রাধাগোবিন্দ চন্দ্র
রাধাগোবিন্দ চন্দ্র (১৮৭৮-১৯৭৫) উপমহাদেশের পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ। যশোর জেলার বগচর গ্রামে রাধাগোবিন্দ চন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত এই স্বশিক্ষিত বিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুনাম অর্জন করেছিলেন। স্থানীয় পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করার পর রাধাগোবিন্দ জেলা হাই স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু স্কুলের পড়ালেখায় তার তেমন একটা মনোযোগ ছিল না। এজন্য তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল অতি সাধারণ মানের এবং সংক্ষিপ্ত। এমনকি তিন তিন বার প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসেও তিনি কৃতকার্য হতে পারেননি। এর মধ্যে স্কুল ছাড়ার আগেই ১৮৯৯ সালে মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন গোবিন্দ মোহিনী নামে মাত্র নয় বছর বয়স্ক একটি মেয়ের সঙ্গে। বিয়ের পর তৃতীয় বার প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে তিনি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে দুই বছর বাড়িতে অবস্থান করেন। প্রথাগত পড়াশুনার প্রতি অনীহা থাকলেও তাঁর পরবর্তী জীবনের কৃতিত্ব বিস্ময়কর। ইংরেজী, ফারসী ও গণিতে তাঁর ভাল দখল ছিল। ছোট বেলা থেকে তাঁর বিচরণক্ষেত্র ছিল মাতুলালয়ের পারিবারিক লাইব্রেরি।
তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ছাত্র জীবনে অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই ব্রহ্মান্ড কি প্রকান্ড পড়ে। এরপর মিট মিট তারা শোভিত ধোঁয়াটে আকাশ গঙ্গা দেখে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় ব্রতী হন। এ সময় তাঁর মনে ব্রহ্মান্ড ও এর সৃষ্টি সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়। চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। এ ব্যাপারে শিক্ষা দেওয়ার মতো কোন শিক্ষক তাঁর ছিল না। তবে তিনি এ বিষয়ে প্রাথমিক পাঠ নেন যশোরের আইনজীবী কালীনাথ মুখার্জীর কাছ থেকে যিনি ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থের প্রণেতা। রাধাগোবিন্দ কালীনাথ বাবুকে নক্ষত্র মানচিত্র সম্পাদনায় সহায়তা করেন। নক্ষত্র মানচিত্র সম্পাদনায় সহায়তা করতে গিয়ে তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণের ওপর বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। এরপর তিনি সৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও কৃষ্ণনগর কোর্টের বিচারক মি. জে, হারসেল-এর সংস্পর্শে আসেন।
রাধাগোবিন্দ ১৯০০ সালে যশোর কালেক্টরেট অফিসে মুদ্রা পরীক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতে তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি ১৯১০ সালে আগত হ্যালীর ধূমকেতু পর্যবেক্ষণ করেন একটি সাধারণ বাইনোকুলার দিয়ে। হ্যালীর ধূমকেতুকে দুই মাস পর্যবেক্ষণ করে পর্যবেক্ষণলব্ধ উপাত্ত ধারাবাহিকভাবে একটি বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। ১৯১৮ সালের জুন মাসে তিনি নোভা (NOVA) নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন। রাধাগোবিন্দ চন্দ্রই এশিয়ার সর্বপ্রথম জ্যোতির্বিদ যিনি নোভা নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল হার্ভার্ড কলেজ মান মন্দিরের পরিচালক ডঃ এডওয়ার্ড পিকারিং এর কাছে পাঠান। ডঃ পিকারিং রাধাগোবিন্দের পর্যবেক্ষণের মূল্য উপলব্ধি করে তাঁকে আমেরিকান এসোসিয়েশন অফ ভ্যারিয়েবল স্টার অবজার্ভারস (AAVSO)-এর সদস্য করে নেন। ১৯২৬ সালে তাঁর পর্যবেক্ষণে সহায়তার উদ্দেশ্যে হার্ভার্ড থেকে যশোরে তাঁর গ্রামে একটি ৬ ইঞ্চি প্রতিসরণ দুরবিন পাঠানো হয়। বর্তমানে এই দুরবিনটি দক্ষিণ ভারতের কাভালুর মানমন্দিরে রাধাগোবিন্দের স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে রক্ষিত আছে।
রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের অধিকাংশ অবদান ছিল বিষম তারার ওপর। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মানমন্দির, ব্রিটিশ অ্যাষ্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন এবং ফ্রান্সের লিওঁ মানমন্দিরে নিয়মিত পাঠাতেন। ১৯২৮ সালে ফরাসি সরকার তাঁকে সম্মানসূচক ‘Officer d’Academic’ উপাধি ও পদক প্রদান করেন।
১৯৪৬ সালের জুন মাসে AAVSO একটি রোল অফ অনার প্রকাশ করে যাতে ১০,০০০ বিষম তারা, ধুমকেতু ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করেছেন বিশ্বের এমন ২৫ জনের নাম তালিকাভূক্ত করা হয়। রাধাগোবিন্দ ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি AAVSO কে সর্বমোট ৩৭,২১৫ টি বিষম তারা সম্পর্কে উপাত্ত সরবরাহ করেন।
ভারত বিভাগের পর রাধাগোবিন্দ সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। সেখানে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি বাংলা ভাষায় বেশ কয়েকটি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে পুস্তক রচনা করেন। তাঁর জীবদ্দশায় একমাত্র ধূমকেতু বইটি প্রকাশিত হয়। এই মহান জ্যোতির্বিদ ৯৭ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ৩ এপ্রিল পরলোক গমন করেন। [সুজন কুমার দেব]