল্য পেয়ে একটি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণিতে উন্নীত হয়। উন্মুক্ত শিল্পোদ্যোগ এবং উন্নয়নমুখী বাজার নিয়ন্ত্রণের অর্থনীতি জনপ্রিয় না হওয়ায় ষাটের দশকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে।
পাকিস্তানে সরকারি খাতের সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি হিসেবে গঠন করা হয়েছিল। প্রথম থেকেই পাকিস্তান একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত উন্নয়নের নীতিতে অটল ছিল এবং এ বিষয়ে উন্নয়ন ও সহায়তা দেওয়াই ছিল সরকারি খাতগুলির বৈশিষ্ট্য। দেশের শিল্প উন্নয়নের লক্ষ্যে পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনকে (পিআইডিসি) একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এ সংস্থার অধীনস্থ শিল্প ইউনিটগুলি লাভজনক হলে পরে সেগুলি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হতো। একই নীতির ভিত্তিতে সত্তরের দশকে পাকিস্তান সরকার অনেকগুলি শিল্প কারখানার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং সেগুলিকে বিভিন্ন হোল্ডিং সংস্থার আওতায় ন্যস্ত করে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে অবাঙালি মালিক ও ব্যবস্থাপকদের ব্যাপকহারে দেশত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এ শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য সরকার ১৯৭২ সালে ১নং আদেশ জারি করে। ৭২৫টি শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ সকল পরিত্যক্ত সম্পত্তি এই আদেশের আওতায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা হয়। ১৯৭২ সালের অধ্যাদেশবলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি করে ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠিত হয়। এরপর সরকার সকল ব্যবস্থাপনা বোর্ড বিলুপ্ত করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একজন করে প্রশাসক নিয়োগ করে। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সরকার বাংলাদেশ শিল্প প্রতিষ্ঠান (জাতীয়করণ) আদেশ ১৯৭২ জারি করে। এ আদেশবলে সরকার ১৫ লক্ষ টাকা বা তার বেশি মূল্যমানের সম্পদের অধিকারী সকল পরিত্যক্ত শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করে। এর ফলে দেশের সকল পাটকল, সুতাকল এবং চিনিকল রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ন্যস্ত হয়। জাতীয়করণ আদেশের আওতায় ১১টি সেক্টর কর্পোরেশন গঠন করা হয়। সকল জাতীয়করণকৃত শিল্প ইউনিট এবং বাংলাদেশ শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন ইপিআইডিসি) প্রকল্পসমূহ সংশি¬ষ্ট সেক্টর কর্পোরেশনের আওতায় আনা হয়। এসব পদক্ষেপের ফলে শিল্পখাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা ৩৪% থেকে ৯২% উন্নীত হয়। ১৯৭৬ সালে জারিকৃত রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর আদেশের সংশোধনী বলে শিল্পখাতের কয়েকটি সেক্টর কর্পোরেশনকে একীভূত করা হয়। বিএফসিপিসি, বিপিবিসি এবং বিটিসি এই তিনটি কর্পোরেশনকে নিয়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) এবং বিইএসসি ও বিএসএমসি সমন্বয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা (বিএসইসি)। বিএফএআইসি এবং এমএসএমসি নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি)। এই তিনটি সরকারি কর্পোরেশন ছাড়াও বর্তমানে দেশে উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত আরও তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলি হচ্ছে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশন (বিজেএমসি), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন (বিটিএমসি) এবং বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফআইডিসি)। বিজেএমসি, বিটিএমসি ও বিএফআইডিসি এই তিনটিসহ মোট ছয়টি সরকার নিয়ন্ত্রিত কর্পোরেশনের অধীনে বর্তমানে ৩৮৬টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৩৯২টি জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৩৯টি ছিল পরিত্যক্ত। এর অনেকগুলির ছিল বিপুল অঙ্কের দায়দেনা। শিল্প কারখানার সম্পদ বন্ধক রেখে এসব দেনা করা হয়।
১৯৭৬ সালে সরকার প্রণীত গাইডলাইনের ৩(৩) ধারায় ‘কর্পোরেশন/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং সেগুলির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক’ শীর্ষক অনুচ্ছেদ অনুসারে এ সকল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল: ১. জাতীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে সরকারি নীতি-নির্দেশনা ও বিধিবিধানমতে সর্বোচ্চ দক্ষতা ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা; ২. অধিকতর সুফল অর্জন ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা; ৩. সরকারের জন্য অতিরিক্ত রাজস্ব আয়। রাষ্ট্রপতির ২৭ নম্বর আদেশে সরকারি সম্পত্তি, সম্পদ ও দায় যেকোন কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তরের বিধান ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮৭ সালের ৭ নম্বর অধ্যাদেশে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানগুলির শেয়ার যেকোন কর্পোরেশন অথবা ব্যক্তির নিকট বিক্রয় বা হস্তান্তর করতে সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়।
