রায়চৌধুরী, আচার্য ব্রজেন্দ্রকিশোর
রায়চৌধুরী, আচার্য ব্রজেন্দ্রকিশোর (১৮৭৪-১৯৫৭) সঙ্গীতজ্ঞ, লেখক, সমাজসেবক ও দানবীর। ১২৮১ বঙ্গাব্দের (১৮৭৪) ৬ বৈশাখ রাজশাহীর বলিহারে তাঁর জন্ম। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদারপত্নী তাঁকে দত্তক গ্রহণ করেন।
প্রথম জীবনে ব্রজেন্দ্রকিশোর সংস্কৃত সাহিত্যে পান্ডিত্য অর্জন করেন; পরে তিনি সঙ্গীতশাস্ত্রাদি অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। তিনি সঙ্গীতসহ অভিনয়, জাদুবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়েও বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তবে সঙ্গীতেই তাঁর খ্যাতি ছিল সর্বাধিক। তিনি বিখ্যাত মৃদঙ্গবাদক রামচন্দ্র চক্রবর্তী ও মুরারিমোহন গুপ্তের নিকট মৃদঙ্গ এবং আবদুল্লাহ খাঁ, ইমদাদ হোসেন খাঁ, আমীর খাঁ, শীতলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হনুমান দাসজীর নিকট এসরাজে তালিম গ্রহণ করেন। ব্রজেন্দ্রকিশোর সঙ্গীতের ঔপপাত্তিক ও ব্যবহারিক শাস্ত্রেও পারদর্শী ছিলেন। তিনি দক্ষিণাচরণ সেনের নিকট রাগসঙ্গীত শেখেন এবং বহু বিরল গ্রন্থ ও প্রচুর ধ্রুপদ গান সংগ্রহ করেন। তিনি সঙ্গীতশাস্ত্রকার অহোবল রচিত সঙ্গীত পারিজাত ও কয়েকজন পন্ডিতের সাহায্যে শার্ঙ্গদেব রচিত সঙ্গীতরত্নাকর গ্রন্থের অনুবাদ করেন। তিনি ‘ভারত সঙ্গীত সমাজ’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন।
ব্রজেন্দ্রকিশোর দানবীর হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ সংগঠনে পাঁচ লাখ টাকা দান করেন। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ তাঁরই প্রচেষ্টায় উক্ত শিক্ষা পরিষদের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। বারাণসীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি লাখের অধিক টাকা দান করেন। এছাড়া বিপ্লবী যুগান্তর দল, বঙ্গীয় ব্রাহ্মণসভা এবং বহু চিকিৎসালয়, বিদ্যালয় ও সংস্কৃত পন্ডিতদের সাহায্যার্থে তিনি প্রচুর অর্থ দান করেন। সেই সময়ে তাঁর মোট দানের পরিমাণ ছিল পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা।
ব্রজেন্দ্রকিশোর অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিভিন্ন সমবায় সংগঠন, পোত নির্মাণ ও বহুবিধ ব্যবসার সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। বাংলার নেতৃস্থানীয় বিপ্লবীদের সঙ্গে ব্রজেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ক্রীড়াজগতের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। তিনি টাউন ক্লাবের অন্যতম নির্মাতা, বেঙ্গল জিমখানার অন্যতম স্তম্ভস্বরূপ এবং হিন্দুস্তান ইনসিওরেন্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। গৌরীপুরে তিনি এক বিশাল প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ এবং দেড়শ বিঘা জমির উপর একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপন করেন। তিনি একজন নাট্যশিল্পী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দানের প্রস্তাব করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রখ্যাত যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী বীরেন্দ্রকিশোর তাঁর পুত্র। ১৯৫৭ সালের ২৯ নভেম্বর ব্রজেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। [মোবারক হোসেন খান]