মৃত্তিকার উৎপত্তি
মৃত্তিকার উৎপত্তি (Soil Formation) মৃত্তিকা উৎপন্নকারী নিয়ামক, যেমন- উৎসবস্ত্ত, জলবায়ু, বন্ধুরতা ও নিষ্কাশন, জৈব ক্রিয়া, সময়ের ব্যাপ্তির সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার মৃত্তিকা উৎপন্ন হচ্ছে।
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী বাহিত পললে বিভিন্ন পরিমাণে মাইকা, ফেল্ডস্পার ও হর্নব্লেন্ড ইত্যাদি মণিক থাকে। এঁটেল ও রাসায়নিক মৌল, যেমন- Fe, Ca, P ইত্যাদি উৎপন্ন করতে এসব মণিক মৃত্তিকাতে অবক্ষয়িত হয়। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র পললে অধিক পরিমাণে সহজে অবক্ষয়যোগ্য মণিক বায়োটাইট (কালো মাইকা) থাকে, কিন্তু সামান্য পরিমাণে বা আদৌ চুন থাকে না। অন্যদিকে, গঙ্গা নদীর পললে তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে বায়োটাইট এবং যথেষ্ট পরিমাণে চুন থাকে এবং সুরমা, কর্ণফুলি ও পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী অবক্ষেপে অল্প পরিমাণে বায়োটাইট থাকে, কিন্তু চুন থাকে না। আদি উৎস বস্ত্তর উপর মৃত্তিকা গঠনকারী নিয়ামকের ক্রিয়াকলাপ রাসায়নিক উপাদান, বালি, পলি ও এঁটেল কণার আপেক্ষিক অনুপাত এবং চুনের দ্বিতীয় পর্যায়িক উৎপত্তি ও আয়রনের পরিমাণ পরিবর্তন করে।
অধিক তাপমাত্রা, অতি বৃষ্টিপাত এবং বর্ষা ও শুষ্ক ঋতুর মধ্যে পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান আর্দ্র ও শুষ্ক অবস্থা বাংলাদেশে শিলা অবক্ষয়ের আদর্শ অবস্থা সৃষ্টি করে। যদিও বাংলাদেশের ভিতরে জলবায়ুর পার্থক্য বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের মৃত্তিকা উৎপন্ন করার জন্য ততটা সুস্পষ্ট নয়, তবুও বিভিন্নস্থানে বৃষ্টিপাতের পার্থক্য মৃত্তিকাতে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য সৃষ্টি করতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে।
ভূসংস্থানের উপর অবস্থানের পার্থক্যের কারণে ভুমির কোন কোন এলাকা বছরের কিয়দংশ বা সারা বছর জলমগ্ন থাকে। পক্ষান্তরে, অন্যান্য এলাকা সারা বছর ধরে পানি অসম্পৃক্ত থাকে। সাধারণত আর্দ্র ও অবায়বীয় অবস্থার চেয়ে সুনিষ্কাশিত অবস্থায় জৈবপর্দাথ অধিক দ্রুত বিয়োজিত হয়। সুতরাং বাংলাদেশের অবস্থায় তুলনামূলকভাবে উঁচু সুনিষ্কাশিত এলাকা, যেমন- পললভূমির শিখর এলাকাতে জৈবপর্দাথ দ্রুত বিয়োজিত হয়। বছরের অধিকাংশ বা সারা বছর ধরে আর্দ্র থাকে এমন নিচু এলাকাতে জৈবপদার্থ তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে বিয়োজিত হয়। জৈবপদার্থ পললভূমি অববাহিকার মধ্যস্থলে পিট আকারে জমা হয়ে নতুন উৎস বস্ত্তর সৃষ্টি করে।
স্থায়িভাবে সম্পৃক্ত, স্থায়িভাবে অসম্পৃক্ত এবং পর্যায়ক্রমে সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত অবস্থায় মৃত্তিকাতে বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকে। পানি অবস্থার এ পার্থক্য সুনির্দিষ্টভাবে আয়রন যৌগকে প্রভাবিত করে যা মৃত্তিকার রঙে ভিন্নতার সৃষ্টি করে। স্থায়িভাবে সম্পৃক্ত অবস্থায় ধূসর রঙের মৃত্তিকা তৈরি হয়, কারণ অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে Fe2+ আয়রন যৌগ তৈরি হয় এবং মৃত্তিকা থেকে পানির সঙ্গে নিচে চলে যায়। অসম্পৃক্ত অবস্থায় হলুদ, বাদামি ও লাল রঙের মৃত্তিকা দেখা যায়, যেখানে বায়ুর উপস্থিতিতে Fe3+ আয়রন যৌগ তৈরী হয়। পর্যায়ক্রমে সৃষ্ট সম্পৃক্ত ও অসম্পৃক্ত অবস্থায় ধূসর ও হলদে-লাল রঙের দাগ তৈরি হয়।
বিভিন্ন প্রকারের গাছপালা, যেমন- বনভূমি, তৃণভূমি, আবাদি শস্য বিভিন্ন পরিমাণে এবং কখনো কখনো বিভিন্ন প্রকারের জৈববস্ত্ত উৎপন্ন করে। আবাদি ভূমির মৃত্তিকার চেয়ে বনভূমির মৃত্তিকাতে সাধারণত অধিক জৈব পদার্থ থাকে। আবার, বনাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে অধিক সুনিষ্কাশিত ও অধিক প্রবেশ্য পাহাড়ি, সোপান ও পললভূমি মৃত্তিকা এবং তৃণভূমিতে অধিক অপ্রতুল নিষ্কাশিত মৃত্তিকা উৎপন্ন হয়।
যদি অল্প কয়েক বছর (৫ থেকে ১০ বছর) আগে অবক্ষেপিত পলল মৃত্তিকার উৎসবস্ত্ত হয় তবে জলবায়ু, গাছপালা ও নিষ্কাশনের প্রভাবে সৃষ্টি পরিবর্তন সামান্যই হয়ে থাকে এবং বর্তমান মৃত্তিকা ও আদি পললের মধ্যেও সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। অন্যদিকে, কয়েক শত বছর আগে অবক্ষেপিত পলল যদি পরবর্তীকালে কোনো নতুন পলল দ্বারা ঢেকে না যায় তবে সেখানে বিদ্যমান বর্তমান মৃত্তিকা ও আদি পললের ধর্মাবলিতে সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশে দুটি সুস্পষ্ট অবস্থায় মৃত্তিকার উৎপত্তি ঘটে: পর্যায়ক্রমে ঘটা মৌসুম মাফিক প্লাবিত অবস্থা বা আর্দ্র ও শুষ্ক অবস্থা এবং প্লাবনবিহীন অবস্থা।
মৌসুম মাফিক প্লাবিত অবস্থাধীনে মৃত্তিকার উৎপত্তি পললের প্রারম্ভিক অবস্থা নতুন পলল প্রথমে স্তরীভূত হয়। পলিময় ও এঁটেল অবক্ষেপের ক্ষেত্রে পলল মিহি এবং বেলে বা মিশ্র বেলে ও পলিময় অবক্ষেপে স্থূল বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। সমরূপ পলিময় ও এঁটেল অবক্ষেপে স্তরায়ণ প্রধানত মাইকা শুল্কের (mica flakes) অপুরু স্তরের দ্বারা ঘটে। মাইকাগুলো সমতল পৃষ্ঠ দ্বারা অবক্ষেপ পৃষ্ঠের সমান্তরালে অবক্ষেপিত হয়। প্রারম্ভিক অবক্ষেপ সাধারণত ধূসর রঙের হয়ে থাকে। অবক্ষেপগুলো যখন সিক্ত অবস্থায় থাকে তখন স্বতন্ত্র মণিক কণা পানি দ্বারা বেষ্টিত থাকে। এ অবস্থায় অবক্ষেপকে ‘অপরিপক্ক’ বলা হয়।