কর্পোরেশনগুলি পরিচালনা এবং কর্মকর্তা ও বাণিজ্যের প্রশাসনভার সংশ্লিষ্ট পরিচালকমন্ডলীর ওপর ন্যস্ত করা হয়। কর্পোরেশন যে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে বা করে থাকে, সংশ্লিষ্ট বোর্ডও সেসব ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী হয়। কর্পোরেশনের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রধান নির্বাহীর পদে আসীন চেয়ারম্যানকেও বোর্ড সমুদয় ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। কর্পোরেশনের কার্যক্রম ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কর্মকর্তা, কর্মচারি ও পরামর্শক নিয়োগের শর্ত নির্ধারণ ও নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা সব কর্পোরেশনেরই রয়েছে।
বোর্ড অবশ্যই সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে থাকবে এবং সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত সাধারণ কিংবা বিশেষ নির্দেশনার আলোকে কর্পোরেশনের কার্যাবলি পরিচালিত হবে। কর্পোরেশনগুলিকে নিজ নিজ বার্ষিক বাজেট তৈরি করে সরকারের অনুমোদন নিতে হয়। এ অবস্থায় স্বচ্ছতাই কর্পোরেশনগুলির সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয় ছিল না, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল যথাযথ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা। সরকার কর্পোরেশনগুলির কার্যক্রম সুচারুরূপে পরিচালনার প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং সঠিক পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে সংশি¬ষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্পোরেশনগুলির কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করে। এ বিষয়ক গৃহীত পদক্ষেপগুলি হলো: ক. সরকার ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ/কর্পোরেশনসমূহের মধ্যে এ সকল সংস্থার অধীনস্থ ইউনিটগুলির আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ক অনুসৃত নীতিমালা প্রণয়ন; খ. সরকারি বিধিবদ্ধ কর্পোরেশনগুলি পুনর্গঠনের জন্য গঠিত কমিটির সুপারিশমালার ভিত্তিতে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ; গ. ১৯৮৬ সালের ৫ জুলাই দ্য পাবলিক কর্পোরেশন (ম্যানেজমেন্ট কো-অপারেশন) অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ নং ৪৮) জারি; ঘ. ১৯৭৬ সালের নীতিমালা এবং ১৯৮৩ সালে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ কঠোরভাবে অনুসরণ করা; ঙ. জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে সরকারি কর্পোরেশনগুলিতে সরকারের শেয়ার স্থানান্তর এবং মূলধন প্রত্যাহার সম্পর্কিত দ্য বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজ ন্যাশন্যালাইজেশন অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স জারি এবং চ. বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের মূলধন প্রত্যাহারকৃত ইউনিটে সরকারের ৫ শতাংশ শেয়ার রাখার বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ-সম্বলিত ১৯৮৮ সালের ৭ জুলাই বিজ্ঞপ্তি জারি।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা কাঠামোর অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, প্রশাসনিক শ্রেণিবিন্যাসের বিবেচনায় নিয়ন্ত্রণ তত্ত্বাবধান কাঠামোর ৪টি স্তর রয়েছে। সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ। পরের স্তরের নিয়ন্ত্রণ হলো কর্পোরেশন পর্যায় থেকে তত্ত্বাবধান। ইউনিটগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে প্রাপ্ত ক্ষমতার ব্যবহার এ পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণের মুখ্য দিক। তৃতীয় স্তরে রয়েছে উচ্চতর মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান। আমলাতান্ত্রিক প্রকৃতির এই তত্ত্বাবধান কাঠামোটিতে মূল্যায়ন, মন্ত্রণালয়গুলির মধ্যে সমন্বয় এবং নীতি নির্ধারণী বিষয়ে সরাসরি তদারকি থাকে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের তত্ত্বাবধান হয় মন্ত্রী তথা সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ থেকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদে জবাবদিহি করে থাকেন।
