মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১

মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১  উত্তরাধিকার, বিবাহ রেজিস্ট্রি, বহুবিবাহ, তালাক, দেনমোহর ও ভরণপোষণ সংক্রান্ত আইন। এ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধনের জন্য আইন কমিশনের কিছু সুপারিশ কার্যকর করার ঘোষণা প্রদান করা হয়। এ ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক এ অধ্যাদেশটি জারি করা হয়, যা ১৯৬১ সালের ৮নং অধ্যাদেশ নামে পরিচিত।

এ অধ্যাদেশে পারিবারিক বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি সালিসী কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়। স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং প্রতিযোগী পক্ষগণের মধ্য থেকে একজন করে প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিনিধি সমন্বয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হবে। পৌর এলাকায় পৌরসভার চেয়ারম্যান এবং মিউনিসিপাল কর্পোরেশন এলাকায় কর্পোরেশনের মেয়র বা প্রশাসক সালিসী কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।

এ অধ্যাদেশের অন্তর্ভুক্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সকল আইন, প্রথা বা রীতির উপর এ আইন কার্যকর হবে। এ আইনের ৪নং ধারায় উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী সংশোধন আনা হয়। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে লা-ওয়ারিশ প্রথাকে বাতিল করা হয়। এ আইনে বলা হয়, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টিত হওয়ার পূর্বে মৃত ব্যক্তির কোন পুত্র বা কন্যার মৃত্যু হলে, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টিত হওয়ার সময় ঐ পুত্র বা কন্যার সন্তানাদি যদি জীবিত থাকে, তাহলে ঐ মৃত পুত্র বা কন্যা বণ্টনের সময় জীবিত থাকলে সে যে অংশ পেতো, তার সন্তানাদি সমষ্টিগতভাবে অনুরূপ অংশ পাবে।

৫নং ধারায় বহুবিবাহ সম্পর্কে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এ ধারায় বলা হয়, কোন ব্যক্তির একটি বিবাহ বলবৎ থাকা অবস্থায় সালিস পরিষদের পূর্বানুমতি ছাড়া পুনরায় বিবাহ করতে পারবে না এবং এরূপ অনুমতি ব্যতীত কোন বিবাহ সম্পন্ন হলে তা রেজিস্ট্রি করা যাবে না। বিবাহ করতে হলে সালিস পরিষদের অনুমতির জন্য নির্ধারিত ফি দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে হবে এবং আবেদনপত্রে প্রস্তাবিত বিবাহের কারণ, প্রয়োজনীয়তা এবং এ বিবাহে বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণের সম্মতি আছে কিনা তা উল্লেখ করতে হবে।

আবেদনপত্র পাওয়ার পর চেয়ারম্যান আবেদনকারী ও তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণকে তাদের নিজ নিজ প্রতিনিধি মনোনয়ন করতে বলবেন এবং এ সালিস পরিষদ যদি মনে করে যে, প্রস্তাবিত বিবাহটি প্রয়োজন ও ন্যায়সঙ্গত তাহলে পরবর্তী বিবাহে অনুমতি প্রদান করতে পারেন। আবেদনপত্র সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সালিস পরিষদ তার সিদ্ধান্তের কারণসমূহ লিপিবদ্ধ করবে। কোন পক্ষ নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট মহকুমা হাকিমের নিকট পুনর্বিচারের আবেদন করতে পারবে এবং মহকুমা হাকিমের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। এর বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

কোন পুরুষ সালিস পরিষদের অনুমতি ব্যতীত যদি আরও একটি বিবাহ করে, তাহলে তাকে (ক) অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণের সমস্ত দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে হবে। পরিশোধ করা না হলে তা বকেয়া রাজস্বের ন্যায় আদায় করা যাবে; (খ) অভিযোগক্রমে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে।

বিবাহ রেজিস্ট্রি এ আইনের মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিম বিবাহ রেজিস্ট্রিকরণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ আইন অনুসারে বিয়ে রেজিস্ট্রির উদ্দেশ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে লাইসেন্স মঞ্জুর করা হয় এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিকাহ রেজিস্ট্রার নামে অভিহিত হন। একটি ওয়ার্ডের জন্য একজন মাত্র নিকাহ রেজিস্ট্রার থাকবেন। এ আইন অমান্যকারীকে তিন মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন ফি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। যদি কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় তবে তাকে যে কোন প্রকারে তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্র সম্ভব চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং নোটিশের একটি নকল স্ত্রীকে পাঠাতে হবে। তালাক ঘোষণার পর তা প্রত্যাহার করা না হলে চেয়ারম্যানকে নোটিশ দেয়ার দিন থেকে নববই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ হবে না। নোটিশ পাওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান পক্ষসমূহের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিস পরিষদ গঠন করবেন এবং সালিস পরিষদ এ সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে ৯০ দিন সময় অথবা প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবৎ হবে না। এই আইনের পর থেকে তালাক দ্বারা বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটেছে এরূপ স্ত্রী, এটি তৃতীয়বারের বিয়ে বিচ্ছেদ না হয়ে থাকলে, মধ্যবর্তী সময়ে অন্যকোন পুরুষকে বিয়ে না করেই পুনরায় পূর্ব স্বামীকে বিয়ে করতে পারবেন। অর্থাৎ স্বামীকে বিয়ে করার ব্যাপারে অন্য পুরুষকে বিয়ে করার যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তা এ আইনে রহিত করা হয়। তালাক কার্যকর করার ক্ষেত্রে যদি কোন ব্যক্তি তালাকের আইন অনুযায়ী কার্যসম্পাদন না করে, সে ব্যক্তি এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।

তালাক ব্যতীত অন্যভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ  যেক্ষেত্রে তালাকের অধিকার স্ত্রীকে যথাযথভাবে প্রদান করা হয়েছে এবং স্ত্রী সে অধিকার প্রয়োগ করতে চায়, অথবা যেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী তালাক ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়, সেক্ষেত্রে তালাকের বিধানসমূহ প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ যথাসম্ভব প্রযোজ্য হবে।

খোরপোষ  কোন স্বামী তার স্ত্রীকে পর্যাপ্ত খোরপোষ না দিলে, অথবা একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের সমান খোরপোষ না দিলে, স্ত্রী বা স্ত্রীগণের যে কেউ আইনের আশ্রয় গ্রহণ ছাড়াও স্থানীয় চেয়ারম্যানের নিকট আবেদন করতে পারবে। চেয়ারম্যান সালিস পরিষদ গঠন করবেন এবং সালিস পরিষদ স্বামী কর্তৃক খোরপোষ হিসেবে দেয় অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করে একটি সার্টিফিকেট দিতে পারবেন। স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ এই সার্টিফিকেটের বিরুদ্ধে মহকুমা হাকিমের নিকট আপীল করতে পারবেন। মহকুমা হাকিমের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অন্য কোন আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

দেনমোহর এ আইনে দেনমোহর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে, পূর্বে স্ত্রী বা স্ত্রীগণের দেনমোহর পরিশোধ করা না হয়ে থাকলে স্ত্রী বা স্ত্রীগণ চাহিবামাত্র তাদের দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। এ আইন পাকিস্তান আমলের আইন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও বলবৎ ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশেও এ আইন বলবৎ রয়েছে।  [সাহিদা বেগম]