পরিপক্ককরণ পরিপক্ককরণ হলো একটি প্রক্রিয়া যদ্বারা প্রারম্ভিক অবস্থায় বিদ্যমান মণিক কণা বেষ্টনকারী পানি হ্রাস পায় এবং পলিজ পললের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন ঘটে। স্থূল পললে নিষ্কাশন এবং মিহি পললে বাষ্পীভবন ও গাছের প্রস্বেদন দ্বারা পানির হ্রাস ঘটে। পরিপক্ককরণ প্রক্রিয়া চলার সাথে সাথে পাললিক বস্ত্তর সঙ্কোচন এবং কণামধ্যবর্তী স্থানের পানি অপসারিত হওয়ার পর বায়ু দ্বারা আংশিক প্রতিস্থাপন ঘটে। পললের ভিতরে বায়ু প্রবেশের ফলে সৃষ্ট বায়বীয় অবস্থায় রাসায়নিক পরিবর্তন, যেমন- আদি বস্ত্ততে বিদ্যমান বিজারিত আয়রন যৌগে জারণের সূচনা হয়। পরিপক্ককরণের চিহ্ন শুধুমাত্র বস্ত্তর ভৌত অবস্থার পরিবর্তন দ্বারাই সুস্পষ্ট হয় না, বরং বস্ত্ত, বিশেষ করে পলিকণা সমৃদ্ধ বস্ত্ততে সাধারণত রঙেরও পরিবর্তন ঘটে।
প্রাথমিক পর্যায়ে কর্বুর (mottles) সৃষ্টি পরিপক্ককরণের প্রথম দিকে মৃত্তিকা বস্ত্ত সমরূপ জলপাই বা বাদামি রঙের থাকে। কিন্তু, শিকড় বা প্রাণী দ্বারা সৃষ্ট গর্তের মধ্য দিয়ে স্থানীয়ভাবে অধিক পরিমাণে বায়ু পরিপক্ক পললের মধ্যে প্রবেশ করার ফলে অধিক জারণ ঘটে। এ ধরনের স্থানীয় জারণ বিশেষ করে যেখানে ধান ও অন্যান্য জলজ গাছপালা জন্মে সেখানে অত্যন্ত প্রবল হয়। এটা ঘটার কারণ হলো এই যে, এ প্রকারের গাছপালার জীবন্ত শিকড় বায়ুকে নিচে নিয়ে যায় বা শিকড় দ্বারা সৃষ্ট নালীতে অক্সিজেন নির্গত করে। মৃত্তিকা বস্ত্ত থেকে এ ধরনের শিকড় বা গর্তের দিকে প্রবাহিত পানির সঙ্গে বিজারিত আয়রন ভিতরের দিকে চলে যায় এবং নালার সন্নিকটস্থ অপুরু অঞ্চলে জারিত হয়। এভাবে উৎপন্ন জারিত অঞ্চলের পিছনে এক মিলিমিটার বা এর চেয়েও পুরু অধিকতর ধূসর ক্ষালিত অঞ্চলের সৃষ্টি হয়। ফেরাস ও ফেরিক আয়রনের বিন্যাসে এ পরিবর্তন প্রাথমিক ধাপে বর্ণ বৈসাদৃশ্যের সৃষ্টি করে, যা কর্বুর হিসেবে পরিচিত।
সমরূপকরণ (Homogenisation) এ প্রক্রিয়া দ্বারা গাছের শিকড় ও মৃত্তিকাস্থিত প্রাণী মৃত্তিকা বস্ত্তর স্বাভাবিক অবস্থা বিঘ্নিত করে ও বস্ত্তকে মিশ্রিত করে। এর ফলে আদি পাললিক স্তরায়ণ ও শিলা গঠন নষ্ট হয়ে যায়। পললের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় গাছের শিকড় দ্বারা সৃষ্ট চাপ পাললিক স্তরায়ণ ও শিলা স্তরের স্বাভাবিক অবস্থাকে বিঘ্নিত করে। গাছের শিকড় পচে সৃষ্ট গর্ত দিয়ে বায়ু ও পানি ভিতরে প্রবেশ করে। গাছের পচনশীল শিকড় ও অন্যান্য প্রাণীর উপর নির্ভরশীল প্রাণীর ক্রিয়াকলাপের ফলে স্তরায়ণ আরও ভেঙ্গে যায়; মৃত্তিকাতে গর্ত সৃষ্টি হয় এবং বস্ত্তর মিশ্রণের দ্বারা যে গভীরতা পর্যন্ত গর্তবাসী প্রাণী যেতে পারে, সেই গভীরতা পর্যন্ত পাললিক স্তরায়ণের সকল চিহ্ন নষ্ট হয়।
সমরূপকরণের গভীরতা মৃত্তিকায় বসবাসকারী প্রাণীগুলো খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য যে গভীরতা পর্যন্ত যায় তার উপর নির্ভর করে। পাললিক বস্ততে স্থায়িভাবে সম্পৃক্ত অঞ্চল বা স্থূল বালি স্তর পর্যন্ত এর নিম্ন সীমানা বিস্তৃত হতে পারে। পাহাড়ি এলাকাতে এ সীমানা শক্ত ও দৃঢ় শিলাস্তর পর্যন্ত ব্যাপ্ত হতে পারে। অধিকাংশ মৃত্তিকাতে সমরূপকরণ একটি অবিরত প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া মৃত্তিকা বস্ত্ত তৈরি করতে আদি উৎস বস্ত্তর মিশ্রণের জন্যই কেবল দায়ী নয়, বরং ক্ষয় দ্বারা মৃত্তিকাপৃষ্ঠ থেকে অবক্ষয়িত বস্ত্ত অপসারণের ফলে সৃষ্ট ক্ষতিপূরণ করতে নিম্নস্থ উৎস বস্ত্ত মৃত্তিকাতে একীভূত করা, জৈব বস্ত্তকে মৃত্তিকাতে মিশ্রিত করা এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরাতন রন্ধ্রের স্থলে নতুন রন্ধ্র বা ফাঁকাস্থান সৃষ্টি করার মাধ্যমে মৃত্তিকার মধ্য দিয়ে বায়ু চলাচল সহজ করে মৃত্তিকার হ্রাস পাওয়া ক্ষমতাকেও নবায়ন করে।
সংযুতি সৃষ্টি পললে পরিষ্করণ প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে পানি হ্রাসের ফলে উল্লম্ব ও পার্শ্বীয়ভাবে বস্ত্তর সঙ্কোচন ঘটে। পলিময় ও এঁটেল পললে এ ধরনের সঙ্কোচনের ফলে ফাটলের সৃষ্টি হয়। পুরু পলিময় বস্ত্তর পৃষ্ঠে সৃষ্ট প্রথম দিকের ফাটলগুলোর ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার প্রশস্ত এবং ৬০ সেন্টিমিটার বা এর চেয়ে অধিক গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। প্রথম দিকে এসব ফাটল অনিয়মিত রীতিতে কয়েক মিটার দূরত্ব বজায় রেখে সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অনিয়মিত বহুভুজের সৃষ্টি করে। বহুভুজ আকৃতির এসব খন্ডের প্রশস্ততা সময়ের সাথে সাথে হ্রাসপ্রাপ্ত হয় এবং সুগঠিত মৃত্তিকাতে সাধারণত ৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পরিসরের মধ্যে থাকে। পরিপক্ককরণের শুরুতে সৃষ্ট ফাটলগুলোর চেয়ে বহুভুজকে পৃথককারী ফাটলগুলো তুলনামূলকভাবে কম গভীর। এসব বহুভুজ প্রিজমতুল্য সংযুতি সৃষ্টি করে যা সাধারণত বাংলাদেশের যথোপযুক্ত গ্রথনের অধিকাংশ পললভূমি মৃত্তিকাতে দেখা যায়।
