মীর বহর
মীর বহর মুগল নৌবাহিনীর প্রধান কর্মকর্তা। মুগল শাসনামলে সম্রাট আকবরের অধীনে নৌ বাহিনীর জন্য নির্ধারিত দপ্তরের দায়িত্ব মীর-ই-বহর (মীর বহর) নামের একজন কর্মকর্তার উপর ন্যস্ত ছিল। তিনি অভ্যন্তরীণ নদীপথ এবং যুদ্ধের জন্য নৌবহর বা নওয়ারা তৈরি রাখতেন (বিশেষ করে বাংলা এবং বিহার প্রদেশের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য ছিল) এবং নদীতে নৌকা সহযোগে পুল বা ব্রিজ নির্মাণ করা ছাড়াও নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর নিয়ন্ত্রণ করা এবং এই পথে চলাচলকারী সকল বড় ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে শুল্ক আদায় করার কাজ পরিচালনা করতেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজী (১২১২-১২২৭ খ্রিস্টাব্দ) সর্বপ্রথম বাংলায় নৌবহর গঠন করেছিলেন। নদীবহুল বাংলায় বর্ষাকালে নদী অববাহিকা প্লাবিত হয় এবং বছরের ছয় মাসেরও অধিককাল বেশিরভাগ অঞ্চল জলমগ্ন থাকে। ফলে অশ্বারোহী ও হাতি বাহিনী বছরের প্রায় অর্ধেক সময় অকেজো বসে থাকত। একারণে বাংলায় নৌবহর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং যুদ্ধে বাংলার নৌবহর (ফ্লোটিলা) খুব কার্যকর ভূমিকা রাখে।
বস্ত্তত আক্ষরিক অর্থে মুগলদের কোন নৌবাহিনী ছিল না এবং এমনকি সম্রাট আকবরের সময় থেকে আওরঙ্গজেব এর সময় পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের জাহাজের প্রতিরক্ষার জন্য ইওরোপীয় শক্তির অনুমতিপত্রের উপর নির্ভর করতে হত। প্রাথমিক পর্যায়ে মুগলদের কেবলমাত্র একটি নৌবহর (নওয়ারা) ছিল, কিন্তু নৌবাহিনীর জন্য নির্ধারিত কোন নৌ-দপ্তর ছিল না। ফলে এতে সামরিক, নৌ, বানিজ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ের মিশ্রণ ঘটেছিল। পরবর্তীকালে মীর বহর এর দপ্তর সামরিক বাহিনীর শক্তির আধার হিসেবে পরিগণিত হয় এবং সাফল্যজনক কর্মকান্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে তার দক্ষতার ছাপ রাখে। প্রদেশের সরকার ব্যবস্থার কাজ কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থার মতই পরিচালিত হত। গভর্নর ছাড়াও প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে নিজস্ব দীউয়ান, বকসী, মীর আদল, সদর, মীর বহর, কোতয়াল প্রভৃতি পদ সমূহ ছিল। প্রদেশের মীর বহর তাঁর এখতিয়রিভুক্ত সীমানার মধ্যে নদী ও সমুদ্রবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ঢাকায় অবস্থানরত নওয়ারার মীর বহরকে আরাকান, মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের উপুর্যুপরি আক্রমণ ও লুণ্ঠনের হাত থেকে ঢাকা নগর রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে হত। মুগলদের যে স্বল্প সংখ্যক নৌকা ছিল তা খুব কমই সমুদ্রে গমন করত। কেবলমাত্র অল্প কয়েকটি জাহাজ, সাধারণত নদীর সীমান্তে ও তার মোহনায় অবস্থান করত এবং নদী সমূহে চলাচলের জন্য ছোট ছোট নৌকার ব্যবহার হত। সার্বিকভাবে নদীবন্দর ও সমুদ্র বন্দর এর নিরাপত্তার রক্ষা করাই ছিল মীর বহর এর প্রধান দায়িত্ব। কখনো কখনো তিনি মীর বর বা জনকল্যাণ বিভাগের প্রকৌশলীরও দায়িত্ব পালন করতেন। সম্রাট আকবর এর অধীনে এ প্রকার উভয় দফতরের দায়িত্ব পালন করতেন মীর কাসিম। মুগল সুবাহদার ইসলাম খান চিশতি (১৬০৮-১৬১৩ খ্রিস্টাব্দ) নৌবহরের শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং সমগ্র বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। [নাসরীন আক্তার]