মিন্টো, লর্ড২
মিন্টো, লর্ড২ ১৯০৫ থেকে ১৯১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয়। ১৯০৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি লর্ড কার্জন এর উত্তরসুরী হিসেবে মনোনীত হন। তিনি ছিলেন লর্ড মিন্টোর পৌত্র। তাঁর পিতামহ প্রথম মিন্টো ১৮০৭ থেকে ১৮১৩ পর্যন্ত প্রায় সাত বছর কোম্পানির শাসনাধীনে ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন। রক্ষণশীল দলের একজন সদস্য লর্ড মিন্টো যখন ভারতে আসেন তখন তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে তিনি দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধ, মিশর ও কানাডায় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন।
শাসক হিসেবে লর্ড মিন্টোকে দ্বিবিধ বাধার সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমত, সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সরকারে অংশীদারিত্ব দাবি করছিল। দ্বিতীয়ত, একটি নতুন দেশপ্রেমিক শ্রেণি আত্মপ্রকাশ করেছিল, যারা ছিল বয়সে তরুণ এবং আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এদের অধিকাংশই ছিল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বিশ্বাসী। বোমা-পিস্তলের ব্যবহার শিখে তাঁরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তা প্রয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। ম্যাজিনি ও কুজুথ-এর মতো ইউরোপীয় বিপ্লবিগণ ছিলেন তাঁদের আদর্শ। তাঁদের দৃষ্টিতে অত্যাচারী ও অপ্রিয় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের হত্যা করা ছিল স্বাধীনতা অর্জনের একটা পন্থা। তারা এতটাই সাহসী হয়ে ওঠে যে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়গণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি লর্ড ও লেডী মিন্টো যখন আহমেদাবাদে একটা সরকারি সফরে ছিলেন তখন তাঁদের দিকেও বোমা ছোড়া হয়, যদিও তাঁরা অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান। কঠোর আইন প্রবর্তন এবং পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করে মিন্টো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়াসী হন।
লাজপৎ রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ এবং অন্যান্য আরও অনেককে গ্রেপ্তার এবং এসব বিপ্লবীদের অনেককে নির্বাসিত করা হয়।
ভারত সচিব মর্লি এবং গভর্নর জেনারেল মিন্টো উভয়েই উপলব্ধি করেন যে, অনুগতদের উৎসাহিত এবং পুরস্কৃত করা উচিত। তারা সিমলা ডেপুটেশন এর মাধ্যমে উপস্থাপিত মুসলমান সম্প্রদায়ের দাবিদাওয়া বিবেচনা করে ১৯০৯ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাস করেন। এটি সাধারণত মর্লি-মিন্টো সংস্কার নামে পরিচিত। কংগ্রেসের দৃষ্টিতে মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে মাত্রাতিরিক্ত ও অন্যায্য প্রতিনিধিত্ব প্রদান করায় ১৯০৯ সালের লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস অসন্তোষ প্রকাশ করে। মিন্টো স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত এরূপ আন্দোলন, দমন এবং সাময়িক সংস্কারের দুষ্টচক্র চলতে থাকে।
চাপের মুখে পূর্ববঙ্গ ও আসাম এর গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার পদত্যাগ করায় প্রথমদিকে মুসলমানগণ মিন্টোর প্রশাসনে রুষ্ট ছিল। কিন্তু তাদেরকে স্বতন্ত্র নির্বাচন প্রদান এবং বঙ্গভঙ্গ একটি স্থায়ী বাস্তবতা এরূপ ঘোষণা দিয়ে মিন্টো শেষপর্যন্ত তাদের মন জয় করেন।
মিন্টোর পদক্ষেপে ভারত সচিবের কাউন্সিলে দুজন ভারতীয়, গভর্নর জেনারেলের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে একজন (সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ, পরবর্তীকালে লর্ড সিংহ) ভারতীয় এবং প্রত্যেক প্রাদেশিক কাউন্সিলে একজন করে ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়। একজন ভারতীয় প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। মিন্টোর গৃহীত এ ব্যবস্থা সকল ভারতীয়ের মনোপুত হয়।
মিন্টো ১৯১০ সালের প্রেস অ্যাক্ট পাস করেন। এ আইনের আওতায় রাষ্ট্রবিরোধী কোন প্রকাশনার অভিযোগে কঠোর অর্থদন্ড এবং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিধান অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ আইনের ফলে সরকারের প্রায় কোন রকম স্বাধীন সমালোচনাই করা সম্ভব ছিল না। প্রচন্ড জনরোষের মুখে ১৯১০ সালের নভেম্বর মাসে মিন্টো পদত্যাগ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। লর্ড হার্ডিঞ্জ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। [মুহম্মদ আনসার আলী]