এঁটেল বস্ত্তগুলো অনুভূমিকভাবে ফেটে যাওয়ার ফলে প্রিজমতুল্য ও গন্ডাকৃতির (blocky) সংযুতি উৎপন্ন হয়। প্রিজমতুল্য সংযুতির এককগুলো মৃত্তিকায় বসবাসকারী প্রাণী ও গাছের শিকড় দ্বারা ভেঙ্গে যেতে পারে। ফলে তুলনামূলকভাবে কম এঁটেলযুক্ত বস্ত্ততে কৌণিক বা উপকৌণিক পিন্ডাকৃতির সংযুতি তৈরি হয়।
প্লাবন প্রভাবিত প্রলেপন সৃষ্টি মৃত্তিকাতে উৎপন্ন ফাটল ও সংযুতি এককের বিন্যাসের ফলে সৃষ্ট ছিদ্রের মধ্য দিয়ে বৃষ্টিপাত ও বন্যার পানি চলাচল করতে পারে। গাছের শিকড় ও প্রাণী দ্বারা সৃষ্ট গর্তের মধ্য দিয়েও পানি চলাচল করতে পারে। এসব গর্তের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানি মৃত্তিকাপৃষ্ঠ থেকে নিচের স্তরে, যেখানে পানি প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় সেখানে বস্ত্তকে বহন করে নিয়ে যায় এবং পরিবাহিত বস্ত্ত অবক্ষেপিত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মৃত্তিকার ফাটল ও রন্ধ্রের পৃষ্ঠ এসব পরিবাহিত বস্ত্ত দ্বারা প্রলেপিত হয়। এ ধরনের প্রলেপনকে gleyans বলা হয়, এ নামটি মৃত্তিকার ফাটল ও রন্ধ্রের উপর সৃষ্ট উজ্জ্বল পৃষ্ঠের জন্য দেওয়া হয়েছে, যা মৌসুম মাফিক প্লাবিত অবস্থার প্রভাবাধীনে মৃত্তিকাপৃষ্ঠ বা পৃষ্ঠমৃত্তিকা থেকে নেমে আসা বস্ত্তর অবক্ষেপণ দ্বারা সৃষ্ট সমরূপভাবে ধূসর; যদি পৃষ্ঠমৃত্তিকা স্তর (যখন ভিজা থাকে) ধূসর হয় তবে মধ্যম ধূসর এবং যদি পৃষ্ঠস্তর গাঢ় ধূসর হয় তবে প্রলেপনের রং গাঢ় ধূসর হয়ে থাকে।
প্রলেপন সৃষ্টির জন্য বাহিত বস্ত্ত পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকার মিশ্রণকে বৃদ্ধি করে। এসব প্রলেপন অন্তর্মৃত্তিকাতে বর্ণ বৈসাদৃশ্য বৃদ্ধি করে, কারণ প্রলেপিত বস্ত্ত মৃত্তিকা সংযুতির বহিঃপৃষ্ঠ ও রন্ধ্রের প্রাচীরকে বিভিন্ন মাত্রায় জারিত (কর্বুরিত) ও বাদবাকি মৃত্তিকা বস্ত্তর তুলনায় (ব্যতিক্রম শুধু সেখানে, যেখানে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি বা কেঁচোর পরিত্যক্ত বস্ত্ত দ্বারা অপসারিত) সমরূপভাবে ধূসর করে।
পৃষ্ঠমৃত্তিকার এসিডীকরণ ও ক্যালসীসরণ (decalcification) পরিপক্ককরণের প্রাথমিক ধাপ, সমরূপকরণ, কর্বুর, সংযুতি ও অন্তর্মৃত্তিকা প্রলেপন সৃষ্টির পর মৃত্তিকা উৎপত্তির পরবর্তী ধাপে পৃষ্ঠমৃত্তিকার এসিডীকরণ সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ নতুন পলল অবক্ষেপণের সময় পললের বিক্রিয়া নিরপেক্ষ মানের কাছাকাছি থেকে আংশিক ক্ষারীয় হয়ে থাকে। গঙ্গা ও নিম্ন মেঘনা অবক্ষেপ সাধারণত চুনময়। তৎসত্ত্বেও যদি পললক্ষেপণ চলতে না থাকে, তবে চুনহীন অবক্ষেপে অবস্থিত পৃষ্ঠমৃত্তিকা সাধারণত ৫০ বছরের কাছাকাছি সময়ের মধ্যে মধ্যম মাত্রায় অম্লীয় হয়ে পড়ে এবং চুনযুক্ত অবক্ষেপে অবস্থিত পৃষ্ঠমৃত্তিকা সাধারণত আংশিক বা সম্পূর্ণরূপ চুনহীন (চুন ক্ষালিত হয়ে যায়) হয়ে পড়ে; এমনকি এদের বিক্রিয়া অম্লীয়ও হতে পারে।
অন্তর্মৃত্তিকার বিক্রিয়া পরিবর্তন পৃষ্ঠমৃত্তিকার নিচে অবস্থিত অন্তর্মৃত্তিকা স্তরগুলোর বিক্রিয়া মৃত্তিকা সৃষ্টির পরবর্তী ধাপে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আদি উৎসবস্ত্তর বিক্রিয়া থেকে সামান্য পরিবর্তন দেখায়, যা সাধারণত বাংলাদেশের মৃত্তিকার ক্ষেত্রে ঘটে। তবে কিছু কিছু তুলনামূলকভাবে পুরাতন সানুদেশীয় মৃত্তিকা, এসিড-সালফেট মৃত্তিকা, গঙ্গা নদী পললভূমিতে সৃষ্ট চুন ক্ষালিত কিছু পুরাতন শৈলশিরা (ridge) মৃত্তিকা, অম্ল অববাহিকা এঁটেল এবং গঙ্গা নদী পললভূমিতে উৎপন্ন চুনযুক্ত গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকাতে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
ফেরোলাইসিস (ferrolysis) প্রাথমিক ধাপ পললভূমির পৃষ্ঠ মৃত্তিকাতে বিরাজমান বিজারিত অবস্থাধীনে যখন এসব মৃত্তিকা বন্যার পানি দ্বারা নিমজ্জিত হয়, তখন ফেরাস আয়রন তৈরি হয় এবং এ ফেরাস আয়ন এঁটেল ও হিউমাস কমপ্লেক্স থেকে ধনাত্মক আয়নসমূহকে অপসারণ করে বন্যার পানিতে প্রেরণ করে। বন্যার পানি সরে যাওয়ায় পর পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে বিদ্যমান আয়রন পুনরায় ফেরিক (Fe3+) আকারে পরিবর্তিত হয় এবং মণিক অবক্ষয় দ্বারা নির্গত ধণাত্মক আয়ন দ্বারা বিনিময় কমপ্লেক্স থেকে অপসারিত হয়, বা যেখানে এ প্রকারের অবক্ষয় দ্বারা ধনাত্মক আয়ন নির্গত হয় না, সেখানে ফেরিক আয়ন হাইড্রোজেন ও অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং এ ক্ষেত্রে মৃত্তিকা বিক্রিয়া এসিডীয় হয়ে থাকে।
চুনযুক্ত বস্ত্তর ক্ষেত্রে ফেরোলাইসিস প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হলো ক্যালসীসরণ। এ ক্যালসীসরণ প্রক্রিয়াটি বিজারিত অবস্থায় জৈবপদার্থের বিয়োজন দ্বারা সৃষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আংশিক চাপ বৃদ্ধির কারণে উৎপন্ন কার্বনিক এসিডের উপস্থিতিতে দ্রুত সংঘটিত হয়। এসব বস্ত্ততে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম কার্বনেট এসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ক্যালসিয়াম বাই কার্বনেট তৈরি করে এবং বন্যার পানিতে দ্রবীভূত হয়ে পানির দ্বারা বাহিত হয়ে চলে যায়। পৃষ্ঠমৃত্তিকা চুনমুক্ত হওয়ায় পর ফেরোলাইসিস প্রক্রিয়া দ্বারা এসিডীকরণ শুরু হয়।
