মিত্র, স্যার রমেশচন্দ্র
মিত্র, স্যার রমেশচন্দ্র (১৮৪০-১৮৯৯) বিচারপতি, সমাজসেবক। পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার রাজারহাট-বিষ্ণুপুর গ্রামে এক খ্যাতনামা কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা রামচন্দ্র মিত্র ছিলেন সদর দেওয়ানি আদালতের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি আরবি ও ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
রমেশচন্দ্র হেয়ার স্কুলে অধ্যয়ন করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারী। জুনিয়র ও সিনিয়র উভয় পরীক্ষায় তিনি বৃত্তি লাভ করেন। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করে ১৮৬১ সালে তিনি বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে রমেশচন্দ্র সদর দেওয়ানি আদালতে ওকালতি পেশা গ্রহণ করে দীর্ঘদিন এ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৮৬২ সালে দেওয়ানি আদালতকে কলকাতা হাইকোর্টের সঙ্গে একীভূত করা হয় এবং রমেশচন্দ্র ১৮৭১ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত এর অন্যতম বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাঙালি বিচারকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ১৮৮২ ও ১৮৮৬ সালে দুবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। উক্ত সময়ের মধ্যে কিছুদিন তিনি Hay’s Law Report নামক পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন।
রমেশচন্দ্র ১৮৮৭ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং ১৮৯১ সালে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নিযুক্ত হন। তিনি জুরি কমিশনেরও (১৮৯৩) সভ্য ছিলেন। জুরি পদ্ধতিকে পঙ্গু করার লক্ষ্যে প্রস্ত্তত Elliott’s Notification বাতিলকরণের পক্ষে তিনি জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফেলো, আইন অনুষদের সভাপতি এবং কিছু সময়ের জন্য ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অফ সায়েন্স-এর ভাইস-প্রেসিডেন্টও ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ (স্যার) উপাধিতে ভূষিত করে। পরবর্তীকালে তিনি কে.সি.আই.ই উপাধি পান। ১৮৯০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর রমেশচন্দ্র ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ১৮৯৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন।
রমেশচন্দ্র ভারতে শিক্ষা বিস্তারে উদারভাবে সহায়তা করেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৮৯০ সালে কলকাতার রিপন কলেজ অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পায়। তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনেও সহায়তা করেন। ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুল, ভবানীপুর সবরবন স্কুল, ভবানীপুর গার্লস স্কুলসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। সংস্কৃত বিষয়ের পঠন-পাঠনের জন্য তিনি কলকাতার ভবানীপুরে ভাগবত চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। তিনি নারীশিক্ষায় বিশ্বাসী ছিলেন, তবে তা ভারতীয় নারীত্বের আদর্শকে খর্ব করে নয়। তাঁর অন্যান্য সমাজসেবামূলক কাজের মধ্যে রয়েছে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় ও নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত দুটি স্কুলের ব্যবস্থাপনাব্যয় বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ এবং কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাসিক অর্থ প্রদান।
রমেশচন্দ্র ছিলেন তীক্ষ্ণ বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি ফৌজদারি আইন, রাজস্ব আইন এবং সিভিল আইনে প্রভূত দক্ষ ছিলেন। তিনি স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতেন এবং কখনও কোন হুমকি বা চাপের মুখে পরাভূত হননি, বা কোনো লোভ-লালসায় আকৃষ্ট হননি। তাঁর পক্ষপাতহীন বিচারাঙ্গন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ১৮৮৩ সালে স্যার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলার বিচারে ইংরেজ বিচারকের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
রমেশচন্দ্রের দেশাত্মবোধ ছিল প্রবল। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির এক অনন্য পুরুষ। তিনি ইলবার্ট বিল-এর একজন প্রত্যক্ষ সমর্থক ছিলেন। ভারত ও ইংল্যান্ডে আই.সি.এস পরীক্ষা একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। ১৮৯১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত স্বদেশী বাজারের ক্ষেত্রেও তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
রমেশচন্দ্র সমাজসংস্কার ও সমাজপরিবর্তনের ধারাবাহিক অগ্রগতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রাগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী এবং বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতার বিরোধী। তিনি ১৮৯১ সালের Age of Consent Bill-এর বিরোধিতা করেন। এ বিলকে সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের অনাকাক্ষিত হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করা হয়। তিনি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাসমূহের মূলোৎপাটনে উৎসাহী ছিলেন। নিরভিমান, অমায়িক ও উদার মনের অধিকারী রমেশচন্দ্র ধর্মবিশ্বাসে ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান হিন্দু। শেষ জীবনে তিনি ধর্মগ্রন্থ পাঠসহ ধর্মানুসন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। ১৮৯৯ সালের ১৩ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]