যাদু

যাদু  একটি গ্রিক শব্দ। যাদু বলতে বুৎপত্তিগতভাবে মায়া বিদ্যা বা ইন্দ্রজাল বিদ্যা বোঝায়। আদি ধর্মের অন্যতম একটি রূপ হিসেবে যাদু হচ্ছে মানুষ, জীব-জন্তু ও কাল্পনিক আত্মাকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে একগুচ্ছ ধর্মীয় আচারাদি এবং এ পন্থায় কিছু প্রত্যাশিত ফল লাভ। যাদুর এরকম ধারণার একটা ভিত্তি হচ্ছে মানুষ এবং তার পরিবেশের মধ্যে একধরনের অতিপ্রাকৃত সম্পর্ক কল্পনা। মানুষের চিন্তা ও কাজকর্ম বা প্রাকৃতিক ঘটনাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি কর্তৃক অপ্রাকৃতিক বা অতিমানবিক শক্তির ধারণাগত ব্যবহার হিসেবেও এটিকে চিহ্নিত করা যায়। বর্তমানে যাদুকে এক ধরনের বিনোদন রূপে উল্লেখ করা যায়, যেখানে একজন পরিবেশনকারী কেবল তার জানা কিছু কৌশল দিয়ে দর্শকদের বোকা বানায়। এক্ষেত্রে, দর্শক বা পরিবেশনকারীদের কেউই কোন ধরনের অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করে না।

মানুষ ভবিষ্যৎ বা অন্য কোনকিছুর জন্য একধরনের নিশ্চয়তা লাভ বা মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার জন্য যাদুর আশ্রয় নেয়। যদিও ঘটনাগুলি প্রাকৃতিক কার্যকরণের স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটে তবু মানুষ ফসলের ফলন বৃদ্ধি বা অসুস্থতাকে সারিয়ে তোলার জন্য যাদুর আশ্রয় গ্রহণ করে। কোন ঘটনা বা কাজের ক্ষেত্রে পূর্বগৃহীত বাস্তবসম্মত পদক্ষেপের অতিরিক্ত সহায়তা হিসেবে যাদুকে গণ্য করা হয়। কিন্তু বিনোদনধর্মী যাদুর ক্ষেত্রে এ ধরনের পদক্ষেপের বা বিশ্বাসের প্রশ্নটি নিষ্প্রয়োজন।

আধুনিক কালে যৌক্তিক এবং কাল্পনিক পদ্ধতির চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, তবুও মানুষ জ্যোতিষ শাস্ত্র, হস্তরেখা গণনা বিদ্যা, ভবিষ্যৎ কখন বা রাশিচক্রের মতো যাদু-সম্পর্কিত কার্যক্রমে বিশ্বাস করে। আধুনিক বিনোদনমুখী যাদুকরগণ দর্শকদের বোকা বানাতে বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করে। দক্ষ পরিবেশনকারী শূন্য থেকে টাকা সংগ্রহ, এক পকেট থেকে অন্য পকেটে মুদ্রা স্থানান্তর, ডিমকে পাখিতে রূপান্তর, নড়াচ রুমাল থেকে ফুল উৎপাদন ইত্যাদি কৌশল করে থাকে। এমনকি তারা মানুষকে শূন্যে ভাসমান বা তাকে কিছু সময়ের জন্য নিরুদ্দেশ করার মতো ইন্দ্রজালও সৃষ্টি করতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে একজন যাদুকরের চালাকি বিজ্ঞান ও কলা শাখার বিভিন্ন কৌশলের ওপর নির্ভরশীল। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, আলোকবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের মৌলিক নীতিসমূহের দক্ষ প্রয়োগ এক্ষেত্রে অপরিহার্য। পরিবেশনকারীর ইচ্ছানুযায়ী শ্রোতা-দর্শককে সম্মোহিত করার ক্ষেত্রে নানাবিধ শব্দের ব্যবহার যাদুর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

যাদু পরিবেশনে বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে, অন্যান্য দেশের মতো এরও আছে একটি নিজস্ব ভিত্তি। বহুকাল থেকেই যাদু বিদ্যার মতোই বিভিন্ন পদ্ধতিতে বেদে সম্প্রদায় কর্তৃক মাথা ব্যথা ও দাঁত ব্যথা সারানোর পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। পল্লী অথবা শহরতলি এলাকায় দক্ষ লোকজন যাদুর বিভিন্ন কৌশল প্রদর্শন করত। ভারত বিভাগের পূর্বে, গণপতি চক্রবর্তী নামে এক যাদুকর পলায়নের বিভিন্ন যাদুকরি কৌশল দেখিয়ে খ্যাতি লাভ করেন। কংস-কারাগারের লোহার খাঁচা থেকে পলায়নের যাদুটি জনগণের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তবে সবচেয়ে খ্যাতিমান পরিবেশনকারী ছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার  যিনি পি.সি সরকার নামে সমধিক পরিচিত। তিনি যাদু প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেকে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিলেন। তিনি ১৯৩৭ সালে তাঁর দলবল নিয়ে জাপান গমন করেন, যা তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দেয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কতিপয় যাদুবিদের প্রচেষ্টা এই শিল্পকে একটি পরিমার্জিত পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং শহুরে জনসাধারণের মধ্যে যাদু প্রদর্শনীকে জনপ্রিয় করে তোলে। কিছু মহিলা যাদুকরও এক্ষেত্রে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলাদেশে আধুনিক যাদুবিদ্যার সবচেয়ে প্রখ্যাত ব্যক্তি হচ্ছেন জুয়েল আইচ, যিনি টেলিভিশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্টেজ প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেশ ও বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই যাদু প্রদর্শনী এখন ক্ষুদ্র পরিসরের গ্রাম্য মেলা, সার্কাস দল এবং স্কুল-এর বৃত্ত পেরিয়ে অত্যাধুনিক কৌশল ও ধারণার সাথে বিশাল পরিসরের প্রদর্শনীতে উত্তীর্ণ হয়েছে।  [মোজাফফর হোসেন]