রাজশাহী কলেজ
রাজশাহী কলেজ ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দুবলহাটির রাজা হরলাল রায় বাহাদুরের আর্থিক সহযোগিতায়। ১৮৭৩ সালের ২১ জানুয়ারি তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জমি প্রদান করেন। এই জমি থেকে বার্ষিক পাঁচ হাজার রুপি আয় হতো। প্রতিষ্ঠার পরপরই এটি পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, বিহার, পূর্ণিয়া এবং আসাম অঞ্চলের অধিবাসীদের উচ্চশিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। রাজশাহী জেলা স্কুলে (পরবর্তী সময়ে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) একজন মুসলমান ছাত্রসহ মোট ছয়জন ছাত্র নিয়ে রাজশাহী কলেজের এফ.এ ক্লাস শুরু হয় ১৮৭৩ সালের ১ এপ্রিল। শুরুর দিকে এই কলেজে কেবল ছাত্ররাই ভর্তি হতে পারত এবং ১৯৩০ সালে কলেজে ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। ১৯৩১ সালে কলেজটিতে ছাত্রী ভর্তি শুরু হয়। ১৯৭০ সালে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৮৪০, তন্মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল কেবল ৩০০। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কলেজের পরিসর ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৯০ সালে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৪,৭৩২ যাদের মধ্যে ছাত্রী ১,৩৫২। বর্তমানে (২০১০) কলেজে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ১৯৮।
কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন রাজশাহী জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হরগোবিন্দ সেন এবং তিনি পাঁচ বছর (১৮৭৩-১৮৭৮) অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৭৫ সালে অনুষ্ঠিত এফ.এ পরীক্ষায় প্রথমবারে এই কলেজের ২ জন ছাত্র উত্তীর্ণ হয়। সরকার কলেজটি বন্ধ করার চেষ্টা করে কিন্তু রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন-এর জোর প্রচেষ্টায় সরকারের সে প্রয়াস ব্যর্থ হয় এবং রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন বি.এ কোর্স চালুর মাধ্যমে কলেজটি উন্নত করার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথ রায়বাহাদুর রাজশাহী কলেজে ডিগ্রি কোর্স চালু করার উদ্দেশ্যে অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে সরকারকে দেড় লক্ষ টাকা প্রদান করেন। ১৮৭৭ সালের অক্টোবরে কলেজ ডিগ্রি কোর্সের অনুমতি লাভ করে এবং ১৮৭৮ সালে বি.এ কোর্স প্রবর্তন করে। ১৮৭৯ সালে এফ.টি ডাউডিং অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৮৪ সালে কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমানে প্রশাসনিক ভবন) নির্মিত হয়। কলেজের প্রথম ছাত্রাবাস পি.এন হোস্টেল ১৮৯৪ সালে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক স্থাপিত হয়। অধ্যক্ষ রায়বাহাদুর কুমুদিনীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৭-১৯১৯, ১৯২০-১৯২৪) কলেজের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। ১৯০২ সালে পুঠিয়ার মহারানী হেমন্তকুমারীর অর্থে ‘হেমন্তকুমারী হোস্টেল’ নির্মিত হয়।
১৯০৫ সালে রাজশাহী কলেজের অধীনে বিনাবেতনে সংস্কৃত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ‘মহারাণী হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ’ স্থাপিত হয়। বলিহারের কুমার শরদিন্দু রায়ের অর্থানুকূল্যে ১৯১০ সালে নির্মিত হয় কলেজের প্রাক্তন মিলনায়তন রাজা কৃষ্ণানন্দ হল। কলেজ কর্তৃপক্ষ ১৯১৫ সালে ৫৭,১৪৫ টাকা ব্যয়ে ফিজিকস বিল্ডিং নির্মাণ করে। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে এবং অধ্যক্ষ কুমুদিনীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ৩,৫৩,৮৩৬ টাকা ব্যয়ে পাঁচটি (১৯২২) এবং ৭৮,০০০ টাকা ব্যয়ে একটিসহ (১৯২৩) মোট ছয়টি হোস্টেল নির্মিত হয়। এসব হোস্টেলে মোট ৯৬০ জন ছাত্র-ছাত্রীর আবাসিকের সুবিধা রয়েছে। ১৯২৫-২৬ সালে মোট ৮৬,৮০৯ টাকা ব্যয়ে নিউ আর্টস বিল্ডিং-এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ১৯২৭ সালে কলেজের দক্ষিণে পদ্মা নদীর তীরে অধ্যক্ষের জন্য একটি বাসভবন নির্মাণ করা হয়। অতঃপর প্রায় পঁয়ত্রিশ একর জমির উপরে ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠে কলেজের অন্যান্য ভবন। ১৮৮৪ সালে কলেজ প্রাঙ্গণে রাজশাহী মাদ্রাসা ভবন নির্মিত হয়। ১৯৩০ সালে মাদ্রাসা অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় এবং একই বছর ১৯০৯ সালে নির্মিত ফুলার হোস্টেল কলেজ কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হয়। ১৯৩৬ সালে দিঘাপতিয়ার কুমার বসন্তকুমার রায়ের অর্থানুকূল্যে রাজশাহী কলেজের অধীনে বসন্তকুমার এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট স্থাপিত হয়। ১৯৫২ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়, ইনস্টিটিউট ভবনটি পরবর্তী সময়ে কলেজ ছাত্রাবাসে রূপান্তরিত হয়। কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৮১ সালে এম.এ এবং ১৮৮৩ সালে বি.এল কোর্সের অনুমোদন লাভ করে। কয়েক বছরের মধ্যে রাজশাহী কলেজ থেকে মোট ৮ জন এম.এ এবং ৬০ জন বি.এল ডিগ্রি অর্জন করে। ১৯০৯ সালে এম.এ এবং বি.এল কোর্সের অনুমোদন প্রত্যাহার করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে কলেজটি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি লাভ করে। আই.কম, বি.কম (পাস) এবং বি.এল (অনার্স) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে। ১৯৯৪ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পুনরায় মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে এইচ.এস.সি কোর্স বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গরীব, মেধাবী ও কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য রয়েছে বৃত্তি ও পুরস্কার। এর মধ্যে মোহিনী-মোহন প্রাইজ ফান্ড, কে.সি সরকার বৃত্তি, রানী মনোমোহিনী বৃত্তি, রাজশাহী কলেজ বৃত্তি, মেয়ো মেমোরিয়াল বৃত্তি, মোহসীন স্টাইপেন্ড উল্লেখযোগ্য। নির্বাচনী পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য ‘আবু তালেব অ্যাওয়ার্ড ফর মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্টস’ এবং অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য ‘রাজশাহী কলেজ অ্যাওয়ার্ড ফর মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্টস’ পুরস্কার রয়েছে।
বর্তমানে কলেজটিতে ১৯টি বিষয়ে অনার্স কোর্স এবং ২১টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হয়। কলেজে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার রয়েছে। অনেক পুরানো বই, গেজেট, বিশ্বকোষ, পুঁথি, পান্ডুলিপি এবং পত্র-পত্রিকা দ্বারা গ্রন্থাগারটি সমৃদ্ধ। বর্তমানে গ্রন্থাগারে পুস্তকের সংখ্যা প্রায় ৬৯,৪৩৯। গ্রন্থাগার ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি সুবিস্তৃত অডিটোরিয়াম আছে। কলেজ কর্তৃক আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান এ অডিটোরিয়ামে হয়।
ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারীদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। শরীর চর্চার জন্য একটি জিমনেসিয়াম, খেলাধুলার জন্য একটি মাঠ, ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবহণের জন্য ৩টি বাস, একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন, একটি পুকুর এবং নামাজের জন্য রয়েছে একটি মসজিদ। শিক্ষার্থীদের ভর্তি ও পরীক্ষার ফি সহ অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের জন্য রয়েছে রূপালী ব্যাংকের একটি শাখা। এছাড়াও রয়েছে একটি টিচার্স ক্লাব এবং একটি বিদেশি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। গ্রন্থাগার ভবনের পূর্ব পাশে নির্মিত হয়েছে ভাষা শহীদদের স্মরণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
রাজশাহী কলেজ ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, লন টেনিস প্রভৃতি খেলাধুলায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়ে আসছে। এই কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকবৃন্দ ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। [আলী রেজা মুহম্মদ আব্দুল মজিদ]