মৃত্তিকা পরিবেশ

মৃত্তিকা পরিবেশ (Soil Environment)  মৃত্তিকার অবস্থা প্রভাবকারী নিয়ামকসমূহের সমষ্টি যাতে ভৌত পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জলবায়ু এবং জীবন্ত জীবের প্রভাব অন্তর্ভুক্ত। মৃত্তিকা ও এদের পরিবেশের মধ্যে আন্তঃক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন মৃত্তিকাতে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ব্যাপক পরিসরে পরিবেশগত অবস্থার পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশের মৃত্তিকাতে বৈচিত্র্য বিদ্যমান। পরিবেশীয় বৈচিত্র্যের উপাদানগুলো হলো: (ক) উৎস বস্ত্ত- বাংলাদেশে আঠারো প্রকারের উৎস বস্ত্ত বিদ্যমান এবং সেগুলো প্রধানত নদীপলল, পাহাড়ি শিলা, এঁটেল ও পর্বত পাদদেশীয় পলল দিয়ে গঠিত। এসব উৎসবস্ত্ত মৃত্তিকা গ্রথনে ব্যাপক পার্থক্যের সৃষ্টি করেছে এবং এদের মধ্যে বিদ্যমান সহজে অবক্ষয়যোগ্য মণিকের পরিমাণেও পার্থক্য রয়েছে; (খ) জলবায়ু- শিলা অবক্ষয়ের হার ও মৃত্তিকা উৎপত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। বাংলাদেশে বিরাজমান উচ্চ তাপমাত্রা (গড় বার্ষিক তাপমাত্রা ২৫° সেলসিয়াস) এবং পানির প্রাচুর্য (গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত প্রায় ২৩০০ মিলিমিটার) শিলা অবক্ষয় ও জৈব ক্রিয়াকলাপের জন্য প্রায় আদর্শ অবস্থা। দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ুর পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, কিন্তু শুষ্ক পশ্চিমাঞ্চল এবং আর্দ্র পূর্বাঞ্চলের মধ্যে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পার্থক্য মৃত্তিকার মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহের পরিমাণকে প্রভাবিত করে, যা এঁটেল ও রাসায়নিক পদার্থের ক্ষালন ঘটায় এবং এভাবে মৃত্তিকার উৎপত্তি ও সেই সঙ্গে মৃত্তিকা পরিবেশকে প্রভাবিত করে; (গ) ভূসংস্থান- বিভিন্ন প্রকারের ভূসংস্থান মৃত্তিকা পরিবেশকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ- পাহাড়ি এলাকার খাড়া ঢাল, বরেন্দ্রভূমিতে ব্যাপক বিস্তৃত সমতল এলাকা এবং পললভূমি এলাকার প্রশস্ত উঁচু ও নিচু ভূমি; (ঘ) নিষ্কাশন- অতি নিষ্কাশিত থেকে অপ্রতুলের মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শন করে; (ঙ) গাছপালা- শুষ্কভূমির বনাঞ্চল, ম্যানগ্রোভ বন এবং জলাভূমির নলখাগড়া, সেই সঙ্গে এসব বনভূমি ও চাষাবাদকৃত মৃত্তিকার (বিশেষ করে যেখানে চাষাবাদের ফলে অপ্রবেশ্য পৃষ্ঠমৃত্তিকা সৃষ্টি হয়েছে) মধ্যে বিদ্যমান গাছপালা; (চ) বয়স- বাংলাদেশের পরিবেশগত অবস্থাতে মৃত্তিকা উৎপত্তির দ্রুততার কারণে এ নিয়ামকটি গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ- ব্রহ্মপুত্র-যমুনা পললভূমিতে উৎপন্ন ১০ থেকে ১৫ বছরের কম পুরাতন এবং প্রায় ২০০ বছরের পুরাতন (যখন থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ এর আদি যমুনা খাতে মিশেছিল) মৃত্তিকার মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য শনাক্ত করা যায়। এদেশে পরিবেশগত বৈচিত্র্য কেবল জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়েই ঘটে না, বরং উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়েও ঘটে। প্রকৃতপক্ষে, মৃত্তিকা ও পানি সংক্রান্ত অবস্থার ক্ষুদ্রায়তন জটিলতা বাংলাদেশের পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এছাড়া, এক বছর থেকে অন্য বছরে তাপমাত্রা ও বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পার্থক্য মৃত্তিকা পরিবেশের জন্য প্রধান সমস্যার সৃষ্টি করে। বন্যার গভীরতা ও স্থায়িত্ব তাৎপর্যপূর্ণভাবে মৃত্তিকা পরিবেশকে প্রভাবিত করে। প্লাবিত মৃত্তিকাতে বিজারিত ও অবাতীয় অবস্থা এবং অপ্লাবিত মৃত্তিকাতে বিরাজমান জারিত ও সবাত অবস্থা মৃত্তিকার ধর্মাবলি ও কোন প্রকারের শস্য জন্মাবে তাতে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে। ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিক থেকে শস্য নিবিড়করণ, উচ্চ ফলনশীল জাতের প্রবর্তন এবং সেচ এলাকা সম্প্রসারণের কারণে রাসায়নিক সারের ব্যবহার দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু সারের অযথাযথ ব্যবহার উৎপাদন সিস্টেমে দ্বিতীয় পর্যায়িক সমস্যার সৃষ্টি করেছে। অধিকন্তু, বাংলাদেশের মতো একটি ছোট দেশে অধিক সংখ্যক গবাদি পশু ও জনসংখ্যা এবং অপরিকল্পিতভাবে এদের অবস্থানের কারণে এর মৃত্তিকা পরিবেশের গতিশীলতার প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করা প্রয়োজন। কারণ এখানে বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও নগরজাত বর্জ্য ও নির্গত বস্ত্ত, জৈববস্ত্তর দহন, বনাঞ্চল  হ্রাস, প্রয়োজনের অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং কিছু বিষাক্ত বস্ত্ত সংবলিত বস্ত্তর প্রভাবে বায়ুমন্ডলীয় ও মৃত্তিকা দূষণের সম্ভাব্য উৎস বিদ্যমান। অধিকন্তু, মৃত্তিকা ক্ষয় মধুপুর অঞ্চল ও পূর্বদিকের পাহাড়ি অঞ্চলে একটি মারাত্মক সমস্যা। উত্তম পৃষ্ঠমৃত্তিকা ব্যবহার করে ইট তৈরি বর্তমানে একটি স্বাভাবিক কাজে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে দেশের অনেক এলাকায় শস্য উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।  [মোঃ হারুনর রশীদ খান]