রক্ষীবাহিনী
রক্ষীবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনী। দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ জাতীয় রক্ষীবাহিনী আদেশ জারি করা হয়। স্বাধীনতার পরপরই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে থাকে। এ অবস্থায় সরকার সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণে রক্ষীবাহিনী নামে একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জাতীয় রক্ষীবাহিনী আদেশ-১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের ২১ নং আদেশ) জারি করা হয় এবং ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ আদেশ কার্যকর হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশটিতে আইনের অসম্পূর্ণতা থাকায় বাহিনীটি একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হতে পারে নি। আইনে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজে এ বাহিনী বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করবে এবং সরকারের নির্দেশক্রমে সামরিক বাহিনীকেও সাহায্য করবে। এর তত্ত্বাবধান কর্তৃত্ব থাকবে সরকারের হাতে এবং এর পরিচালনা ও নির্দেশনায় থাকবেন একজন পরিচালক (পরে মহাপরিচালক)। আদেশের ১৭ অনুচ্ছেদে এর জন্য বিধি প্রণয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়। রক্ষীবাহিনীর যেকোন অফিসার কোনো পরোয়ানা ছাড়াই অপরাধী সন্দেহে যেকোন লোককে গ্রেপ্তার করতে পারবে এবং যেকোন ব্যক্তিকে এবং যেকোন স্থান, মোটরযান অথবা নৌযান তল্লাসী করতে পারবে এবং প্রয়োজনে সন্দেহযুক্ত মালামাল জব্দ করতে পারবে।
গোড়ার দিকে রক্ষীবাহিনী বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অনেক অস্ত্রশস্ত্র, চোরাচালানের মালামাল উদ্ধার করে এবং মজুতদার ও কালোবাজারীদের কার্যকলাপ কিছুটা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু খুব শীঘ্রই বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হতে থাকে, কারণ দেখা যায় এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ঝটিকা বাহিনীর মতো রক্ষীবাহিনী প্রায়ই একেকটি গ্রামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং অস্ত্র ও দুষ্কৃতিকারীদের খুঁজত। তাদের যথেচ্ছাচার নিয়ন্ত্রণ বা তাদের কার্যকলাপের জবাবদিহিতার আইনগত কোন ব্যবস্থা ছিল না। অপরাধ স্বীকার করানোর জন্য গ্রেফতারকৃত লোকদের প্রতি অত্যাচারের অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়। তাদের বিরুদ্ধে লুটপাট এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও ছিল। তাদের কার্যকলাপের সমালোচনা যখন তুঙ্গে ওঠে এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে, তখন ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ-১৯৭৩ জারি করে রক্ষীবাহিনীর সকল কার্যকলাপ আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করে। রক্ষীবাহিনীর কোন সদস্য সরল বিশ্বাসে কোন কাজ করলে অথবা সৎ উদ্দেশ্যে উক্ত কাজ করে থাকলে অনুরূপ কাজের জন্য তার বিরুদ্ধে বিচারের জন্য কোন আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে না বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। বাহিনীটির কাঠামোগত দুর্বলতার জন্য এবং জনগণের দৃষ্টিতে এর ভাবমূর্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকলে অনেক রক্ষী বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে যায়। বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার মূল আদেশে আরেকটি সংশোধনী (জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ১৯৭৫) জারি করে। এর মাধ্যমে বহুসংখ্যক গুরু ও লঘু অপরাধের উল্লেখ করা হয়, যার জন্য অফিসার ও রক্ষীদের বিশেষ আদালত ও সংক্ষিপ্ত আদালতে বিচার করা যাবে।
এদিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অর্থনৈতিক সংকট গভীরতর হতে থাকলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রক্ষীবাহিনীর উপর তার নির্ভরতা থেকে সরে এসে প্রকাশ্যে তাদের বল্গাহীন কার্যকলাপের সমালোচনা করেন। তিনি সেনাবাহিনী ডেকে সরকারের ভেতর ও বাইরের অপরাধীচক্র নিয়ন্ত্রণে আনার আদেশ দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রক্ষীবাহিনী বিলোপ করে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভূক্ত করা হয়। নিয়মতান্ত্রিকভাবে বাহিনীটি বিলোপ করার জন্য ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর জাতীয় রক্ষীবাহিনী (সামরিক বাহিনীতে আত্তীকরণ) অধ্যাদেশ-১৯৭৫ (১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫২) জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশ বলে রাষ্ট্রপতির যে আদেশের অধীনে ১৯৭২ সালের ৮ মার্চ রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল তা রদ করা হয়। [এনামুল হক]