সর্বনিম্ন স্তরে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানই হলো এই নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের লক্ষ্যস্থল। এই প্রতিষ্ঠানগুলির কোন নীতি-নির্ধারণী ক্ষমতা নেই। এগুলি অনুমোদিত বাজেট পরিকল্পনা এবং বিধিবিধান অনুযায়ী চলিত হয়। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলির একটি করে ব্যবস্থাপনা বোর্ড থাকে, বোর্ডগুলির তৎপরতা নিজেদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের মধ্যেই সীমিত থাকে এবং প্রতিটি বিষয়েই কর্পোরেশনকে রেফার করে। পারস্পরিক আস্থার অনুপস্থিতি, জবাবদিহিতা ও পেশাদারিত্বের অভাব এবং কর্তৃপক্ষের অনানুষ্ঠানিক অবস্থান পরিবর্তন তথা এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই এমনটি ঘটে। বিধিবদ্ধ কর্পোরেশনগুলির অবস্থান প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে হওয়ায় এসকল নিয়ন্ত্রণকারী করপোরেশনের মূল কার্যাবলি কী, তা রাষ্ট্রপতির আদেশ বা অধ্যাদেশ অথবা জাতীয় সংসদে গৃহীত আইনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলিতে বলা হয়েছে যে, কর্পোরেশনগুলি অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের তত্ত্বাবধান, সমন্বয় ও পরিচালনা করবে। এছাড়াও করপোরেশন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যাবলি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি বিদেশ থেকে মালপত্র আহরণ, জনবল, নিয়োগ ও জনপ্রশাসন, বাজারজাতকরণ, উদ্বৃত্ত সমন্বয় বা অর্থ সংগ্রহের মতো বিষয়গুলি নিয়ে ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটিও করে থাকে। কিন্তু এই বিধিবদ্ধ কর্পোরেশনগুলি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমূহের ওপরই নির্ভরশীল; বিষয়গুলি সম্পর্কে স্বাধীনভাবে কোন কার্য সমাধা করতে বা সমন্বয় করতে সক্ষম নয়। নীতি নির্ধারণের অধিকাংশ বিষয়ে এবং কার্য পরিচালনার কতিপয় বিষয়ে কর্পোরেশনগুলি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করতে পারে না। তবুও এটা নিশ্চিত যে, নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর্পোরেশনের নিজস্ব একটা এখতিয়ার রয়েছে, যেমন এগুলির অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলিরও নিজেদের পক্ষ থেকে নীতি নির্ধারণ বিষয়ে কতিপয় এখতিয়ার থাকে। সচিবালয়ভিত্তিক আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করাই সরকারি প্রতিষ্ঠান-নীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল। অথচ তৃতীয় উচ্চতর স্তরে অধিষ্ঠিত এই মন্ত্রণালয়ই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির সংশ্লিষ্ট কার্যাবলি সম্পাদনে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। মন্ত্রণালয় কর্পোরেশনগুলি কর্তৃক তৈরি নথিপত্র পরীক্ষার পর অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে নীতি নির্ধারণ করে থাকে এবং সকল নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই রাখে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলির ভূমিকা থাকে যুগপৎ ও ব্যাপক। সর্বোচ্চ স্তরে থাকেন মন্ত্রী। নীতি-নির্ধারণের চেয়ে মন্ত্রী জনপ্রতিনিধি ও জনস্বার্থের অভিভাবক হিসেবে প্রায়ই সরকারি প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কর্মকান্ডের ক্ষেত্রগুলিতে হস্তক্ষেপ করে থাকেন। সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দৈনন্দিন কাজে এ রকম আরও কিছু কর্তৃত্ব মন্ত্রীর হাতে থাকে। মন্ত্রী পর্যালোচনা সভাসমূহ পরিচালনা করার পাশাপাশি সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনের পক্ষে মন্ত্রিসভায় নীতি-নির্ধারণী বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং জাতীয় সংসদে জবাবদিহি করে থাকেন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, যোগ্যতা, উৎপাদন ক্ষমতা এবং বাজারজাতকরণ নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির জন্য ১৯৮০ সালের অক্টোবর মাসে একটি উদ্যোগ গৃহীত হয়; গঠিত হয় ‘স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পরামর্শক কমিটি’ নামে একটি নতুন ফোরাম। পরে ১৯৮২ সালে এই ফোরামটির নতুন নামকরণ হয় ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির পরামর্শক কমিটি’ (CONCOPE)। অন্যান্যের মধ্যে এই ফোরামের উদ্দেশ্য ছিল কমিটির সদস্যদের অধীনস্থ সকল সরকারি সেক্টর কর্পোরেশন এবং প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা একটি সমন্বিত সিদ্ধান্তের আওতায় আনতে সরকারের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখা। একটি পৃথক সংগঠন হিসেবে এই কমিটি প্রশাসনিক, আর্থিক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রিসহ সরকারি কার্যনির্বাহীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে থাকে। [আবুল কালাম আজাদ এবং জাহিদ হোসেন]