পৃষ্ঠমৃত্তিকার বিক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে মৌসুম মাফিক জারিত ও বিজারিত অবস্থার মধ্যে পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। বিজারিত অবস্থায় পৃষ্ঠমৃত্তিকার বিক্রিয়া নিরপেক্ষ মানের কাছাকাছি থাকে, এমনকি চুনযুক্ত বস্ত্তর ক্ষেত্রেও তা পরিলক্ষিত হয়। বাতান্বয়নের ফলে চুনহীন বস্ত্তর বিক্রিয়া অম্লীয় এবং চুনযুক্ত বস্ত্তর বিক্রিয়া ক্ষারীয় হয়ে থাকে। কিন্তু কালো তরাই (Black Terai) মৃত্তিকার পৃষ্ঠমৃত্তিকা যখন প্লাবিত হয়, তখনও বিজারিত বা আংশিক বিজারিত হয় না। যে কারণে এসব পৃষ্ঠমৃত্তিকা পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার পরও অম্লীয় থেকে যায়।
অন্তর্মৃত্তিকার জারণ মৌসুম মাফিক জারণ-বিজারণ অবস্থার পরিবর্তন কেবল পৃষ্ঠমৃত্তিকাকেই প্রভাবিত করে, কিন্তু সম্ভবত কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়, বিশেষ করে যেসব স্থানে চাপা পড়া অবস্থায় জৈব স্তরসমূহ থাকে। অধিকাংশ পললভূমি মৃত্তিকার অন্তর্মৃত্তিকা জলমগ্নতার সমগ্র সময় ব্যাপী বাতান্বিত থাকে, এমনকি যখন পৃষ্ঠমৃত্তিকা গভীরভাবে নিমজ্জিত থাকে। অন্তর্মৃত্তিকার রন্ধ্র ও ফাটলে আটকা পড়া বায়ুর কারণে এটা ঘটে বলে প্রতীয়মান হয়। পৃষ্ঠমৃত্তিকা চাষাবাদ বা কাদা করার (puddling) ফলে পৃষ্ঠস্থ রন্ধ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেলে বায়ু ভিতরে আটকা পড়ে যায়।
পললভূমির অন্তর্মৃত্তিকা সারা বছর বাতান্বিত থাকার তিনটি নিহিতার্থ আছে। প্রথমত, বায়বীয় অবস্থায় মণিক অবক্ষয় অবিরত চলতে থাকে। যেহেতু সব পললভূমি পলল আয়রন সংবলিত মণিকসমৃদ্ধ থাকে এবং এদের মধ্যে বায়োটাইটের মতো সহজেই অবক্ষয়িত হয়, সেহেতু অন্তর্মৃত্তিকাতে দ্রুত জারিত আয়রনের রং সৃষ্টি হয়। অবিরতভাবে অন্তর্মৃত্তিকা বাতান্বয়নের দ্বিতীয় নিহিতার্থটি হলো এই যে, বেলেময় মৃত্তিকা এবং মিহি সংযুতি সম্পন্ন গাঙ্গেয় এঁটেল ব্যতীত অধিকাংশ পললভূমি মৃত্তিকাতে জলপীঠ (water table) থাকে না, যা অন্তত প্রথাগতভাবে ধারণা করা হতো, অর্থাৎ মৃত্তিকা বস্ত্তর ভিতের মুক্তভাবে প্রবাহিত পানির একটি নিরবিচ্ছিন্ন সম্ভার থাকে না। তৃতীয় নিহিতার্থটি হলো এই যে, মৃত্তিকা নিমজ্জিত থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ মৃত্তিকাতে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণকারী মৃত্তিকা প্রাণীর জন্য বায়ুর অবস্থা প্রাণীর বেঁচে থাকার উপযোগী থাকে।
পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকা গ্রথনের পার্থক্যকরণ মৃত্তিকাতে চলতে থাকা ফেরোলাইসিস প্রক্রিয়ার পরিণামে মৌসুম মাফিক প্লাবিত পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে মণিকের প্রবল অবক্ষয় ঘটে। অবক্ষয়যোগ্য বালি ও পলি কণাতে বিদ্যমান মণিক, যেমন বায়োটাইট এ প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং ভেঙ্গে অধিকতর মিহি পলিকণা ও এঁটেল মণিকে পরিণত হয়। Huizing-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে বায়োটাইট ও মোট মাইকার অনুপাত হ্রাস ব্রহ্মপুত্র-যমুনার অন্তর্মৃত্তিকা ও অন্তঃস্তরে প্রায় ০.৬৫ থেকে ০.৭৫, তিস্তা পললে অবস্থিত তথাকথিত নবীন পললভূমি মৃত্তিকার পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে ০.৪৫ থেকে ০.৫০ এবং পুরাতন পললভূমি মৃত্তিকাতে ০.১০ থেকে ০.৩৫। একটি অগভীর ধূসর সোপান মৃত্তিকা পরীক্ষা করে দেখা গিয়াছে যে, অন্তঃস্তরে এ অনুপাত ০.২০ এবং প্রবলভাবে ফেরোলাইসিস প্রভাবিত পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকাতে ০.১০। এ প্রক্রিয়ায় এঁটেল মণিকও ধ্বংসপ্রাপ্ত বা পরিবর্তিত হয় বলে প্রতীয়মান হয়। পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে এ মণিক অবক্ষয়ের ফলে নিম্নস্থ অন্তর্মৃত্তিকার চেয়ে পৃষ্ঠমৃত্তিকা সুস্পষ্টভাবে স্থূল গ্রথনের হয়।
পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকার মধ্যে গ্রথনের পার্থক্য প্রায় ২০০ বছরের চেয়ে কম সময় পূর্বে সৃষ্ট অবক্ষেপে উৎপন্ন যমুনা পললভূমিতে অবস্থিত কিছু কিছু চুনহীন ধূসর পললভূমি মৃত্তিকাতে পাওয়া যায়। প্রায় ২০০ বছরেরও অধিক কিন্তু সম্ভবত ১-২০০০ বছরের চেয়ে কম প্রাচীন কালের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র পললভূমি ও পুরাতন মেঘনা মোহনাজ পললভূমিতে উৎপন্ন প্রাধান্য বিস্তারকরী চুনহীন গাঢ় ধূসর পললভূমি মৃত্তিকার পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকার মধ্যে এঁটেলের পরিমাণে পার্থক্য ৫ থেকে ১৫ শতাংশ এবং কিছু কিছু এসিড অববাহিকা এঁটেলে এ পার্থক্যের পরিমাণ ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এসব মৃত্তিকাতে অবনয়নের সুস্পষ্ট প্রমাণ সাদা পলির দাগ আকারে ও কর্ষণ যন্ত্র দ্বারা সৃষ্ট শক্তস্তরে (ploughpan) বিভক্তি এবং অন্তর্মৃত্তিকার উপরিস্থিত শক্তস্তরে ফাটল ও রন্ধ্র বরাবর পলি প্রলেপন বিদ্যমান থাকা।
