মৃত্যুক্ষুধা
মৃত্যুক্ষুধা কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী উপন্যাস। ১৯২৭-১৯৩০- এসময়ের মধ্যে উপন্যাসটি রচিত এবং সওগাত পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হয় (অগ্রহায়ণ ১৩৩৪-১৩৩৬ ফাল্গুন)। উপন্যাসটি নজরুলের বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। ১৯২৬ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত নজরুল কৃষ্ণনগরে বাস করতেন। এ নগরের চাঁদসড়কের ধারে বিরাট কম্পাউন্ডওয়ালা একতলা বাংলো প্যাটার্নের একটি বাড়িতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা ছিল। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের পটভূমি উক্ত বাড়ি, ওমান কাথলি পাড়া এবং কলতলার পারিপার্শ্বিককে কেন্দ্র করে রচিত। উপন্যাসের প্রথমাংশ কৃষ্ণনগরে এবং শেষাংশ কলকাতায় রচিত। কৃষ্ণনগরে অবস্থানকালে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট এবং দুঃসাধ্য কৃচ্ছ্রসাধন ছিল নজরুলের নিত্য জীবনযাত্রার অঙ্গ। তাই দারিদ্রের চিত্র, সাম্য ও বিপ্লবীচেতনা এ উপন্যাসের রূপকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাঁর বহুল পঠিত ‘দ্রারিদ্র’ কবিতাটিও এ সময়ের রচনা।
উপন্যাসটির সংক্ষিপ্ত কাহিনি-মৃৎশিল্পের কেন্দ্রভূমি কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়ক। এ সড়কের বস্তি এলাকায় বাস করে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার। রোগগ্রস্ত বৃদ্ধ মা, ৩জন বিধবা পুত্রবধু, দেবর প্যাঁকালে। পরিবারের প্রায় ডজনখানেক সন্তানের ভরণপোষণের ভার আঠারো-উনিশ বছরের প্যাঁকালের ওপর ন্যাস্ত। কুর্শি খিস্টান হলেও প্যাঁকালের ভালবাসার জন্য ব্যাকুল। সেজন্য বিধবা-রূপসী ভ্রাতৃজায়া মেজ-বৌয়ের বিবাহের প্রস্তাব তার কাছে অতি তুচ্ছ। কুর্শিকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় প্যাঁকালে ধর্মান্তরিত হয়। উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশের শুরু হয় আনসার-রুবি প্রসঙ্গে। সমাজকর্মী, দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী ও সংসার-বিরাগী আনসার এসে আশ্রয় নিল লতিফা ওরফে বুচির বাসায়। লতিফার স্বামী স্থানীয় কোর্টের নাজির। পরে কৃষ্ণনগরের জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটের তরুণী কন্যা সদ্য-বিধবা রুবির সঙ্গে শৈশব প্রণয়ের স্মৃতি আনসারের মনে উদয় হয়। যদিও রুবি-আনসারের পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটেছে উপন্যাসের শেষাংশে। মাঝখানে কয়েক বছর দু’জনের সাক্ষাৎ হয়নি। কারণ রুবির অমতে তার বিয়ে হয়েছিল অর্থলোভী এক যুবকের সঙ্গে। তাদের সংসার টিকে ছিল মাত্র একমাস। বাইরের সাজসজ্জা ও আচরণ রুবির বিধবাসুলভ হলেও মনে প্রাণে সে আনসারকেই স্বামী বলে মানে। আনসার রাজবন্দী হয়ে রেঙ্গুনে চলে যায়, সেখানে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হবার আশায় ওয়ালটেয়ারে যায়। রুবি ওই সংবাদ শোনামাত্রই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে দ্বিধা করে না। আনসারকে রোগমুক্ত করতে রুবি অক্লান্ত পরিশ্রম করে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাময় করতে অসমর্থ হয় এবং আনসার মারা যায়। এদিকে আনসারকে সেবাযত্নের ফলে একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে রুবি মারা যায়। ওদিকে অভাবের তাড়নায় মেজ-বৌ সন্তান ফেলে খ্রিস্টান হয় এবং বরিশালে নিজের জীবন কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে বাদ সাধে সন্তানেরা। তার ছেলেটি মারা যায়। মেজ-বৌকে ফিরে আসতে হয় বস্তিজীবনে। কিন্তু মেজ-বৌ মিশনারী মেম-সাহেবদের বহু অনুরোধেও আর ফিরে যায়নি আবার তৌবা করে মুসলমানও হয়নি। প্যাঁকালেকে খান বাহাদুর সাহেব কুড়ি টাকার চাকুরি দেওয়ায় প্যাঁকালে কুর্শিকে নিয়ে মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়- এখানেই কাহিনীর সমাপ্তি।
মৃত্যুক্ষুধা প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালের রচনা। একারণে যুদ্ধোত্তর যুগের অর্থসংকট, শ্রেণিবৈষম্য, নগরচেতনার প্রকাশ এবং উপলদ্ধিতে সার্থক। এ উপন্যাস রচনায় নজরুলের দ্বৈতসত্তা পাশাপাশি কাজ করেছে। একদিকে তিনি সংগীতামোদী, প্রাণচঞ্চল অন্যদিকে ধ্যানী, শিল্পী, প্রেমিক, সংসার-অনাসক্ত, সংস্কারনিষ্ঠ এবং দেশ ও জাতীর প্রয়োজনে সর্বস্ব ত্যাগী। এ দ্বৈতসত্তার প্রকাশ ঘটেছে প্যাঁকালে ও আনসার চরিত্রের মধ্যে। এ উপন্যাসের চরিত্র প্লট ও ভাষা জীবনস্পর্শী। এ উপন্যাসের ভাষা একান্তই নজরুলীয় বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ। তিনি চরিত্রের স্বাভাবিকতার স্বার্থে যার যার মুখে যে সংলাপ প্রযোজ্য তাই রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। ভাষায় যমক, শ্লেষ, উৎপ্রেক্ষা বা অলঙ্কার বিশিষ্টতা নজরুলের গদ্য রচনার অনন্যতা। প্রাত্যহিক শব্দের নতুনতর ব্যঞ্জনা এবং ভাষার ধ্বনিময়তা উপন্যাসের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। নজরুলের এ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাম্যবাদী চেতনার উপন্যাস। [শামীমা আক্তার]