মির্যা, মেজর জেনারেল সৈয়দ ইস্কান্দার আলী
মির্যা, মেজর জেনারেল সৈয়দ ইস্কান্দার আলী (১৮৯৯-১৯৬৯) পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তিনি ১৮৯৯ সালের ১৩ মে মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। বোম্বাই (মুম্বাই) শহরে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হয় এবং এলফিনস্টোন কলেজে তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর ১৯১৮ সালে তিনি রয়্যাল মিলিটারি একাডেমীতে (স্যান্ডহার্স্ট) পড়াশুনা করেন। ১৯২০ সালে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তাঁকে ১৯২০ সালের ১৬ জুলাই ক্যামেরোনিয়ান দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে সংযুক্ত করা হয়। তিনি ১৯২১ সালে খোদাদ-খেল এবং ১৯২৪ সালে ওয়াজিরিস্তানে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইস্কান্দার আলী ১৯২৬ সালে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে ভারতীয় পলিটিক্যাল সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হিসেবে এবোটাবাদ (১৯২৬-১৯২৮), বান্নু (১৯২৮-১৯৩০), নওশেরা (১৯৩০-১৯৩৩) ও টন্কে (১৯৩৩) এবং ডেপুটি কমিশনার পদে হাজারা (১৯৩৩-১৯৩৬) ও মর্দানে (১৯৩৬-১৯৩৮) দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ইস্কান্দার মীর্যা খায়বারে (১৯৩৮-১৯৪০) পলিটিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ, পেশোয়ারে ডেপুটি কমিশনার (১৯৪০-১৯৪৫) এবং উড়িষ্যা রাজ্যে পলিটিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ পদে (১৯৪৫-১৯৪৬) কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে তিনি যুগ্মসচিব নিযুক্ত হন এবং দেশবিভাগের পর পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব নিযুক্ত হন। পূর্ববাংলা প্রদেশে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল ও গভর্নর জেনারেলের শাসন জারীর পর তিনি ১৯৫৪ সালের ৩০ মে প্রদেশের গভর্নর নিযুক্ত হন।
গভর্নর নিযুক্ত করার পরপরই ইস্কান্দার মীর্যা আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি এক মাসের মধ্যে ৩৩ জন পার্লমেন্ট সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন অধ্যাপকসহ ১০৫১ জন লোককে গ্রেফতার করেন। সভা অনুষ্ঠান ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, সংবাদপত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। এতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তিনি গভর্নর হাউজকে সুসজ্জিত করেন এবং নাচ-গানসহ সেখানে প্রায় নিয়মিত জাঁকজমকপূর্ণ নৈশভোজের আয়োজন করতেন। ছদ্মবেশে তিনি হাসপাতাল, বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিসে তদারকি করতেন। ১৯৫৪ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো ও তাদের পুনর্বাসনে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। ১৯৫৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং তাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অভ্যন্তরীণ ও সীমান্ত এলাকা বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়।
১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট অসুস্থতার জন্য গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ছুটিতে গেলে তিনি প্রথমে পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল এবং পরে গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন।
পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান (১৯৫৬) মোতাবেক গভর্নর জেনারেলের পদকে প্রেসিডেন্ট পদে রূপান্তর করা হয় এবং সৈয়দ ইস্কান্দার আলী মির্যা জাতীয় পরিষদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তিনি ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি করেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে আইয়ূব খান এক রক্তপাতহীন সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। তিনি ইস্কান্দার মীর্যাকে প্রথমে কোয়েটা এবং পরে লন্ডনে নির্বাসনে পাঠান। ১৯৬৯ সালের ১২ নভেম্বর মির্যা লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার তাঁর মরদেহ পাকিস্তানে সমাহিত করতে অনুমতি দেয়নি। সে কারণে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করার জন্য তেহরানে (ইরান) নিয়ে যাওয়া হয়। ইরানের শাহ একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদায় তাঁর মৃতদেহ রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন।
দায়িত্ব পালনে দক্ষতার জন্য জেনারেল ইস্কান্দার মীর্যা অনেক পদক ও সম্মাননা লাভ করেন, যেমন কিং পঞ্চম জর্জ সিলভার জুবিলি পদক (১৯৩৫), ইন্ডিয়া জেনারেল সার্ভিস পদক (১৯৩৬), কিং ষষ্ঠ জর্জ করোনেশন পদক (১৯৩৭), অফিসার অব দি অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার (১৯৩৯), কম্প্যানিয়ন অব দি অর্ডার অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার (১৯৪৫), পাকিস্তান স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৪৮), রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ করোনেশন পদক (১৯৫৩), গ্র্যান্ড কলার অব দি অর্ডার অব পাহলভি অব দি এম্পায়ার অব ইরান (১৯৫৬), অর্ডার অব দি সুপ্রিম সান, ফার্স্ট ক্লাস অব দি কিংডম অব আফগানিস্তান (১৯৫৮)। [আবু জাফর]