কর্ষণ যন্ত্র দ্বারা সৃষ্ট শক্তস্তরের উৎপত্তি মানুষের কর্মকান্ড চাষাবাদকৃত মৃত্তিকাতে ফেরোলাইসিস প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশে সাধারণভাবে ব্যবহূত সমতল তলাবিশিষ্ট লাঙ্গল দ্বারা কর্ষণ করার ফলে পৃষ্ঠমৃত্তিকার ভিত্তিমূলে ঘনবিন্যস্ত স্তর সৃষ্টি হয়, যা অধিকাংশ মৃত্তিকাতে একটি নিবিড় অপ্রবেশ্য প্লাউপ্যান সৃষ্টি করে। এসব ঘনবিন্যস্ত স্তর অভ্যন্তরীণ নিষ্কাশনে বাধা প্রদান করে। এ কারণে মৃত্তিকার পৃষ্ঠদেশে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় প্লাউপ্যানের উপরিস্থিত চাষকৃত স্তর অচাষকৃত মৃত্তিকা থেকে অধিক বিজারিত হয়ে যায় এবং আরও দ্রুত ফেরোলাইসিস ঘটায়।
জৈবপদার্থের সঞ্চয়ন নিচু এলাকায় অবস্থিত সারা বছর ব্যাপী ভিজা থাকা পাললিক অবক্ষেপ পরিপক্ক হয় না। যেসব এলাকায় এ অবস্থায় অবক্ষেপগুলো দীর্ঘ সময় অবস্থান করে, সেখানে জলজ গাছাপালার পচনের ফলে উৎপন্ন বা যেখানে বোরো ধান চাষ করা হয় সেখানে ধান গাছের অবশেষ পৃষ্ঠের উপর ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে। এসব জৈবপদার্থের উপস্থিতির কারণে পৃষ্ঠমৃত্তিকার রং গাঢ় হয়। মণিক অবক্ষয়ের ফলে নির্গত আয়রনকে জৈববস্ত্ত প্রবলভাবে বিজারিত করে। যদি মৃত্তিকা বস্ত্ততে জৈবপদার্থের পরিমাণ অধিক না হয় তবে মৃত্তিকার রং তুলনামূলকভাবে অধিক নীল বা সবুজ হয়ে থাকে।
তুলনামূলকভাবে পুরাতন নিচু এলাকাতে পিট বা মাক (muck) আকারে পৃষ্ঠের উপর জৈবপদার্থ সঞ্চিত হতে পারে। কটাল (tidal) ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের মতো বিশেষ অবস্থায় অপরিপক্ক পললে বিদ্যমান জৈবপদার্থে সালফার সঞ্চিত হয়। ফলে সুপ্ত বিষাক্ত মৃত্তিকা অবস্থার সৃষ্টি হয়।
যেসব মৃত্তিকা মৌসুম মাফিক শুকিয়ে যায় সেসব মৃত্তিকাতে জৈবপদার্থের পরিমাণ আর্দ্র অবস্থার স্থায়িত্ব, বয়স এবং মৃত্তিকার ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। মৌসুম মাফিক প্লাবনের সময় যত দীর্ঘ হবে, জৈবপদার্থের দ্রুত সবাত বিয়োজন সংঘটিত হওয়ার সময় তত কম হবে। সুতরাং, সাধারণভাবে অববাহিকা সংলগ্ন উঁচুভূমির মৃত্তিকার চেয়ে অববাহিকা মৃত্তিকাতে অধিক পরিমাণে জৈবপদার্থ থাকে।
ফেরোলাইসিস: বিলম্বিত ধাপ সর্বাপেক্ষা পুরাতন পললভূমি মৃত্তিকা এবং মৌসুম মাফিক প্লাবিত সোপান মৃত্তিকার উৎপত্তির ইতিহাসের মধ্যে একটি ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছে। কোন পললভূমি মৃত্তিকাই পৃষ্ঠমৃত্তিকার অবনয়ন এবং অন্তর্মৃত্তিকার উপরের অংশে অপুরু সাদা পলি আবরণ সৃষ্টির চেয়ে বেশি দূর অগ্রসর হয়নি, কিন্তু বরেন্দ্র ও মধুপুর অঞ্চলে অবস্থিত অপ্রতুলভাবে নিষ্কাশিত ব্যাপক বিস্তৃত এলাকা এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলের উত্তরে সানুদেশীয় সমতল অংশে মৃত্তিকার অবনয়ন ৩০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার বা ততোধিক গভীরতা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। এগুলো অগভীর ও গভীর ধূসর সোপান মৃত্তিকা এবং ধূসর উপত্যকা মৃত্তিকা। এসব মৃত্তিকাতে অবনয়নের লক্ষণ পৃষ্ঠমৃত্তিকাতেই বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। উৎস মধুপুর এঁটেলের চেয়ে এ স্তরে ২০-৪০ শতাংশ কম এঁটেল থাকে; অন্তর্মৃত্তিকার নিম্নস্থ অন্তঃস্তরের চেয়ে অন্তর্মৃত্তিকাতে এঁটেলের পরিমাণ ১০-২৫ শতাংশ কম।
দীর্ঘ সময় ধরে অবিরতভাবে চলতে থাকা ফেরোলাইসিসের ফলে এসব মৃত্তিকাতে তীব্র মণিক অবক্ষয় এবং এঁটেলের ধ্বংসসাধন সংঘটিত হয়েছে। কয়েক হাজার বছর পূর্বে প্রাকৃতিক তৃণভূমির অবস্থাধীনে এ প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু রোপা ধান চাষের জন্য কাদা করার ফলে পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে ফেরোলাইসিসের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবিজারিত পৃষ্ঠমৃত্তিকার অবস্থান পললভূমির চূড়ায় (ridge) অবস্থিত কিছু কিছু মৃত্তিকা মৌসুম মাফিক প্লাবিত হয়, কিন্তু নিমজ্জিত হলেও এদের পৃষ্ঠমৃত্তিকা বিজারিত হয় না। এ ধরনের ঘটনা বেলেময় বস্ত্ত, যেমন- কালো তরাই মৃত্তিকাতে ঘটে। কারণ কর্ষণ এমনকি রোপা ধান আবাদের জন্য কর্ষণ করা হলেও পৃষ্ঠমৃত্তিকা সম্পূর্ণরূপে কাদাযুক্ত হয় না এবং প্লাউপ্যানও উৎপন্ন হয় না। এসব মৃত্তিকা উঁচু পললভূমির শিখরাঞ্চলেও দেখা যায়, কারণ বিজারণ ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় একাধারে ১৪ দিন প্লাবিত অবস্থায় থাকার চেয়ে কম সময় এসব মৃত্তিকা প্লাবিত থাকে। এ ধরনের মৃত্তিকাতে পৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত পানি বা মৃত্তিকার মধ্য দিয়ে চলমান পানি ভূ-জলপৃষ্ঠ (water table) পর্যন্ত সম্পূর্ণ পরিলেখকে বাতান্বিত অবস্থায় রাখে। সবাত অবস্থায় এসব মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
