মৌলিক অধিকার
মৌলিক অধিকার বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ বাংলাদেশ সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসব অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সকল আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ এবং তা একই সঙ্গে এসব অধিকারের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন না করার জন্য রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেয়। অবশ্য কিছু কিছু অধিকার সংবিধানের ১৪১(ক), ১৪১(খ) ও ১৪১(গ) অনুচ্ছেদের আওতায় দেশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবনে হুমকির কারণে জরুরি অবস্থায় স্থগিত ঘোষিত হতে পারে।
মৌলিক অধিকার দৈহিক ও মানসিক সীমানা সঙ্কোচনকারী কৃত্রিম বাধা অতিক্রম করে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের আবহে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে। আধুনিক বিচারব্যবস্থা হলো বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ব্যাষ্টি স্বার্থদ্বন্দ্বের মধ্যে ন্যায়বিচারের ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্য সভ্যতার এক মহৎ সৃষ্টি। এসব সংঘাত অভিন্ন কল্যাণের লক্ষ্যে নাগরিকদের শান্তিপুর্ণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সহাবস্থানের জন্য সমাজে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাকে কঠিন করে তোলে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম রক্ষাকবচ।
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদের ২৮ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারগুলো লিপিবদ্ধ করা আছে এবং সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদে বিবৃত রয়েছে।
সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনের আশ্রয় এবং আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ প্রত্যেক নাগরিকের অলঙ্ঘ্য অধিকার এবং আইনবহির্ভুতভাবে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না যা জীবন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির নিরাপত্তাহানি ঘটায়। ২৯ অনুচ্ছেদে আছে যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী ও পুরুষভেদ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে।
এ অনুচ্ছেদের কোন কিছুই নাগরিকদের যেকোন অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করতে পারবে না।
সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে আছে যে, গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ না জানিয়ে কোনো জিম্মায় আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের ও তাঁর দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। গ্রেপ্তারকৃত প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে হাজির করতে হবে এবং ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাকে তদতিরিক্তকাল জিম্মায় আটক রাখা যাবে না, যদি-না সে আপাতত বিদেশী শত্রু হয় অথবা তাকে নিবর্তনমূলক আটক বিধানের কোন আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩৪ অনুচ্ছেদ সকল প্রকার জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ করেছে এবং এ বিধান কোনভাবে লঙ্ঘিত হলে তা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই সেসকল বাধ্যতামূলক শ্রমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না যেখানে ফৌজদারি অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তি আইনত দন্ডভোগ করছে অথবা জনকল্যাণমূলক আইনে তা আবশ্যক হচ্ছে।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে অপরাধ হিসেবে কার্য সংঘটনকালে বলবৎ আইন ভঙ্গ করার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং অপরাধ সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দন্ড দেয়া যেত তাকে তার অধিক বা তা থেকে বিবেচ্য ভিন্নতর দন্ড দেয়া যাবে না। ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনত প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী। কোনো ব্যক্তিকে অত্যাচার করা কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেয়া বা তার সঙ্গে তদ্রূপ ব্যবহার করা যাবে না।
সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ যাতায়াত, যেকোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার থাকবে।
সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নৈতিকতা জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সঙ্ঘ গঠনের, শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদানের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে।
সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে কোনো পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের কিংবা কারবার বা ব্যবসা পরিচালনার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। সংবিধানের ৪১ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের যেকোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে এবং প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, রক্ষণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-বন্টনের অধিকার থাকবে এবং আইনের প্রাধিকার ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাবে না। ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রবেশ, তল্লাশি দখল থেকে ও স্বীয় গৃহের নিরাপত্তা লাভের এবং চিঠিপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের গোপনীয়তার অধিকার থাকবে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৪ প্রত্যেক নাগরিককে সংবিধানের ৩য় অংশে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের যে কোনটি বলবৎ করার জন্য ১০২ অনুচ্ছেদের (১) ধারা মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করে। [এনামুল হক]