লবণাক্তকরণ উপকূলের নিকটে অবস্থিত কিছু কিছু ভূমি জোয়ারের লবণাক্ত পানি দ্বারা বছরের অংশবিশেষ বা সারা বছর ব্যাপী প্লাবিত হওয়ার ফলে কিছু মৃত্তিকা উৎপন্ন হয়। এ ধরনের মৃত্তিকা গঙ্গা কটাল পললভূমির দক্ষিণ-পশ্চিমে, নতুন মেঘনা মোহনাজ পললভূমির উপকূলীয় এলাকা এবং চট্টগ্রামের উপকূলীয় সমভূমির অভ্যন্তরে কটাল সমভূমিতে ব্যাপক আকারে বিস্তৃত। গঙ্গা নদী পললভূমির পশ্চিমের কোন কোন অংশ, প্রধানত যশোর অঞ্চলে লবণাক্ত গুণ সম্পন্ন মৃত্তিকা বিচ্ছিন্নভাবে উঁচু এলাকা শিখরে স্থানীয়ভাবে বিদ্যমান। অধিকাংশ এলাকাতে লবণাক্ত ভূজল থেকে পৃষ্ঠের দিকে পানির কৈশিক প্রবাহের কারণে লবণাক্ততার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের ঘটনা ভেড়ীবাঁধ দ্বারা রক্ষিত এলাকাতেও দেখা যায়।
ক্ষারীকরণ (alkalisation) মৃত্তিকার স্থায়ী সম্পৃক্ত অঞ্চল থেকে পৃষ্ঠের দিকে দীর্ঘ সময় ব্যাপী লবণের নিরবচ্ছিন্ন কৈশিক চলনের ফলে পৃষ্ঠমৃত্তিকাতে বিনিময়যোগ্য ধনাত্মক আয়নের ১৫ শতাংশেরও অধিক সোডিয়াম দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। একারণে ভিজা অবস্থায় মৃত্তিকা বিকীর্ণ হয়ে যায়। এরপর পৃষ্ঠমৃত্তিকা অত্যন্ত দৃঢ় ও অপ্রবেশ্য হয়ে পড়ে এবং বর্ষাকালে দ্রবণীয় লবণের নিম্নমুখী ক্ষালন বাধাপ্রাপ্ত হয়। এসব স্তর প্রবল ক্ষারীয় বিক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং পিএইচ মানের পরিসর ৯ থেকে ১১-এর মধ্যে থাকে। পিএইচ মান অধিক হওয়ার কারণে এসব মৃত্তিকা প্রথাগত শস্যচাষের অনুপযুক্ত হয়ে যায়। প্রধানত যশোর অঞ্চলে গঙ্গা নদী পললভূমির পশ্চিম অংশেই কেবল ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন এলাকাতে ক্ষার মৃত্তিকা দেখা যায়। এসব এলাকার পললভূমি অবক্ষেপ কয়েক হাজার বছরের পুরাতন হতে পারে, যা তথাকথিত মৃতকল্প (moribund) গঙ্গা নদী বদ্বীপের অংশ হয়ে আছে।
ক্যালসীভবন (calcification) পলল যখন প্রথম অবক্ষেপিত হয় তখন গঙ্গা নদী পললে, প্রধানত পলি ও মিহি বালি অংশে প্রায় ৫ থেকে ১০ শতাংশ চুন (ক্যালসিয়াম কার্বনেট) থাকে। মৃত্তিকা উৎপত্তির সময় এ চুন ক্ষালনের প্রভাবাধীনে আসে এবং অধিকাংশ চুন মৃত্তিকা থেকে অপসারিত হয়, কিন্তু প্রায়ই পরিলেখের মধ্যে সামান্য পুনর্বণ্টিত হয়। চুনের পুনর্বণ্টন পুরাতন শিকড় দ্বারা সৃষ্ট নালা বরাবর বা প্রাণী দ্বারা সৃষ্ট ছোট ছোট গর্তে অল্পসংখ্যক ছোট শক্ত অনিয়তাকার চুনের গুটির উপস্থিতি থেকে প্রমাণিত হয়। দুটি এলাকাতে চুন বিভিন্নরূপে পুনর্বন্টিত হয়েছে। একটি ক্ষেত্রে, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলের পশ্চিমে গঙ্গা নদী পললভূমির সর্বাপেক্ষা পুরাতন অংশে অবস্থিত কিছু উঁচু এলাকার মৃত্তিকার পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকা থেকে আংশিক বা সম্পূর্ণ চুন ক্ষালিত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু অন্তর্মৃত্তিকা বা অন্তঃস্তরে সামান্য পরিমাণে শক্ত পাউডার সদৃশ চুন দৃষ্টিগোচর হয়। মৃত্তিকাতে চুন সঞ্চয়নের অন্য এলাকাটি হলো মধ্য রাজশাহী অঞ্চল, যেখানে আত্রাই নদীর অবক্ষেপ গঙ্গা নদী পললভূমি এলাকার পাশাপাশি অবস্থান করে। এ অঞ্চলের ব্যাপক বিস্তৃত এলাকার অন্তর্মৃত্তিকা বা অন্তঃস্তরে শক্ত অসমাঙ্গ চুন গুটি একটি পুরু স্তরে পাওয়া যায়, যার পরিমাণ মৃত্তিকার ওজন ভিত্তিক প্রায় ২০ শতাংশ।
প্লাবনবিহীন অবস্থায় মৃত্তিকা উৎপত্তির ধাপসমূহ প্লাবনবিহীন অবস্থায় মৃত্তিকা উৎপত্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াগুলো হলো সমরূপকরণ, জারণ, ক্ষালন এবং মণিক অবস্থা। কোন কোন মৃত্তিকার ক্ষেত্রে ভূমিক্ষয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উঁচু পললভূমির শিকরে অবস্থিত এবং সুনিষ্কাশিত সোপান ভূমি ও পাহাড়ি এলাকার মৃত্তিকাতে এ প্রক্রিয়াগুলোর প্রাধান্য সুস্পষ্ট। সদৃশ প্রক্রিয়াগুলো মৌসুম মাফিক প্লাবিত মৃত্তিকাতেও ঘটে, কিন্তু এসব মৃত্তিকার পৃষ্ঠমৃত্তিকা বিজারিত হয় না, যেমন- কালো তরাই মৃত্তিকা।
উঁচু পললভূমির শিখরে অবস্থিত মৃত্তিকা পললভূমির শিখরে অবস্থিত মৃত্তিকাগুলো ব্যতিক্রমী অধিক প্লাবনের ফলে স্বল্প সময়ের জন্য প্লাবিত হয় এবং নতুন পলল দ্রুত সমরূপ ও জারিত হয়; কিন্তু এর ব্যতিক্রম অত্যন্ত বেলেময় বস্ত্তর ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেখানে এসব প্রক্রিয়ার হার অত্যন্ত ধীরে কাজ করে। গাছপালার শিকড় ও প্রাণী দ্বারা সমরূপকরণের সময় স্তরায়ণ ভেঙ্গে যায়, যা সাধারণত তুলনামূলকভাবে স্থূল বেলেস্তর বা অন্তঃস্তরে বিদ্যমান স্থায়ী সম্পৃক্ত অঞ্চল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। বাংলাদেশে বিরাজমান অধিক তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার কারণে মণিকগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত অবক্ষয়িত হয়। যেহেতু প্রায় সকল প্রকারের পললভূমি পললে অধিক পরিমাণে বায়োটাইট থাকে, সেহেতু অবক্ষয়ের দ্বারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আয়রন নির্গত হয় এবং সবাত অবস্থাধীনে জারিত মৃত্তিকার রং প্রদান করে। উঁচু পললভূমির শিখরগুলো সাধারণত প্রবেশ্য বেলেময় বা পলিময় বস্ত্ত দ্বারা গঠিত এবং প্রবল জৈব ক্রিয়ার দ্বারা এসব বস্ত্ত আরও অধিক প্রবেশ্য হয়। এসব মৃত্তিকাতে পতিত বৃষ্টির পানি প্রধানত শোষিত হয় এবং মৃত্তিকার ভিতরে চলে যায়। বৃষ্টির পানিতে শোষিত বাযুমন্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্বারা কার্বনিক এসিডের একটি লঘু দ্রবণ তৈরি হয়, যা ক্ষারক ও ক্যালসিয়াম কার্বনেটের ক্ষালন ঘটায়।
এসব প্রক্রিয়ার ফলে উঁচু পললভূমির শিখরে চুনযুক্ত ও চুনহীন বাদামি পললভূমি মৃত্তিকা তৈরি হয়। এসব মৃত্তিকার অন্তর্মৃত্তিকা সমরূপ বাদামি, জলপাই-বাদামি বা হলদে বাদামি রঙের হয়ে থাকে। চুনহীন মৃত্তিকাগুলো সাধারণত ক্ষালিত হযে যায়: পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকার পিএইচ মান সাধারণত ৫.০ থেকে ৬.০ এবং অন্তঃস্তরে ৬.০ থেকে ৭.০ হয়ে থাকে।
হিমালয় পর্বত সানুদেশীয় সমতলভূমি মৃত্তিকা হিমালয় পর্বত সানুদেশীয় সমতলভূমিতে মৃত্তিকা উৎপত্তির প্রক্রিয়া কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়েছে। ব্যাপক আকারে বিস্তৃত অধিকাংশ মৃত্তিকাতে পরিলেখগুলো প্রায় ৯০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার গভীরতা পর্যন্ত সমরূপতা লাভ করেছে এবং জারিত হয়েছে। এ গভীরতার নিচে ধূসর বা সাদা আলগা বালি বিদ্যমান। যদি উপরিস্থিত মৃত্তিকার উৎসবস্ত্ত ও এ বালি একই হয় তবে উপরের স্তরে বিদ্যমান অধিক পরিমাণে পলিকণা ও এঁটেল (সাধারণত অন্তঃস্তরের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ অধিক) উৎপন্ন করতে বালি মণিকের উল্লেখযোগ্য অবক্ষয় ঘটেছে। তৎসত্ত্বেও, মণিকবিদ্যাগত অনুশীলন থেকে দেখা যায় যে, অন্তঃস্তর ও উপরের মৃত্তিকা স্তরের মধ্যে বায়োটাইট অবক্ষয়ের মাত্রাতে সামান্য পার্থক্যই বিদ্যমান। এ তথ্য থেকে ধারণা করা হয় যে, এসব স্তরের মধ্যে বিদ্যমান গ্রথনিক পার্থক্য সম্ভবত উৎস পললের মধ্যে বিদ্যমান উৎপত্তিগত পার্থক্যকেই প্রতিফলিত করে।
হিমালয় পর্বত সানুদেশীয় সমতলভূমির মৃত্তিকাগুলো, বিশেষকরে উত্তর দিকের মৃত্তিকাগুলোর পৃষ্ঠমৃত্তিকা গাঢ় রঙের। এসব মৃত্তিকাকে কালো তরাই মৃত্তিকা হিসেবে আলাদাভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব মৃত্তিকার অস্বাভাবিক গভীরতা পর্যন্ত অস্বাভাবিক পরিমাণে জৈব বস্ত্তর সঞ্চয়ন ঘটেছে, কারণ এসব মৃত্তিকা বর্ষাকালে ভিজা অবস্থায় থাকলেও বিজারিত অবস্থায় থাকে না এবং জৈব ক্রিয়া দ্বারা প্রবলভাবে মিশ্রিত হয়। কালো তরাই মৃত্তিকার কালো পৃষ্ঠমৃত্তিকার পুরুত্বের পরিসর ২৫ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার বা এর চেয়েও অধিক। চুনহীন বাদামি পললভূমি মৃত্তিকার পৃষ্ঠমৃত্তিকার পুরুত্ব ঠিক একই ধরনের, কিন্তু ক্রমশ কম গাঢ় রঙের হয়। এসব মৃত্তিকার রং বর্ষাকালে মৃত্তিকার অবস্থা কম সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে গাঢ় বাদামি হয়ে থাকে (এর সম্ভাব্য কারণ অংশত স্বল্প বৃষ্টিপাত এবং অংশত অধিক সুনির্দিষ্ট ভূসংস্থানে তুলনামূলকভাবে সুনিষ্কাশিত মৃত্তিকা অবস্থা)।
পাহাড়ি মৃত্তিকা উত্তর ও পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ে অবক্ষয় ও ভূমিক্ষয় দ্বারা সৃষ্ট বস্ত্ততেও সমরূপকরণ, জারণ ও ক্ষালন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং বাদামি পাহাড়ি মৃত্তিকা সৃষ্টি করে। অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে এবং ভূগর্ভস্থ জলের (groundwater) প্রভাব না থাকায় এসব মৃত্তিকা বিক্রিয়ার দিক থেকে অধিক অম্লীয় হয়ে পড়ে এবং সাধারণত সমগ্র পরিলেখে পিএইচ মানের পরিসর ৪.০ থেকে ৪.৫-এর মধ্যে থাকে। এসব মৃত্তিকা উৎপন্নকারী শিলা অধিক গভীরতায় প্রবেশকারী গাছের শিকড়ের সহায়তায় অনুস্রাবিত বৃষ্টির পানি ও বায়ুর প্রভাবে দ্রুত চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। মণিক অবক্ষয়ের ফলে আয়রন নির্গত হয় এবং কিছু এঁটেল উৎপন্ন করে। যে কারণে উৎপন্ন মৃত্তিকা এদের উৎসশিলা থেকে অধিক জারিত ও এঁটেল সমৃদ্ধ হয়। এসব মৃত্তিকাতে বিভিন্ন প্রকার গাছের শিকড় ও মৃত্তিকা প্রাণী, বিশেষকরে কেঁচো ও উইপোকা দ্বারা অত্যধিক জৈব ক্রিয়া ঘটে। এসব কর্মকান্ডের দ্বারা সমরূপকরণের ফলে পৃষ্ঠমৃত্তিকা ও অন্তর্মৃত্তিকার গ্রথন ও রং সমরূপ হয়ে যায়। অধিকাংশ পাহাড়ি মৃত্তিকা গাঢ় বাদামি বা হলদে-বাদামি এবং দোঅাঁশ গ্রথনের হয়ে থাকে। অসংহত বেলেপাথর থেকে উৎপন্ন অল্প সংখ্যক মৃত্তিকা অধিকতর লাল এবং কর্দমশিলা (shale) থেকে উৎপন্ন মৃত্তিকা অধিকতর ধূসর।
বাদামি পাহাড়ি মৃত্তিকা প্রধানত খাড়া ঢালে দেখা যায়। এসব স্থানে মৃত্তিকাপৃষ্ঠ থেকে ভূমিক্ষয় দ্বারা বস্ত্ত অপসারণ ও উৎসবস্ত্ত থেকে অবক্ষয় দ্বারা মৃত্তিকা বস্ত্তর সৃষ্টি বাহ্যত পাল্লা দিয়ে চলে; কিন্তু এর ব্যতিক্রম সর্বাপেক্ষা খাড়া ঢালে দেখা যায়, যেখানে চাষাবাদের জন্য বন ধ্বংস করা হয়েছে। মৃত্তিকাগুলো সাধারণত ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার পুরু হয়, কিন্তু কোন কোন খাড়া ঢালে এবং কিছু কর্দম শিলার উপর উৎপন্ন মৃত্তিকার ক্ষেত্রে মৃত্তিকা তুলনামূলকভাবে অপুরু হয়, কারণ এসব ক্ষেত্রে ভূমিক্ষয় অতি দ্রুত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, মৃদু ঢাল এবং অধিকতর বেলেময় শিলার উপর উৎপন্ন মৃত্তিকার পুরুত্ব বেশি হয়। পৃষ্ঠ থেকে অবিরতভাবে বস্ত্ত অপসারণ এবং নিচের উৎস বস্ত্ত থেকে উৎপন্ন নতুন বস্ত্ত মৃত্তিকাতে একীভূতকরণের সম্মিলিত প্রভাবে মৃত্তিকা সৃষ্টির তুলনামূলকভাবে নবীন ধাপেই মৃত্তিকা সংরক্ষিত হয়।
এঁটেল আবরণ (orgillans) কোন কোন পাহাড়ি মৃত্তিকার অন্তর্মৃত্তিকা ও অন্তঃস্তরে বিদ্যমান, যা পৃষ্ঠমৃত্তিকা থেকে নিচের স্তরসমূহে এঁটেলের নিম্নমুখী ক্ষালনকে নির্দেশ করে। সাধারণত এসব প্রলেপন সামান্য পরিমাণেই থাকে বলে প্রতীয়মান হয় এবং সম্ভবত জৈব ক্রিয়া দ্বারা মৃত্তিকা বস্ত্তর মিশ্রণের কারণে এগুলো খন্ডে খন্ডে অবস্থান করে।
সোপান মৃত্তিকা কিছু কিছু উঁচুভূমি এলাকাতে ভূমিক্ষয় দ্বারা বস্ত্ত অপসারণ, এর নিম্নস্থ উৎস বস্ত্তর অবক্ষয় দ্বারা নতুন বস্ত্ত মৃত্তিকাতে একীভূতকরণের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম। মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলের সমতল পৃষ্ঠ ও সুনিষ্কাশিত এলাকার সমতল ও মৃদুঢাল সংবলিত পাহাড়ি এলাকা পূর্বে সমতল ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে উপত্যকা দ্বারা বিচ্ছিন্ন হওয়া বরেন্দ্র ভূমির কিছু কিছু এলাকাতে এ অবস্থা বিদ্যমান। উৎস শিলার উপর অবক্ষয়িত বস্ত্ত জমা হওয়ার ফলে গভীর লাল-বাদামি সোপান মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। এসব মৃত্তিকা সাধারণত পাহাড়ি মৃত্তিকার চেয়ে কম অম্লীয় এবং মৃত্তিকা পিএইচ মানের পরিসর ৫.০-৫.৫ বা কখনো কখনো এর চেয়ে অধিক হয়ে থাকে।
মধুপুর ও বরেন্দ্র অঞ্চলে আদি মধুপুর এঁটেলের অবক্ষয় হাজার হাজার বছর পূর্বে বর্তমান অবস্থার চেয়ে ভিন্ন জলবায়ু ও ভূপ্রাকৃতিক অবস্থার প্রভাবাধীনে শুরু হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, অগভীরভাবে অবক্ষয়িত কিছু কিছু মৃত্তিকাতে অধিক পরিমাণের চুনের গুটি ও ঘর্ষরেখার (slickensides) উপস্থিতি থেকে ধারণা করা হয় যে, কয়েক হাজার বছর পূর্বে বিদ্যমান তুলনামূলকভাবে শুষ্ক এবং সম্ভবত অধিকতর উষ্ণ জলবায়ু অবস্থায় এগুলো সৃষ্টি হয়েছিল।
অগভীর সোপান মৃত্তিকাতে অপ্রবেশ্য ভারী গ্রথনের মধুপুর এঁটেল অন্তঃস্তর মৃত্তিকার উৎপত্তিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। প্রথমত, সমরূপতার গভীরতা সীমিতকরণ, কারণ শিকড় ও মৃত্তিকা প্রাণীর নিচের দিকে গমন স্ফীতিশীল এঁটেলের দৃঢ় প্রকৃতি, বর্ষাকালে এর ভিজা অবস্থা এবং শুষ্ক মৌসুমে এর অত্যন্ত শুষ্ক অবস্থা দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। উপরন্ত, ভারী এঁটেল অভ্যন্তরীণ নিষ্কাশনকে বাধা দেওয়ার কারণে অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি পৃষ্ঠের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে যায় এবং পৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত পানির সঙ্গে মৃত্তিকা পৃষ্ঠ থেকে বস্ত্তকে অপসারণ করে নিয়ে যায়।
গভীর সোপান মৃত্তিকার অন্তঃস্তরে মৌসুম মাফিক পরিবর্তনশীল ভূ-জল পৃষ্ঠের প্রভাবাধীনে অবক্ষয় সংঘটিত হওয়ার কারণে অন্তঃস্তরে লাল রঙের কর্বুর সৃষ্টি হয়েছে। এ স্তর পর্যন্ত সম্প্রসারিত প্রবল জৈব ক্রিয়া এবং নিচের স্তর থেকে বস্ত্তকে পৃষ্ঠের দিকে স্থানান্তরের কারণে সমরূপ লাল (তুলনামূলকভাবে কম নিষ্কাশিত এলাকাতে বাদামি) অন্তর্মৃত্তিকার সৃষ্টি করেছে। আদি প্রাকৃতিক বনভূমিতে সংঘটিত জৈব ক্রিয়া পরিলেখের গভীরেও জৈব পদার্থকে মিশ্রিত করেছে, কিন্তু জৈব পদার্থের রঙের উপর প্রবল জারিত বস্ত্তর রঙের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। জৈব ক্রিয়া দ্বারা মিশ্রিত হওয়া সত্ত্বেও এসব মৃত্তিকার পৃষ্ঠমৃত্তিকা থেকে এঁটেল অপসারিত হয়ে অন্তর্মৃত্তিকা ও অন্তঃস্তরে সঞ্চিত হয়েছে। ফলে এসব অন্তঃপৃষ্ঠ স্তরের চেয়ে পৃষ্ঠমৃত্তিকা গ্রথন তুলনামূলকভাবে হালকা প্রকৃতির। সঞ্চিত এঁটেল দ্বারা সৃষ্ট আবরণ কোনো কোনো মৃত্তিকাতে দেখা যায়, কিন্তু পাতলা ব্যবচ্ছেদের পর্যবেক্ষণ থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, এগুলো জীবাশ্ম (fossil) হতে পারে, কারণ সম্ভবত জৈব কর্মকান্ডের দ্বারা মিশ্রণের ফলে এগুলো প্রায়ই খন্ডে খন্ডে অবস্থান করে এবং প্রধানত লাল কর্বুরিত অন্তঃস্তরের জারিত অংশে সংরক্ষিত রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
মণিকবিদ্যাগত অনুশীলক থেকে দেখা গিয়েছে যে, মধুপুর ও বরেন্দ্র ভূমির গাঢ় লাল-বাদামি সোপান মৃত্তিকাগুলো সম্পূর্ণরূপে অবক্ষয়িত নয়। এঁটেল অংশের প্রায় ৪০ শতাংশ ইলাইট (মিহি দানাদার মাইকা) ও ভার্মিকুলাইট দিয়ে গঠিত এবং তুলনামূলকভাবে অনবক্ষয়িত (unweathered) ক্ষার ও প্ল্যাজিওক্লেজ ফেল্ডস্পার বালি অংশে থাকে। গাঢ় রঙের মণিকগুলো অবক্ষয়ের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হয়ে গিয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, উৎস মধুপুর এঁটেলে এ ধরনের মণিক সামান্য পরিমাণে থাকে। [আমিনুল ইসলাম; সিরাজুল হক এবং নাজমুল হাসান]